রাম মাধব
ইতিহাস একটি জটিল বিষয়, যেখানে একাধিক স্তর ও ব্যাখ্যা বিদ্যমান। জর্জ অরওয়েল তাঁর বিখ্যাত রচনা ১৯৮৪–এ ভবিষ্যদ্বাণীমূলকভাবে বলেছেন, “যে বর্তমানকে নিয়ন্ত্রণ করে, সেই অতীতকে নিয়ন্ত্রণ করে; আর যে অতীতকে নিয়ন্ত্রণ করে, সেই ভবিষ্যতকে নিয়ন্ত্রণ করে।” এই কারণেই সমসাময়িক ব্যাখ্যার প্রভাব ইতিহাসের ঘটনাবলি ও ব্যক্তিত্বদের উপলব্ধিতে অনেকটাই প্রাধান্য পায়। বাবাসাহেব আম্বেদকরের ১৩৫তম জন্মজয়ন্তী উদ্যাপনের প্রাক্কালে আমাদের সচেতন থাকতে হবে, যেন তাঁর জীবন ও কাজকে কোনো রকম অপূর্ণ বা অগভীর দৃষ্টিতে বিচার না করি।
আম্বেদকর ও মহাত্মা গান্ধীর মধ্যে মতপার্থক্য রাজনীতিতত্ত্ব ও শিক্ষা-গবেষণায় একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়। সত্য যে তাদের মধ্যে মৌলিক স্তরের মতবিরোধ ছিল এবং গান্ধীর মৃত্যুর পরেও সেই পার্থক্য বহাল থাকে। ১৯৫৫ সালে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আম্বেদকর বলেছিলেন, তিনি গান্ধীকে “মহাত্মা” বলতে পছন্দ করেন না, কারণ তিনি গান্ধীর “অভ্যন্তর” দেখতে পেরেছিলেন। তিনি গান্ধীর বিরুদ্ধে আজীবন “অর্থডক্স বর্ণাশ্রম ধর্মের” সমর্থক থাকার অভিযোগ তোলেন, যদিও গান্ধী নিজেকে ছুঁত-অছুঁত প্রথার বিরোধী হিসেবে পরিচয় দিতেন।
“অচ্ছুত” সম্প্রদায়ের মর্যাদা ছিল গান্ধী ও আম্বেদকরের মধ্যে প্রধান মতবিরোধের বিষয়। আম্বেদকরের দৃষ্টিতে এটি মূলত একটি রাজনৈতিক প্রশ্ন, যেখানে তিনি সমস্যাটির সামাজিক দিককে খুব একটা গুরুত্ব দেননি। তাঁর মতে, “অচ্ছুতরা স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছে যে মন্দিরে যাওয়া তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়।” বরং, তাদের জন্য “সমান মর্যাদা” ও “উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ” অনেক বেশি জরুরি। তাতে তাদের “গৌরব” যেমন বৃদ্ধি পাবে, তেমনি “কৌশলগত অবস্থান” লাভও করা সম্ভব হবে বলে তিনি মনে করতেন।
লন্ডনে দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকের পর রামসে ম্যাকডোনাল্ড সরকার “কমিউনাল অ্যাওয়ার্ড” ঘোষণা করলে গান্ধী অনশন শুরু করেন। গান্ধীর এই অনশনের চাপে আম্বেদকর সমঝোতার টেবিলে বসতে রাজি হন, এবং “পুনা চুক্তি” নামে পরিচিত এক মধ্যস্থতা-চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। গান্ধী প্রাথমিক পর্যায়ে পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী মেনে নেন, অন্যদিকে আম্বেদকর সম্মত হন যে বিদ্বেষাপন্ন “অচ্ছুত” জাতিগোষ্ঠীগুলিকে সংরক্ষিত আসন দেওয়া হবে যৌথ নির্বাচকমণ্ডলীর অধীনে। এজন্য সংশ্লিষ্ট জাতিগোষ্ঠীগুলিকে একটি “তালিকা” করে অন্তর্ভুক্ত করার দরকার হয়। গান্ধী এই জাতিগোষ্ঠীগুলিকে “হরিজন” বলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আম্বেদকর আপত্তি জানান এবং বলেন, যেহেতু তারা একটি নির্দিষ্ট তালিকায় অর্ন্তভুক্ত হচ্ছে, তাদের “তফসিলি জাতি” বলা হোক। স্বাধীনতার পর “তফসিলি জাতি” ভারতীয় সংবিধানের একটি অপরিহার্য অংশ হয়ে ওঠে। আম্বেদকর পুরোপুরি সন্তুষ্ট ছিলেন না, তবে তিনি এটিকে হিন্দু বর্ণব্যবস্থায় বড় ধরনের সংস্কারের পূর্বে প্রথম বড় রাজনৈতিক ছাড় হিসেবে মেনে নেন।
গান্ধী-আম্বেদকরের মতবিরোধ তাদের স্বাধীনতা-দর্শনকেই কেন্দ্র করে। গান্ধীর কাছে স্বরাজ ছিল ব্যক্তি-স্তরের নৈতিক ও নীতিগত স্বাধীনতা। অন্যদিকে আম্বেদকর মূলত “অচ্ছুত” সম্প্রদায়ের দুঃখ-কষ্ট লাঘবে রাজনৈতিক পদক্ষেপের ওপর জোর দিয়েছেন, আর গান্ধী সামাজিক ও আত্মিক সংশোধনের কথা বলেছেন। সত্যি যে গান্ধী হিন্দু বর্ণাশ্রম ব্যবস্থার প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন, কিন্তু নিজের অভিজ্ঞতার আলোকেই তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টায়। ১৯৩৬ সালে হারিজন পত্রিকায়—যখন আম্বেদকরের অনন্য গ্রন্থ Annihilation of Caste প্রকাশের ঠিক এক বছর বাকি—গান্ধী লিখেছিলেন, “বর্ণব্যবস্থাকে বিদায় জানাতেই হবে।”
তবে এই মতপার্থক্যের বাইরে, দুই মহান নেতার চিন্তায় গভীর মিল ছিল। এর সবচেয়ে স্পষ্ট নমুনা পাওয়া যায় ১৯৫৬ সালে আম্বেদকরের রচনা ও বক্তৃতায়—যে বছরটি তাঁর জীবনের সবচেয়ে কর্মচাঞ্চল্যময় ছিল। অসুস্থতা সত্ত্বেও তিনি “বুদ্ধ অর কার্ল মার্কস” শীর্ষক বিখ্যাত প্রবন্ধটি সম্পন্ন করেন, যেখানে তিনি বস্তুনিষ্ঠভাবে সাম্যবাদকে বিশ্লেষণ করেন। এরপর কাঠমান্ডুতে “বৌদ্ধইজম অ্যান্ড কমিউনিজম” শীর্ষক বক্তব্য রাখেন। সেই চিন্তার চূড়ান্ত রূপ হয় “দ্য বুদ্ধ অ্যান্ড হিজ ধম্ম” গ্রন্থে, যা পরে মরণোত্তরভাবে প্রকাশিত হয়। তিনি ওই বছরের অক্টোবরে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন এবং ৬ ডিসেম্বর শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
কমিউনিজম ও সহিংসতার প্রশ্নে আম্বেদকর ও গান্ধী একই মত পোষণ করতেন। গান্ধী “বলশেভিজম”-এর সমালোচনা করে বলেছিলেন যে সাফল্যের জন্য “সহিংস শর্ট-কাট” মানবকল্যাণের জন্য ক্ষতিকর। আম্বেদকরও সাম্যবাদের নিন্দা করে বলেন যে তারা “বিভ্রান্তিকর উপায়ে দ্রুত ফল পেতে চায়।” দুজনের বক্তব্যের ভাষাগত সাদৃশ্য স্পষ্ট।
গান্ধীর কাছে “উদ্দেশ্য ও পদ্ধতি” ছিল স্বরাজ ধারণার গুরুত্বপূর্ণ অংশ; তিনি “উদ্দেশ্য সাধনে যে-কোনো পথ গ্রহণীয়”—এই ধারণা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। আম্বেদকরও তাঁর শেষ দিকের রচনাগুলিতে শুদ্ধ পদ্ধতির পক্ষে প্রবল সওয়াল করেন, বুদ্ধ ও কার্ল মার্কসের মতবাদ বিশ্লেষণ করে দেখান যে, উভয়ের লক্ষ্য এক হলেও কর্মপদ্ধতিতে মৌলিক পার্থক্য ছিল। তিনি প্রশ্ন তোলেন, “কার পন্থা দীর্ঘমেয়াদে উত্তম ও স্থায়ী? কমিউনিস্টরা কি বলতে পারবে যে তাদের মহৎ লক্ষ্য অর্জনে তারা অন্য কোনো মহৎ লক্ষ্যকে বিনষ্ট করেনি?”
১৯৩০-এর দশকে মতবিরোধ তুঙ্গে থাকাকালে আম্বেদকর গান্ধীর সত্য ও অহিংসার নৈতিক রাজনীতিকে “শূন্যগর্ভ ও উচ্চকণ্ঠ” এবং “ভারতের রাজনীতিতে সবচেয়ে অমুখফুঁট ও অসৎ পন্থা” বলে কঠোর ভাষায় আক্রমণ করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনিও ব্যক্তি-স্তরের নৈতিকতার গুরুত্ব অনুধাবন করেন। তিনি বুদ্ধকে উদ্ধৃত করে বলেন, “সব খারাপ চিন্তা দূর করো। অন্যরা ক্ষতিকর হতে পারে, কিন্তু তুমি হবে নির্বিষ। অন্যরা হত্যা করতে পারে, কিন্তু তুমি কখনো হত্যা করবে না… অন্যরা জড়তায় আচ্ছন্ন হতে পারে, কিন্তু তুমি সেখান থেকে বেরিয়ে আসবে। অন্যরা অহংকারে মত্ত হতে পারে, কিন্তু তুমি হবে বিনয়ী।” এর মধ্যেই তো গান্ধীর আদর্শের সুর স্পষ্ট শোনা যায়। এগুলো সেই আত্মমুক্তির স্বরাজ, যা আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের সকল মহান নেতা—গান্ধী ও আম্বেদকরসহ—অতিশয় গুরুত্ব দিয়েছিলেন। শুধু পার্থক্য এই যে, গান্ধী, অরবিন্দ ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই আদর্শগুলির অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন হিন্দু দর্শন থেকে, আর আম্বেদকর সেই একই আদর্শ পেয়েছিলেন বৌদ্ধ ধর্মদর্শন থেকে।
লেখক: রাম মাধব , ভারতীয় রাজনীতিবিদ, সদস্য, বোর্ড অফ গভর্নর্স, ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন