সারাক্ষণ রিপোর্ট
আইএমএফ ঋণ ও বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি
২০২৩ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ আইএমএফ-এর কাছ থেকে ৪৭০ কোটি ডলারের একটি ঋণ কর্মসূচি গ্রহণ করে। এর বিনিময়ে বেশ কয়েকটি অর্থনৈতিক সংস্কার ও শর্ত পূরণের বাধ্যবাধকতা ছিল। তবে এসব শর্ত—বিশেষ করে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি, বিনিময় হারকে বাজারভিত্তিক করা, এবং বৈদেশিক মুদ্রার নিট রিজার্ভ ধরে রাখা—ব্যাপারে বাংলাদেশ এখনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখাতে পারেনি।
চতুর্থ রিভিউয়ে আইএমএফ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি কঠোর, ফলে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি—মোট ১.৩ বিলিয়ন ডলার—আটকে যেতে পারে বলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
আইএমএফ মিশন ও চলমান আলোচনা
আইএমএফ প্রতিনিধিদল ৬ এপ্রিল থেকে ঢাকায় অবস্থান করছে এবং অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগসহ বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছে। ১৭ এপ্রিল সফরের শেষ দিনে চূড়ান্ত আলোচনার কথা রয়েছে।
মূল উদ্বেগ দুইটি—১) লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় হয়নি, এবং ২) সরকার এখনও বিনিময় হার বাজারে ছেড়ে দিতে অনিচুক।
রাজস্ব ঘাটতি ও চাপ
চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু ৯ মাসে এনবিআর আদায় করেছে মাত্র ২ লাখ ৫২ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ বাকি ৩ মাসে প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা সংগ্রহ করতে হবে—যা অনেকটাই অসম্ভব।
এই প্রেক্ষাপটে আইএমএফ কর কাঠামো সংস্কারের ওপর জোর দিয়েছে। তারা টার্নওভার কর, ন্যূনতম কর, একক ভ্যাট হার বৃদ্ধি এবং কর অব্যাহতি হ্রাসের পরামর্শ দিয়েছে।
বিনিময় হারের জটিলতা
আইএমএফের জোরালো দাবি—বিনিময় হারকে পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করতে হবে। সরকার আশঙ্কা করছে, এতে ডলারের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে। ফলে সরকার এখনো বাজার ছেড়ে দিতে রাজি নয়।
২০২৩ সালে চালু হওয়া ক্রলিং পেগ পদ্ধতিও কাঙ্ক্ষিত ফল দেয়নি। বর্তমানে ডলার রেট নির্ধারিত হচ্ছে ব্যাংকগুলোর মধ্যে দরকষাকষির ভিত্তিতে, যা হলেও পুরোপুরি মুক্ত বাজার নয়।
আইএমএফ এখন বলছে, পরীক্ষামূলকভাবে হলেও পুরোপুরি বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালু করতে হবে। এর বিনিময়ে তারা অতিরিক্ত আর্থিক সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে।
সরকারের যুক্তি ও সময়ক্ষেপণ কৌশল
বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ড. হাবিবুর রহমান জানিয়েছেন, রেমিট্যান্স ও রফতানি বাড়ায় রিজার্ভে আগের মতো চাপ নেই। তাই এখনই বিনিময় হারে বড় ধরনের পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই।
সরকার মে মাস পর্যন্ত পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে চায়, যদিও আইএমএফ এখনই সিদ্ধান্ত চায়।
ঋণ আটকে গেলে সম্ভাব্য ঝুঁকি
আইএমএফ জুনে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি একসঙ্গে ছাড়ার প্রস্তাব তুলবে। কিন্তু শর্ত পূরণ না হলে এই কিস্তিগুলো আটকে যেতে পারে। এর ফলে অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকেও কয়েক বিলিয়ন ডলার সহায়তা ঝুলে যেতে পারে, এবং বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
সরকার তাই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আইএমএফকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
আইএমএফ ঋণের কাঠামো
২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি আইএমএফ বোর্ড সাত কিস্তিতে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচি অনুমোদন করে। এর মেয়াদ ৪২ মাস এবং গড় সুদের হার ২.২ শতাংশ।
উপসংহার
বর্তমান পরিস্থিতিতে আইএমএফ-এর শর্ত পূরণ না করলে কেবল ঋণ কিস্তি নয়, বরং দেশের অর্থনীতির ওপর আন্তর্জাতিক আস্থাও হ্রাস পেতে পারে। সরকারের জন্য এ মুহূর্তে কৌশলী সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও আন্তর্জাতিক চাপ মোকাবিলা করা অত্যন্ত জরুরি।
Leave a Reply