২০১৬ সালের ১ জুলাই ঢাকার গুলশান-২ এলাকার অভিজাত রেস্তোরাঁ হোলি আর্টিজান বেকারিতে নৃশংস জঙ্গি হামলা বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। সেই রাতে ২০ জন বিদেশি ও বাংলাদেশি জিম্মিকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। নিহতদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের একজন নাগরিকও ছিলেন।
হামলার প্রেক্ষাপট ও সেই রাতের ঘটনা
১ জুলাই ২০১৬ রাত আনুমানিক ৮টা ৪৫ মিনিটে গুলশানের হোলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় সশস্ত্র জঙ্গিরা ঢুকে পড়ে। বিদেশি নাগরিকদের একটি বড় দল সেখানে ডিনারের জন্য জড়ো হয়েছিলেন। হামলাকারীরা বেছে বেছে বিদেশি ও অমুসলিমদের জিম্মি করে। জিম্মি দশা সারা রাত চলে এবং ১২ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে নিরাপত্তা বাহিনী অভিযান চালাতে বাধ্য হয়।
পরদিন সকালে কমান্ডো অভিযান ‘থান্ডারবোল্ট’-এর মাধ্যমে জিম্মি সংকটের অবসান ঘটে। কিন্তু ততক্ষণে ২০ জন নিরপরাধ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। নিহতদের মধ্যে ইতালির ৯ জন, জাপানের ৭ জন, ভারতের ১ জন, বাংলাদেশের ২ জন নাগরিকের পাশাপাশি ছিলেন একজন মার্কিন নাগরিক।
নিহত মার্কিন নাগরিক: অবিনতা কবীর
অবিনতা কবীর বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন এবং ঢাকায় নিজের পরিবারের সাথে দেখা করতে এসেছিলেন। হামলার দিন তিনি তার বন্ধুদের সাথে হোলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় ছিলেন। সন্ত্রাসীরা তাঁকেও নির্মমভাবে হত্যা করে।
তার মৃত্যু যুক্তরাষ্ট্রে এবং বাংলাদেশে সমানভাবে শোকের ছায়া ফেলেছিল। এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস এবং যুক্তরাষ্ট্র সরকার তাঁর পরিবারের প্রতি গভীর শোক প্রকাশ করে।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিক্রিয়া
হোলি আর্টিজান হামলার পর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি গভীর শোক প্রকাশ করে বাংলাদেশের সরকার এবং জনগণের পাশে থাকার বার্তা দেন। হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি এক বিবৃতিতে বলেন:
“এই নৃশংস হামলা সমগ্র মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। আমরা নিহতদের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই এবং সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় বাংলাদেশের সাথে অংশীদারিত্ব আরও জোরদার করবো।”
যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া বার্নিকাট ঢাকায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাৎ করে শোক জ্ঞাপন করেন এবং তদন্তে সহায়তার আশ্বাস দেন।
মার্কিন প্রধান সংবাদমাধ্যমগুলোর কাভারেজ
হামলার রাত থেকেই মার্কিন গণমাধ্যমগুলো এটিকে বড় শিরোনাম করে প্রচার করে। হামলার আন্তর্জাতিক প্রভাব, বাংলাদেশে বিদেশি নাগরিকদের নিরাপত্তা এবং ইসলামিক স্টেটের (আইএস) দাবি করা দায়িত্বের প্রসঙ্গ তুলে ধরা হয়।
দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস
শিরোনাম: “ISIS Attack in Bangladesh Kills 20, Including American Student”
- প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়,অবিনতা কবীর ছিলেন দুই দেশীয় পরিচয় বহনকারী একজন শিক্ষার্থী।
- নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছিল:
“The death of Abinta Kabir, a Bangladeshi-American student, underscores the global reach of terrorism.”
- প্রতিবেদন বিশ্লেষণে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান উগ্রবাদী হুমকির কথাও উঠে আসে।
সিএনএন
শিরোনাম: “Bangladesh attack: American student among 20 hostages killed”
- সিএনএন টিভি এবং অনলাইন দুই মাধ্যমেই এই খবরটি‘ব্রেকিং নিউজ’ হিসেবে প্রচার করে।
- তারা অবিনতার পরিবারের বক্তব্যও তুলে ধরে। তার বিশ্ববিদ্যালয় এমোরির প্রেসিডেন্টের শোকবার্তা প্রচার করে,যেখানে লেখা ছিল:
“We are devastated by the loss of Abinta Kabir, a bright, compassionate student.”
- সিএনএন হামলাকে‘well-coordinated terrorist act’ হিসেবে বর্ণনা করে।
ওয়াশিংটন পোস্ট
শিরোনাম: “American among 20 dead in Bangladesh cafe siege claimed by ISIS”
- ওয়াশিংটন পোস্ট হামলার পেছনে আইএস-এর দায় স্বীকারের ঘোষণা এবং বাংলাদেশ সরকারের জবাবদিহিতা তুলে ধরে।
- নিহতদের মধ্যে মার্কিন নাগরিক থাকার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের প্রতিক্রিয়াও আলাদা করে বিশ্লেষণ করে।
- তাদের রিপোর্টে লেখা হয়েছিল:
“The death of an American in the attack raises questions about growing Islamist militancy in South Asia.”
এবিসি নিউজ
শিরোনাম: “American student killed in Bangladesh restaurant attack”
- এবিসি নিউজের টিভি রিপোর্টে অবিনতা কবীরের ছবি,পরিবার এবং এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের শোক অনুষ্ঠানও দেখানো হয়।
- হামলার আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা প্রভাব,দক্ষিণ এশিয়ায় সন্ত্রাসবাদের বিস্তার এবং বিদেশি নাগরিকদের ঝুঁকি নিয়ে বিশেষ আলোচনাও সম্প্রচার হয়।
হামলার আন্তর্জাতিক বার্তা
হোলি আর্টিজান হামলার পর বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ, উন্নয়ন সংস্থা, কূটনৈতিক উপস্থিতি নিয়ে বড় ধরনের নিরাপত্তা বিতর্ক শুরু হয়। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশ সরকারকে সন্ত্রাসবিরোধী তৎপরতা জোরদার করতে চাপ দেয়।
অবিনতা কবীরের মতো একজন তরুণ শিক্ষার্থীর মৃত্যু এই হামলার বেদনার দিকটিকে আরও তীব্র করে তোলে। মার্কিন প্রশাসন বারবার বাংলাদেশ সরকারের সাথে সন্ত্রাসবাদ দমনে যৌথ উদ্যোগের অঙ্গীকার করে।
হোলি আর্টিজান বেকারি হামলায় নিহত মার্কিন নাগরিক অবিনতা কবীরের মৃত্যু শুধু বাংলাদেশ নয়, যুক্তরাষ্ট্রের মনকেও গভীর শোক এবং আতঙ্কে আচ্ছন্ন করে। এই হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান সংবাদমাধ্যমগুলো হামলার আন্তর্জাতিক মাত্রা এবং বাংলাদেশে বিদেশি নাগরিকদের ঝুঁকি নতুন করে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরে।
আজও অবিনতা কবীরের স্মৃতি তার পরিবার, বন্ধু, এবং দুই দেশের মানুষের কাছে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মানবিক একতার প্রতীক হয়ে আছে।