সারাক্ষণ রিপোর্ট
যুক্তরাষ্ট্রে এক নতুন ধরনের প্রতারণা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে, যেখানে অপরাধীরা প্রিয়জনের ভয়ভীতিকর পরিস্থিতিতে পড়া কণ্ঠ নকল করে টাকা আদায়ের চেষ্টা করছে। বিশেষ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ব্যবহার করে এই ভুয়া কণ্ঠ তৈরি করা হচ্ছে, যা অনেকটাই বাস্তবের মতো শোনায়।
এক মা ও তার ভয়ংকর অভিজ্ঞতা:
৬২ বছর বয়সী লিন্ডা রোয়ান ফেব্রুয়ারির এক সন্ধ্যায় স্যুপ রান্না করছিলেন, তখনই তার ফোন বেজে ওঠে। স্থানীয় নম্বর দেখে তিনি কলটি রিসিভ করেন। ফোনের ওপাশে কান্নারত এক তরুণী বললো, “মা, আমি ঠিক আছি, কিন্তু একটা ভয়ানক ঘটনা ঘটেছে। আমাকে সাহায্য করো।” রোয়ান ভেবেছিলেন, এটা তার ছোট মেয়ের কণ্ঠ।
এরপর এক পুরুষ কণ্ঠ পরিচয় দেয় এবং বলে, তার মেয়ে তার মাদক চুক্তির সাক্ষী হয়ে গেছে এবং বন্দুক দেখে ভয় পেয়ে চিৎকার করেছে, যার ফলে ক্রেতারা পালিয়ে গেছে। সে দাবি করে, তার মেয়ে এখন তার ভ্যানে আছে এবং টাকা না দিলে তাকে ছেড়ে দেবে না।
ওয়ালমার্টে যাত্রা ও অর্থ পাঠানো:
রোয়ানকে বলা হয়, যদি তিনি মেয়েকে আবার দেখতে চান, তবে ওয়ালমার্টে গিয়ে ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের মাধ্যমে মেক্সিকোতে টাকা পাঠাতে হবে। সন্দেহ হলে যেন তিনি বলেন, তার ভগ্নিপতি কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মেক্সিকোতে অক্সিজেনের জরুরি প্রয়োজন।
রোয়ান বুঝতে পারছিলেন এটা প্রতারণা হতে পারে, কিন্তু মেয়ের মতো কণ্ঠ তাকে বিভ্রান্ত করেছিল। ভয় আর আতঙ্কে তিনি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দোকানে পৌঁছান। তবে ক্রেডিট কার্ড দিয়ে টাকা পাঠানো সম্ভব না হওয়ায় তিনি বাড়ি ফিরে অনলাইনে ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের মাধ্যমে ১,০০০ ডলার পাঠান।
দ্বিতীয় দফায় আরও টাকা দাবি:
টাকা পাঠানোর পর প্রতারক জানায়, এত দেরি হওয়ায় তার বস রেগে গেছে এবং আরও ১,০০০ ডলার দিতে হবে। সে বলে, তার বস মেয়েকে ৩০,০০০ ডলারে বিক্রি করে দিতে পারে। ফোনে মেয়ের কান্না শোনানো হয়। রোয়ান আরেক দফা মানিগ্রামের মাধ্যমে টাকা পাঠান।
সত্য উদঘাটন ও বাস্তবতা:
প্রতারক ফোন কেটে দেওয়ার পর রোয়ান তার মেয়েকে ফোন করেন। কয়েকবার চেষ্টা করার পর মেয়ে ফোন ধরে এবং জানায়, সে সম্পূর্ণ নিরাপদ ও বাসায় আছে এবং এসব কিছুই তার জানা ছিল না।
সামগ্রিক চিত্র ও বিশেষজ্ঞদের মতামত:
সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের মতে, আজকের দিনে কেবল তিন সেকেন্ডের অডিও দিয়ে ৮৫% নির্ভুলতায় কণ্ঠ নকল করা সম্ভব। মেকাফির এক জরিপ অনুযায়ী, ৭,০০০ জনের মধ্যে অর্ধেকের বেশি মানুষ নিয়মিতভাবে অনলাইনে নিজের কণ্ঠ ব্যবহার করেন, যা প্রতারকদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করে।
মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, ভয় আমাদের বিবেক-বুদ্ধিকে থামিয়ে দেয়। আমাদের মস্তিষ্কের অ্যামিগডালা ভয় বা বিপদ বুঝে কাজ শুরু করে, তখন যুক্তিবোধ নিয়ন্ত্রণ হারায়।
প্রতারণার তদন্ত ও আইনগত অসহায়ত্ব:
রোয়ান পুলিশের কাছে অভিযোগ করেন। তবে পুলিশ জানায়, যেহেতু টাকা মেক্সিকোতে গেছে এবং কোনো নিশ্চিত তথ্য নেই, তাই অপরাধীকে শনাক্ত করে বিচার করা কঠিন। তার ব্যাঙ্ক ও ক্রেডিট কার্ড কোম্পানি জানায়, যেহেতু তিনি নিজের ইচ্ছায় টাকা পাঠিয়েছেন, তাই টাকা ফেরত দেওয়া সম্ভব নয়।
উপসংহার:
মেকাফির জরিপে দেখা গেছে, প্রতি ১০ জনে ১ জন এমন কণ্ঠ নকল প্রতারণার ফোন পেয়েছেন এবং তাদের বেশিরভাগই আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছেন। এমন প্রতারণা থেকে বাঁচতে, সন্দেহজনক ফোন কল পেলে প্রথমেই প্রিয়জনের প্রকৃত নম্বরে যোগাযোগ করা উচিত এবং অর্থ পাঠানোর আগে ভালোভাবে যাচাই করা জরুরি।