এখনই তো শিল্প কারখানায় গ্যাসের চাপ নেই, তারা বিকল্পভাবে উৎপাদন ঠিক রেখেছেন৷ গ্যাসের সরবরাহ বৃদ্ধিতে কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন কিনা? জবাবে মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, ‘‘সেই কারণেই তো মূল্যবৃদ্ধি৷ আমরা পাইপলাইনে গ্যাসের সরবরাহ বৃদ্ধির চেষ্টা করছি৷ এখন আমাদের গ্যাসের চাহিদা ৪ হাজার এমএমসিএফডি (মিলিয়ন স্ট্যান্ডার্ড কিউবিক ফিট পার ডে) অর্থাৎ ৪০০ কোটি ঘনফুট৷ কিন্তু দিতে পারি ২ হাজার ৮০০ থেকে ৯০০ এমএমসিএফডি (২৮০-২৯০ কোটি ঘনফুট)৷ ফলে এক হাজারেও বেশি ঘাটতি রয়েছে৷ সেটা তো পূরণ করতে হবে৷ একটা জিনিস বুঝতে হবে, যেখান থেকে গ্যাসের পাইপ লাইন শুরু হয়, তার শেষ মাথায় গিয়ে কিন্তু চাপ কমে যায়৷ কিন্তু সরবরাহ বাড়াতে পারলে এটা ঠিক রাখা সম্ভব৷ আমরা সেই চেষ্টাটাই করছি৷”
গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ব্যাপারে ভোক্তা ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের তীব্র আপত্তি ছিল৷ তারপরও রবিবার বাড়ানো হয়েছে গ্যাসের দাম৷ নতুন শিল্পের জন্য গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে ৩৩ শতাংশ৷ প্রতি ইউনিটে ১০ টাকা বাড়তি দিতে হবে তাদের৷ পুরোনো শিল্পকারখানায় অনুমোদিত লোডের বাইরে অতিরিক্ত ব্যবহারে দিতে হবে বাড়তি দাম৷ প্রতিশ্রুত শিল্প গ্রাহকদের অনুমোদিত লোডের ৫০ শতাংশের বেশি ব্যবহারে বাড়তি দাম দিতে হবে৷
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ বলেন, ‘‘দেশের গ্যাস কমার সঙ্গে সঙ্গে এলএনজি আমদানি বাড়তে থাকে৷ এলএনজির বাড়তি দাম দিতে গিয়ে চাপে পড়ে পেট্রোবাংলা৷ তারা ১৫০ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছিল৷”
তবে গণশুনানিতে বেশিরভাগ অংশগ্রহণকারী দাম বাড়ানো নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিল৷ কিসের ভিত্তিতে দাম বাড়ানো হলো? এমন প্রশ্নের জবাবে বিইআরসির চেয়ারম্যান বলেন, রাজস্ব চাহিদা ধরলে দাম অনেক বেশি বাড়াতে হতো৷ তাই ভোক্তার জন্য সহনীয় রাখতে ৩৩ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে৷ এ ক্ষেত্রে ভর্তুকিরও হিসাব করা হয়নি৷ রাজস্ব চাহিদা যাচাই ছাড়া এভাবে মূল্যবৃদ্ধি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের পরামর্শে করা হয়েছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, মন্ত্রণালয়ের প্রেসক্রিপশনে করা হয়নি৷
নতুন ও পুরোনো শিল্পে আলাদা দাম রেখে যে বৈষম্য তৈরি করা হয়েছে, এটা আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে চেয়ারম্যান বলেন, বিইআরসির আইনি আওতার মধ্যে থেকেই দাম নির্ধারণ করা হয়েছে৷ এতে নতুন বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিনিয়োগ কমার বিষয়টা এখনই বলা যাবে না৷ নতুন বিনিয়োগে প্রভাব পড়বে কি না, তা নজরে রাখা হবে৷ নতুন যারা আসবে, তারা যদি দেখে তাদের পোষাবে, তাহলে তারা আসবে৷ তারা বিকল্প জ্বালানিও ব্যবহার করতে পারে৷
সরকারের নীতিনির্ধারকরা দেশের কারখানা বন্ধ করে দেশটাকে আমদানি নির্ভর করতে চান বলে মনে করেন কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শামসুল আলম৷ ডিডাব্লিউকে তিনি বলেন, ‘‘কাদের পরামর্শে এটা করা হচ্ছে? যারা পরামর্শ দিচ্ছে তারাও জানেন এগুলো করলে ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যাবে৷ দেশটাকে আমদানি নির্ভর করা যাবে৷ গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে নতুন কারখানা তো হবেই না, পুরনো কারখানাগুলোও বন্ধ হয়ে যাবে৷ সরকার যেটা চাচ্ছে এলএনজির মূল্যের সঙ্গে সমন্বয় করতে৷ দেশে গ্যাস উৎপাদনের কোনো আগ্রহ নেই, আমদানি নির্ভর করতে পুরোপুরি এলএমজির উপর নির্ভরশীল করা চেষ্টা হচ্ছে৷ আমরা গণশুনানিতে সরকারের এই সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে যুক্তি তুলে ধরেছিলাম৷ কিন্তু তারা কিছুই শোনেনি৷”
বিইআরসির আদেশ বলছে, শিল্পে উৎপাদিত নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্রে (ক্যাপটিভ) ব্যবহৃত গ্যাসের দাম ছিল ৩১ টাকা ৫০ পয়সা৷ এটি বেড়ে হয়েছে ৪২ টাকা৷ আর শিল্প সংযোগে গ্যাসের দাম ৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৪০ টাকা৷ নতুন এ দাম রোববার থেকেই কার্যকর হবে৷ ১৩ এপ্রিল এর পরে যত গ্যাস সংযোগ অনুমোদন করা হবে, তাদের বাড়তি দাম দিতে হবে৷ এর আগ পর্যন্ত যেসব সংযোগ আবেদনের চাহিদাপত্র ইস্যু করা হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশের বেশি ব্যবহারে নতুন দাম৷ আর পুরোনো শিল্প গ্রাহকেরা অনুমোদিত লোডের বাইরে যতটুকু ব্যবহার করবেন, ততটুকুর নতুন দাম দিতে হবে৷
এর আগে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের কথা বলে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে শিল্পে ১৫০ থেকে ১৭৮ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয় শিল্পে গ্যাসের দাম৷ শিল্প ও ক্যাপটিভে প্রতি ইউনিটের দাম ১১ টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয় ৩০ টাকা৷ পরে গত বছর ক্যাপটিভে দাম বাড়িয়ে করা হয় ৩১ টাকা ৫০ পয়সা৷ ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা বলছেন, যেখানে নতুন সরকার একদিকে সার্বিক বিনিয়োগ বাড়ানোর চেষ্টা করছে, ঠিক ওই সময় এ গ্যাসের দাম বাড়ানো ‘উল্টো নীতি’ নেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত৷ এতে নতুন বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়বে৷ এছাড়া প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআইও কমবে৷
নিট পোশাক রপ্তানিকারক ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘শিল্প গ্যাসের দাম আগে ৩০ টাকা ছিল, সেটাই নতুন শিল্প স্থাপনের জন্য চ্যালেঞ্জিং ছিল৷ এরপর আরও দাম বাড়ালে নতুন করে শিল্প স্থাপনের আগ্রহ হারাবেন বিনিয়োগকারীরা৷ সরকার একদিকে বিনিয়োগ বাড়ানোর কথা বলছে, আবার বিনিয়োগ ঝুঁকিতে ফেলার মতো সিদ্ধান্ত নিচ্ছে৷”
বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘যে-কোনোভাবেই খরচ বাড়ানো ওই খাতের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমিয়ে দেয়৷ পোশাক শিল্পের ক্ষেত্রেও অন্যান্য প্রতিযোগী দেশের চেয়ে আমরা পিছিয়ে যাব৷ গ্যাসের দাম বাড়ানো হলেও সরবরাহ তো ঠিক হবে না? এ সমস্যায় শিল্পগুলো অনেকদিন ধরে ভুগছে৷ পাশাপাশি বিশ্ব অর্থনীতিও অনেক সমস্যার মধ্যে রয়েছে৷ আমরাও যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কারোপ, ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট ইস্যু নিয়ে চিন্তিত৷ ঠিক সে সময় এ গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি সমন্বয় কঠিন হবে ব্যবসায়ীদের জন্য৷ বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি কারখানাগুলোর মালিকরা বড় সমস্যায় পড়বে ন৷”
Leave a Reply