সারাক্ষণ রিপোর্ট
বিশ্বব্যাংকের যাত্রার শুরু কোনো দাতব্য উদ্দেশ্যে নয়। বরং যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থ ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কাঠামোকে জোরদার করার লক্ষ্য থেকেই এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। শুরুতে লক্ষ্য ছিল বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। পরে কিছুটা মানবিক দিকও যুক্ত হয়। তবে সাম্প্রতিক সংস্কারে উন্নয়ন ও দারিদ্র্য হ্রাসের মতো মূল উদ্দেশ্যগুলো আরও সুস্পষ্টভাবে সামনে এসেছে। উল্লেখযোগ্য যে, এই বিশাল উন্নয়ন উদ্যোগের মূল অর্থের বড় অংশই বেসরকারি খাত থেকে আসবে।
কেন এখন উন্নয়ন অতীব গুরুত্বপূর্ণ
বর্তমান বিশ্বে উন্নত ও উন্নয়নশীল—দুদিকের মানুষের মনে একই ধরনের প্রশ্ন জাগছে: “কেন এখানে বিনিয়োগ করব?” বা “আগামী দিনের পৃথিবী কেমন হবে?” এই প্রশ্নের জবাব শুধু কথায় নয়, বাস্তব পদক্ষেপের মাধ্যমেই দিতে হবে। উন্নয়ন কার্যক্রমের উদ্দেশ্য হলো ইতিবাচক পরিবর্তন আনা, নতুন সুযোগ তৈরি করা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
কাজের সুযোগ সৃষ্টি
উন্নয়নের এক বড় কাজ হলো চাকরির বাজার প্রসারিত করা। কারণ:
- চাকরি মানুষের স্বনির্ভরতা বাড়ায়
- মানবিক সহায়তার প্রয়োজনীয়তা কমায়
- বাজারে ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বাড়ায়
- বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়তা করে
যেখানে কর্মসংস্থান থাকে, সেখানেই অপরাধ, সহিংসতা, অস্থিতিশীলতা ও অনিয়ন্ত্রিত অভিবাসনের প্রবণতা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়।
স্থানীয় ক্ষমতায়ন ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা
প্রত্যেক দেশেরই উচিত একটি গতিশীল বেসরকারি খাত গড়ে তোলা, যেখানে স্থানীয় মানুষের জন্য কাজের সুযোগ সৃষ্টি হবে। জ্বালানি, অবকাঠামো, কৃষি, স্বাস্থ্যসেবা, পর্যটন, খনিজসম্পদ—এসব খাতের উন্নয়নের মাধ্যমে দেশীয় অর্থনীতি শক্তিশালী করা জরুরি। কাজ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সরিয়ে নয়, বরং স্থানীয়ভাবেই নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করে অর্থনৈতিক ভিত মজবুত করা প্রয়োজন।
বেসরকারি খাতের ভূমিকা
বিশ্বব্যাংক বিনিয়োগকারীদের শুধু বাজার খোঁজার পথ দেখায় না, বরং সঠিকভাবে মূলধন ব্যবহারের কাঠামো তৈরিতেও সাহায্য করে। পাশাপাশি স্বচ্ছতা, দুর্নীতি দমন এবং চুক্তি কার্যকর রাখার মতো বিষয়গুলোতে সহায়তা দিয়ে অর্থনৈতিক কাঠামোকে স্থিতিশীল করে তোলে।
একসময় মনে করা হতো “বিলিয়ন থেকে ট্রিলিয়নে” যাওয়া মানে হয়তো প্রচুর পরিমাণ অলস বেসরকারি মূলধন পড়ে আছে। কিন্তু মূলধন আসে তখনই, যখন সঠিক অবকাঠামো ও আয়ের বাস্তব সম্ভাবনা থাকে।
সঠিক পরিবেশের প্রয়োজন
বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে জরুরি মূলত দুইটি বিষয়:
১) শক্তিশালী অবকাঠামো
২) স্থিতিশীল ও পূর্বাভাসযোগ্য নীতি-নিয়ন্ত্রক পরিবেশ
এই দুইটি ক্ষেত্র দুর্বল হলে বড় ধরনের বেসরকারি মূলধন বিনিয়োগ সহজে আসে না।
বিশ্বব্যাংকের কার্যপ্রণালি
বিশ্বব্যাংক গ্রুপ বিভিন্ন সরকারের সঙ্গে কাজ করে গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো প্রকল্পে বিনিয়োগ নিশ্চিত করে এবং অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহারে পরামর্শ দেয়। যেমন করব্যবস্থা বা ভূমি ব্যবস্থাপনা সহজ করা—এসব ক্ষেত্রে কার্যকর সংস্কার আনা হয়, যেন ব্যবসা করা সহজ হয়। প্রতিটি বিনিয়োগের সাথেই নির্দিষ্ট ফলাফল নির্ধারণ থাকে, যাতে আর্থিক প্রবাহ সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায়।
ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) ও মাল্টিলেটারাল ইনভেস্টমেন্ট গ্যারান্টি এজেন্সি (এমআইজিএ) সরাসরি বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ, ইকুইটি, গ্যারান্টি এবং রাজনৈতিক ঝুঁকি বীমা দিয়ে সহায়তা করে। স্থানীয় বাজার ও দক্ষতা উন্নয়নেও তারা ভূমিকা রাখে। সরকার ও বেসরকারি খাতের এ যৌথ উদ্যোগের ফলেই বড় পরিসরে উন্নয়ন বাস্তবায়ন সম্ভব হয়।
Mission 300
Mission 300-এর লক্ষ্য হল ২০৩০ সালের মধ্যে আফ্রিকার ৩০ কোটি মানুষকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনা। অংশগ্রহণকারী সরকারগুলো নীতি ও নিয়ন্ত্রক কাঠামো উন্নত করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, যার সঙ্গে আইডিএ-র অর্থায়নের শর্তও যুক্ত থাকে। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়ন দ্রুত হয় এবং বেসরকারি বিনিয়োগকারীরাও আত্মবিশ্বাসের সাথে বিনিয়োগ করে।
ঋণদাতা দেশের স্বার্থ ও বিনিয়োগের বহুগুণ আদায়
বর্তমান বৈশ্বিক টানাপোড়েন, কম প্রবৃদ্ধি এবং নানামুখী চ্যালেঞ্জের মধ্যে বিশ্বব্যাংক তার শেয়ারহোল্ডার সরকারগুলোকে অনন্য সুযোগ দিচ্ছে। অল্প মূলধন বিনিয়োগ করেই ১০ গুণের মতো বড় মূলধনের প্রবাহ সৃষ্টি সম্ভব।
গত ৮০ বছরে ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংক ফর রিকন্সট্রাকশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইবিআরডি) ও অন্যান্য উন্নয়ন সহায়তা সংস্থায় মাত্র ২৯ বিলিয়ন ডলার পেইড-ইন ক্যাপিটাল বিনিয়োগ করে প্রায় ১.৫ ট্রিলিয়ন ডলারের উন্নয়ন তহবিল সংগ্রহ করা গেছে। অর্থাৎ, ১ ডলার মূলধনে প্রায় ৫০ গুণ অর্থের সংস্থান হয়েছে। আর সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোর জন্য কাজ করা আইডিএ অনুদান ও স্বল্প সুদের ঋণ দেয়, যেখানে ১ ডলারে ৪ ডলার পর্যন্ত অতিরিক্ত মূল্য যুক্ত হয়। এটি উন্নয়নের সবচেয়ে কার্যকর ও সাশ্রয়ী উপায় যা সরকার, করদাতা এবং বৈশ্বিক সম্প্রদায়ের জন্য লাভজনক।
উন্নয়নের ব্যাপক সম্ভাবনা
উন্নয়নশীল বিশ্বের বিপুল তরুণ জনগোষ্ঠী ও প্রাকৃতিক সম্পদকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কর্মী, উদ্যোক্তা এবং উদ্ভাবক তৈরি হতে পারে এখান থেকেই। শুধু দারিদ্র্য দূর করাই নয়, এই উন্নয়ন ভবিষ্যৎ পৃথিবীর অগ্রযাত্রাকে টেকসই ও স্থায়ী রূপ দিতে সহায়তা করবে।