বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতির একটি ঐতিহ্যবাহী ও গুরুত্বপূর্ণ খাত হলো পান পাতা চাষ। সুগন্ধি ও কোমল এই পাতার জন্য শুধু দেশে নয়—বিদেশেও রয়েছে সমৃদ্ধ বাজার। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে প্রবাসী বাংলাদেশি ও ভারতীয়দের কাছে পান পাতার চাহিদা বিপুল। অথচ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে পান চাষ দ্রুত কমেছে।
কোন কোন জেলায় পান উৎপাদন হয়
বাংলাদেশের কয়েকটি জেলা ঐতিহাসিকভাবে পান চাষের জন্য প্রসিদ্ধ। প্রধান উৎপাদক জেলা ও উপজেলাগুলো হলো—
- যশোর (বাঘারপাড়া, ঝিকরগাছা)
- ঝিনাইদহ (শৈলকূপা)
- মাগুরা
- কুষ্টিয়া
- নড়াইল
- মেহেরপুর
- খুলনা (দিঘলিয়া, তেরখাদা)
- চুয়াডাঙ্গা
- বরিশাল অঞ্চলের কয়েকটি এলাকা
- কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সীমিত পরিসরে
যশোর–ঝিনাইদহ অঞ্চল গড়ে তুলেছে দেশের ‘পানের বেল্ট’। এ অঞ্চলের দোঁআশ মাটি, ছায়াময় পরিবেশ ও পর্যাপ্ত আর্দ্রতা পান গাছের বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত উপযোগী।
উৎপাদন ও বৈদেশিক মুদ্রা
প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ কেজি পান পাতা মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় রপ্তানি হয়। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, ওমান ও মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের পান পাতা বিশেষ জনপ্রিয়। বেসরকারি হিসাব অনুযায়ী, বছরে প্রায় ৪০–৫০ কোটি টাকার সমপরিমাণ পান পাতা রপ্তানি হয়ে থাকে; বৈদেশিক মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় সাত–আট মিলিয়ন ডলার।
পান চাষ কীভাবে বাড়ানো যাবে
পান চাষ শ্রমনির্ভর ও দক্ষতাভিত্তিক। টিকে থাকতে এবং বিস্তার ঘটাতে প্রয়োজন—
উন্নত বরজ প্রযুক্তি
-
- সিমেন্ট বা টিনের ছাউনি দিয়ে আধুনিক বরজ তৈরি করে রোগ-ব্যাধি কমানো
- সেচ ও ছায়া নিয়ন্ত্রণে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি
রোগ-ব্যাধি ব্যবস্থাপনা
-
- পাতার দাগ ও শিকড় পচা রোগে দ্রুত সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহায়তা
- চাষিদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ
স্বল্প সুদে ঋণ
-
- ক্ষুদ্র-চাষি–বান্ধব সহজ শর্তের কৃষিঋণ
- পুনঃবিনিয়োগে প্রণোদনা
রপ্তানি সহায়তা
-
- দ্রুত রপ্তানি অনুমোদন
- এয়ার কার্গো ভর্তুকি
- আন্তর্জাতিক মানের সার্টিফিকেশন সেবা
মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে অংশ বাড়ানোর কৌশল
- গুণগত মান বজায়—রোগমুক্ত, সতেজ ও সুগন্ধি পাতা এবং স্বাস্থ্যসম্মত মোড়ক
- দ্রুত সরবরাহ—ঢাকা ও যশোর বিমানবন্দর থেকে ফ্রেশ এয়ার কার্গো সেবা
- মার্কেটিং ও ব্র্যান্ডিং—‘বাংলাদেশি সুগন্ধি পান’ নামে ঐতিহ্যঘন ব্র্যান্ড প্রচার
- চুক্তিভিত্তিক উৎপাদন—রপ্তানিকারক ও চাষির মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি
পান চাষ কেন কমছে
ভূমি সংকট
-
- জমির দাম বেড়ে যাওয়া
- বরজ অন্য ফসলের তুলনায় বেশি জায়গা ও পরিচর্যা দাবি করে
পরিবেশগত ঝুঁকি
-
- খরা, বন্যা ও নদীভাঙন
- জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অনিশ্চয়তা
অর্থনৈতিক চাপ
-
- শ্রমিক মজুরি বৃদ্ধি
- পরিবারগুলোর বিকল্প আয়ের খোঁজে অন্য পেশায় ঝুঁকে পড়া
দক্ষ চাষি সম্প্রদায়ের দেশত্যাগ
-
- শত শত বছর ধরে পান চাষে পারদর্শী হিন্দু পরিবারগুলোর অনেকেই ভারতে চলে যাচ্ছেন
- এতে দক্ষ শ্রমশক্তি ও প্রজন্মগত জ্ঞান হারিয়ে যাচ্ছে
হিন্দু চাষি সম্প্রদায়ের অবদান ও দেশত্যাগের প্রভাব
যশোর–ঝিনাইদহ অঞ্চলের হিন্দু কৃষকেরাই দীর্ঘদিন ধরে—
- পানের উপযোগী জাত নির্বাচন ও সংরক্ষণ
- বরজ তৈরি, রোপণ, ছাঁটাই ও রোগ দমন
- দালালমুক্ত বাজার ব্যবস্থাপনা
তাদের দেশত্যাগের ফলে শুধু জমিই খালি হয় না—প্রজন্মের সঞ্চিত অভিজ্ঞতাও হারিয়ে যায়। নতুন প্রজন্ম যথাযথ প্রশিক্ষণ ছাড়া পান চাষে আগ্রহ হারায়; বরজ নষ্ট হয়, উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। ফলে জাতীয় উৎপাদন কমছে।
পান পাতা বাংলাদেশের জন্য শুধু একটি অর্থকরী ফসল নয়—একটি ঐতিহ্য ও সম্ভাবনা। আধুনিক প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ, সহজ ঋণ, রপ্তানি প্রণোদনা ও ঐতিহ্যবাহী চাষি সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ছাড়া এই শিল্প টেকসই হবে না। সঠিক নীতি ও সুষ্ঠু উদ্যোগের মাধ্যমে বাংলাদেশ আবারও মধ্যপ্রাচ্যসহ বৈশ্বিক বাজারে শীর্ষে উঠতে পারে।