এক বাঁকা বাঁধাকপিতে শুরু
ডাচ বীজ কোম্পানি ‘স্লুইস অ্যান্ড গ্রুট’-এর তৈরি ১৮৯৯ সালের এক বিশেষ বাঁধাকপি, ‘গ্লোরি অব এনকহাউজেন’, থেকেই সাইমন গ্রুটের ভাবনার সূত্রপাত। ইউরোপের আবহাওয়ায় দুর্দান্তভাবে জন্মানো এই বাঁধাকপি তিনি ১৯৬৫ সালে জাভার পাহাড়ি অঞ্চলে দেখতে পান দুর্বল, বিকৃত ও রোগাক্রান্ত অবস্থায়। স্পষ্ট হয়, এই ইউরোপীয় জাত এ অঞ্চলের উষ্ণ আবহাওয়া ও রোগ-জীবাণু মোকাবিলা করতে পারছে না। আর কৃষকরা—যারা এসব চাষ করেছিলেন—রয়ে গেছেন আগের মতোই দরিদ্র।
একক অভিযাত্রার সূচনা
১৬ বছর ধরে এই সমস্যার সমাধান নিয়ে ভাবতে থাকেন গ্রুট। ১৯৮১ সালে ‘স্লুইস অ্যান্ড গ্রুট’ বিক্রি হওয়ার পর তিনি নিজেই এককভাবে কাজ শুরু করেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল ট্রপিক্যাল অঞ্চলের শাকসবজির উন্নত জাত উদ্ভাবন, কৃষিবাণিজ্যের প্রসার ও পুষ্টির মানোন্নয়ন। সেই সময় পর্যন্ত ধান-গমের মতো প্রধান শস্যে হাইব্রিড পদ্ধতি প্রয়োগ হলেও, শাকসবজি ছিল উপেক্ষিত। অথচ শাকসবজিই ছিল তাঁর ভালোবাসা—পুরো পরিবারই ১৮৬৭ সাল থেকে বীজ উৎপাদনে যুক্ত ছিল।
ট্রপিক্যাল এশিয়ার সম্ভাবনা ও আগ্রহ
ট্রপিক্যাল এশিয়ার নানা অচেনা সবজির প্রতি গ্রুটের ছিল প্রবল আগ্রহ: কাঁকড়শাক (আমারান্থ), পানিতে জন্মানো পাটশাক (কাংকুং), মুগডাল, মুলা, চই সাম ইত্যাদি। এসব শাকসবজিতে প্রোটিন ও ভিটামিন প্রচুর ছিল। একদিকে তিনি ছিলেন বীজবিজ্ঞানী, অন্যদিকে ব্যবসায়ী—এই অঞ্চল ছিল তাঁর কাছে সম্ভাবনার বিশাল ক্ষেত্র।
‘ইস্ট ওয়েস্ট সিড’-এর বিপ্লব
১৯৮২ সালে ফিলিপাইনে ‘ইস্ট ওয়েস্ট সিড’ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে শুরু হয় তাঁর কার্যক্রম। শুরুতে কৃষকেরা নতুন হাইব্রিড বীজ নিতে চাইতেন না। যেমন, আমপালায়া বা করলার নতুন জাত ‘জেড স্টার’ প্রথমে অনেকের ক্ষেতেই ব্যর্থ হয়। তবে কিছু সফল কৃষকের অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে পড়লে ধীরে ধীরে আস্থা গড়ে ওঠে।
এই কোম্পানির উদ্ভাবিত বীজ ২০২০ সালের মধ্যে ৮০টির বেশি দেশে ২ কোটিরও বেশি ছোট কৃষকের আয় বাড়িয়েছে। কোম্পানির লোগো ‘রেড অ্যারো’ কৃষকদের কাছে কোকাকোলার মতোই পরিচিত হয়ে ওঠে।
কৃষকের পাশে, কৃষকের সঙ্গে
গ্রুট ছিলেন কৃষকের কাছের মানুষ—লম্বা গড়ন, সাদা পোশাক, মাথায় সান হ্যাট পরে মাঠে-মাঠে ঘুরে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলতেন। অধিকাংশ কৃষকের জমি ছিল মাত্র এক বা দুই হেক্টরের, সেখানে সবজি ছিল সবচেয়ে লাভজনক ফসল। কিন্তু বাজারে যে চকচকে বীজের প্যাকেট মিলত, তার ভেতরে থাকত দুর্বল জিন। কৃষকেরা বারবার সেই দুর্বল জাতের বীজ থেকেই বীজ রেখে চাষ করতেন, ফলে উৎপাদন কমে যেত।
সাফল্যের গল্প, জীবন বদলের ছোঁয়া
গ্রুটের বীজে ফলন বাড়ে চোখে পড়ার মতো। ইন্দোনেশিয়ার নিচু অঞ্চলে টমেটো উৎপাদন শুরু হয়, যেখানে আগে সম্ভব ছিল না। ‘বার্ডস আই’ নামের থাই মরিচে ৩০-৪০ শতাংশ উৎপাদন বৃদ্ধি হয়, আর লম্বা শিম জন্মায় বনজঙ্গল সদৃশ ঘনভাবে। অনেক কৃষকের আয় দ্বিগুণ বা তিনগুণ পর্যন্ত বেড়ে যায়।
উদাহরণস্বরূপ, এক নারী কৃষক চই সাম চাষ করে রান্নাঘর তৈরি করেন ও মোটরবাইক কেনেন। আরেক কৃষক মাত্র ৬ ডলারের বীজ থেকে ৩,৫০০ ডলারের কুমড়া বিক্রি করেন।
সাশ্রয়ী মূল্য ও গবেষণার অঙ্গীকার
হাইব্রিড জাতের বীজ থেকে নতুন বীজ রাখা গেলেও তা সঠিক ফল দেয় না, ফলে প্রতি মৌসুমে নতুন বীজ কেনা প্রয়োজন হতো। এজন্য গ্রুট দাম রেখেছিলেন খুবই কম—২০১৭ সালে এক ডলারে পাওয়া যেত একটি ভ্যালু প্যাক। লাভের টাকা ফিরিয়ে দেওয়া হতো গবেষণা ও সম্প্রসারণে।
কৃষকের ভালোবাসা ও সম্মান
কৃষকেরা ধীরে ধীরে গ্রহণ করলেন গ্রুটকে। মাঠে গেলে তাঁকে করতালি ও উৎসবে বরণ করা হতো। ২০১৯ সালে তিনি পান বিশ্ব খাদ্য পুরস্কার—যা পুষ্টিবিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কার হিসেবে পরিচিত।
তবে তাঁর স্বপ্ন এখানেই শেষ নয়। তিনি চেয়েছিলেন এশিয়ায় কৃষকদের ধান থেকে সরে সবজির দিকে আনতে, কারণ কার্বোহাইড্রেট ও মাংসজাত খাদ্য বেশি হয়ে পড়ছিল। আফ্রিকায় তাঁর কাজ ছিল অল্পই, অথচ সম্ভাবনা ছিল বিপুল।
শেষ দৃশ্য ও প্রতীকী বীজ
জীবনের শেষদিকে এক সাক্ষাৎকারে তিনি তাঁর নিজের উৎপাদিত শাকসবজির পাশে বসে ছিলেন—ডাচ রেনেসাঁ যুগের চিত্রকর্মের মতো সুন্দর লাল টমেটো ও ফরাসি শিম। কিন্তু যার সঙ্গে তিনি ছবি তুলতে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন, তা ছিল দেখতে কুৎসিত, করলার মতো কাঁঠাল-চামড়ার ‘জেড স্টার’—যে বীজটি তাঁর ৬,০০০ মাইল দূরের কৃষক বন্ধুদের জীবন বদলে দিয়েছিল।
খাদ্য স্বপ্নদ্রষ্টা
সাইমন গ্রুট ছিলেন শুধু একজন বিজ্ঞানী নন, বরং এক খাদ্য-স্বপ্নদ্রষ্টা, যিনি কৃষক ও ভোক্তার জীবনে এনেছিলেন টেকসই পরিবর্তন। বিশ্বব্যাপী ক্ষুদ্র কৃষকের জীবনযাত্রা ও পুষ্টির মানোন্নয়নে তাঁর অবদান অনন্য।