বাংলাদেশের অর্থনীতির দ্রুত অগ্রযাত্রার মাঝেও গত ১১ মাসে বৈদেশিক বিনিয়োগ প্রায় স্তব্ধ হয়ে পড়েছে—নীতিনির্ধারক ও ব্যবসায়ী মহলে যা গভীর উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। নিচে প্রধান কারণগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো।
১. রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা
জাতীয় নির্বাচন ঘিরে সহিংসতা, অবরোধ ও হরতাল বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকি বাড়িয়েছে। নির্বাচন-পরবর্তী বৈধতা বিতর্ক আস্থা আরও ক্ষুণ্ন করেছে। দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের পূর্বশর্ত হলো স্থিতিশীল শাসনব্যবস্থা।
২. ডলার সংকট ও রিজার্ভের চাপ
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ কমে যাওয়ায় ডলার বাজার অস্থির। এলসি খুলতে, কাঁচামাল আমদানি করতে কিংবা মুনাফা বিদেশে পাঠাতে বাড়তি জটিলতা তৈরি হয়েছে। বিনিয়োগকারীরা বৈদেশিক মুদ্রা রূপান্তর নিয়ে নিশ্চিত হতে পারছেন না।
৩. আমলাতান্ত্রিক জট ও দুর্নীতি
বিনিয়োগবান্ধব নীতির ঘোষণা থাকলেও বাস্তবে কোম্পানি নিবন্ধন, ভূমি অনুমোদন ও কর সুবিধা পেতে দেরি ও ঘুষের অভিযোগ প্রবল। নির্দিষ্ট সময়সীমায় কাজ শেষ হওয়া এখনও দুর্লভ।
৪. অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা
বিদ্যুৎ ও সড়কে অগ্রগতি সত্ত্বেও শিল্প জোনের সংখ্যা ও কার্যকারিতা যথেষ্ট নয়। লজিস্টিক ব্যয় দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অন্যতম বেশি। রেলপথ, সমুদ্রবন্দর ও অভ্যন্তরীণ শিপিং খাতে আধুনিকীকরণ অপর্যাপ্ত।
৫. ঋণপরিশোধের ঝুঁকি
বড় অবকাঠামো প্রকল্পের বৈদেশিক ঋণ শোধের সময় ঘনিয়ে আসছে। ডলার সংকট ও ঋণসেবা-চাপ বাজেট ঘাটতি বাড়াতে পারে—এতে বিনিয়োগকারীদের সতর্কতা বেড়েছে।
৬. আইনি ও নীতিগত অনিশ্চয়তা
বিনিয়োগ আইন থাকলেও প্রয়োগে স্বচ্ছতা অপ্রতুল, নীতির ধারাবাহিকতাও নেই। করছাড়, প্রণোদনা ও বিদেশি অংশীদারিত্বের শর্ত প্রায়ই বদলে যায়, যা দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্তকে জটিল করে তোলে।
৭. বৈশ্বিক অর্থনীতির চাপ
বিশ্বব্যাপী উচ্চ সুদের হার ও মন্দার শঙ্কায় বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকি কম নিয়েছেন। চীনের Belt and Road Initiative-এও পুনর্মূল্যায়নের ধাক্কা লেগেছে, ফলে নতুন প্রকল্পে গতি শ্লথ।
৮. রপ্তানি আয়ের অনিশ্চয়তা
পোশাকনির্ভর রপ্তানি পশ্চিমা বাজারের মন্দায় ধাক্কা খেয়েছে। আয় কাঠামোর বৈচিত্র্য সীমিত, ফলে বাজারঝুঁকি বেশি—যা বিদেশি বিনিয়োগে অনীহা বাড়ায়।
৯. দক্ষ মানবসম্পদের ঘাটতি
শিক্ষিত জনশক্তি থাকলেও কারিগরি ও প্রযুক্তিনির্ভর দক্ষতা অপর্যাপ্ত। বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে অতিরিক্ত প্রশিক্ষণ ব্যয় মাথায় রাখতে হয়।
১০. সমন্বয়হীন নীতিনির্ধারণ
অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (BIDA) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে সমন্বয় দুর্বল। সিদ্ধান্তহীনতা ও নীতির অসঙ্গতি বিনিয়োগকারীদের আস্থায় আঘাত হানে।
কী করা জরুরি
- স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করা
- ডলার বাজারে স্বচ্ছতা ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা
- আমলাতান্ত্রিক ধাপ ডিজিটালাইজ ও দুর্নীতি হ্রাস করা
- শিল্প জোন ও অবকাঠামো বাস্তব সক্ষমতা বাড়ানো
- কারিগরি শিক্ষা ও দক্ষতা প্রসারিত করা
- নীতির ধারাবাহিকতা ও বিনিয়োগ-সুরক্ষা আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করা
বাংলাদেশের অর্থনীতির মৌলভিত্তি শক্তিশালী; সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিলে বৈদেশিক বিনিয়োগ ফের গতি পাবে। সংস্কারের গতি যত দ্রুত হবে, আস্থা তত দ্রুত ফিরে আসবে।