নতুন মধ্যপ্রাচ্যের স্বপ্ন
আবারও বলা হচ্ছে, এক নতুন মধ্যপ্রাচ্য আসছে। গত মাসে যখন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়, তখন অনেকেই ভাবলেন এর প্রভাব হবে বিশাল। সমালোচকরা আশঙ্কা করেছিলেন যে পুরো মধ্যপ্রাচ্য একটি বড় যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে। অন্তত এখন পর্যন্ত সেই ভয় সত্যি হয়নি। ইরান কেবল প্রতীকী পাল্টা হামলা করেছে, এরপরই ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি হয়।
যুদ্ধ শেষ হলেও উত্তেজনা কাটেনি
১২ দিনের যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর, হামলার সমর্থকরা বলছেন এর ফলে অঞ্চলটি বদলে যাবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, এখন আরও অনেক আরব দেশ ২০২০ সালের আব্রাহাম চুক্তিতে যোগ দেবে। কারণ, তার ভাষায়, “ইরানই ছিল প্রধান সমস্যা।”
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুও বলছেন, ইরানে “জয়” পাওয়ার ফলে শান্তিচুক্তি আরও বিস্তৃত করার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
কিন্তু আরব রাজধানীগুলোয় তেমন উচ্ছ্বাস নেই—এমনকি যারা ইরানকে শত্রু মনে করে তারাও দ্বিধায়। তাদের আশঙ্কা, এই যুদ্ধ কোনো বড় পরিবর্তন আনেনি, বরং সমস্যার সমাধানকে ঝুলিয়ে রেখেছে।
সিরিয়ার সম্ভাব্য চুক্তি
ট্রাম্পের আশা একেবারেই অবাস্তব নয়। সম্ভাবনা আছে যে শিগগিরই সিরিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা ইসরায়েলের সঙ্গে একটি চুক্তি করবেন।
তবে এর সাথে ইরান যুদ্ধে কিছু করার নেই। শারা চান, ইসরায়েল যেন তার দেশে হামলা বন্ধ করে। বাশার আল-আসাদের পতনের পর এ হামলা নিয়মিত হয়েছে। এছাড়া, তিনি পশ্চিমাদের চোখে নিজের অবস্থান মজবুত করতে চান।
লেবাননে জটিল অবস্থা
লেবাননের পরিস্থিতি আরও জটিল। ইরান-সমর্থিত শিয়া গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ গত বছর ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত টম ব্যারাক এখন ট্রাম্পের দূত হিসেবে লেভান্টে কাজ করছেন। গত মাসে তিনি লেবানন সরকারকে জানিয়েছেন—নভেম্বরের মধ্যে হিজবুল্লাহকে অস্ত্র জমা দিতে হবে।
হিজবুল্লাহর ওপর চাপ বাড়ছেই। তারা নিরস্ত্র না হলে যুদ্ধের পর পুনর্গঠন-সহায়তার জন্য কেউ অর্থ দেবে না। ইসরায়েলও বোমাবর্ষণ চালিয়ে যাবে এবং দক্ষিণ লেবাননের পাঁচটি পাহাড়ের শীর্ষ দখল করে রাখবে।
এদিকে ইরানও হয়তো এখন কম অর্থ ও অস্ত্র পাঠাতে পারবে, কারণ তাদের নিজেদের প্রতিরক্ষা মজবুত করা দরকার।
হিজবুল্লাহর ভবিষ্যত
তবুও এটা নিশ্চিত নয় যে হিজবুল্লাহ নিরস্ত্র হবে। গোষ্ঠীর ভেতর অনেকেই সময় ক্ষেপণের পক্ষে, আশা করে পরিস্থিতি তাদের পক্ষে যাবে।
এমনকি নিরস্ত্র হলেও তারা লেবাননের রাজনীতিতে প্রভাবশালী থাকবে, শিয়াদের প্রধান প্রতিনিধি হিসেবে।
তাদের অনেকেই ইসরায়েলের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্কের বিরোধিতা করবে। ফলে লেবাননের সঙ্গে ইসরায়েলের কোনো চুক্তি শিগগিরই হচ্ছে না।
ইয়েমেনে নতুন সমীকরণ
ইরানের মদদপুষ্ট হুথি বিদ্রোহীদের নিয়েও নতুন আলোচনা শুরু হয়েছে। ইয়েমেনের কিছু রাজনীতিক ভাবছেন, ইরান দুর্বল হওয়ায় তাদের প্রতি সমর্থন কমাতে হবে।
তারা চাইছেন এই সুযোগে হুথিদের বিরুদ্ধে নতুন অভিযান শুরু করতে।
সৌদি আরবের সতর্কতা
তবে সৌদি আরব, যারা আগে হুথিদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে, নতুন করে যুদ্ধ শুরুর বিষয়ে সতর্ক। তারা আশঙ্কা করে যে এতে আবার সৌদি ভূখণ্ডে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরু হতে পারে।
হুথিদের জন্য ইরানের সমর্থন কমা একটা ধাক্কা হবে ঠিকই, কিন্তু তারা এখনো কয়েক হাজার যোদ্ধা, স্বনির্ভর আয় এবং নিজস্ব ক্ষেপণাস্ত্র-ড্রোন উৎপাদন সক্ষমতা ধরে রেখেছে।
পারমাণবিক উত্তেজনা ও উপসাগরীয় উদ্বেগ
সৌদি আরব ও উপসাগরীয় দেশগুলো আরও উদ্বিগ্ন—ইসরায়েল বা আমেরিকা ভবিষ্যতে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় আবার হামলা চালাতে পারে।
নতুন কোনো পারমাণবিক চুক্তি ছাড়া এই হামলা প্রায় অনিবার্য মনে হচ্ছে। ট্রাম্প প্রশাসনও নতুন চুক্তি করতে খুব একটা আগ্রহ বা দক্ষতা দেখায়নি।
অন্যদিকে ইরানও কোনো ছাড় দিতে রাজি নয়। ২ জুলাই প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান জাতিসংঘের পরমাণু পর্যবেক্ষক সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতা স্থগিত করার নির্দেশ দিয়েছেন।
ইরানের প্রতিরক্ষা কৌশল
ইরান ভাবতে পারে, আমেরিকা ও ইসরায়েলকে ঠেকাতে তাদের আরও উন্নত ও নির্ভুল ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র দরকার। তবে তারা এও ভাবতে পারে যে দূরের শত্রুদের ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে আটকানো কঠিন।
উপসাগরীয় কূটনীতিকরা উত্তর কোরিয়ার উদাহরণ টানেন—যেখানে কিম পরিবারের সরকার সিউলের দিকে প্রচুর কামান ও স্বল্প-পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র তাক করে আমেরিকাকে হামলা থেকে বিরত রেখেছে।
উপসাগরীয় শাসকরা আশঙ্কা করছেন, ইরানও এমন কৌশল নেবে—তাদের ক্ষেপণাস্ত্র দমাম, দোহা, দুবাইয়ের দিকে তাক করবে, কিন্তু তেল আবিবের দিকে নয়।
ট্রাম্পের বড় লক্ষ্য: সৌদি স্বীকৃতি
ডোনাল্ড ট্রাম্পের বড় আশা হলো সৌদি আরবকে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিতে রাজি করানো। কারণ সৌদি রাজি হলে আরও অনেক আরব ও মুসলিম দেশও এগোবে।
কিন্তু এক কোণায় আটকে যাওয়া, একঘরে হয়ে যাওয়া ইরানের ভয় সৌদিদের এই সিদ্ধান্তে শিথিলতা আনতে পারে।
অবশেষে—গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা
দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমা নীতিনির্ধারকরা ভাবতেন, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বই মধ্যপ্রাচ্যের সব সমস্যার মূল। এই “লিঙ্কেজ” ধারণা ছিল—যদি এই দ্বন্দ্ব মেটে, অন্য সমস্যাগুলোরও সমাধান হবে।
ইসরায়েল বা ট্রাম্প শিবিরের রক্ষণশীলরা একে কখনোই পছন্দ করেননি।
কিন্তু এখন তারাই বলছেন, ইরানের সঙ্গে এই সংক্ষিপ্ত যুদ্ধ নাকি পুরো অঞ্চলে শান্তির রাস্তা খুলে দিয়েছে—যদিও রাজনৈতিক ও সামরিক বাস্তবতায় সেটা আদৌ সহজ নয়।
অবশেষে, নতুন এই “লিঙ্কেজ” তত্ত্বও হয়তো ততটাই ভুল প্রমাণিত হবে যতটা একসময় তারা সমালোচনা করতেন।