সারাক্ষণ রিপোর্ট
চুক্তির পটভূমি
২০১৭ সালে ভারতের আদানি পাওয়ার ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে একটি দীর্ঘমেয়াদী বিদ্যুৎ সরবরাহ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির আওতায় আদানি পাওয়ার, ভারতের গোধরা অঞ্চলে তাদের ১৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র (গোধরা আল্ট্রা মেগা পাওয়ার প্রজেক্ট) থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে আসছে।
এই চুক্তির মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ঘাটতি পূরণ এবং শিল্পায়ন ও নগরায়নের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানো।
বিদ্যুৎ সরবরাহ ও বিলিং কাঠামো
চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশ আদানি পাওয়ার থেকে দৈনিক ভিত্তিতে নির্ধারিত ইউনিট হারে বিদ্যুৎ গ্রহণ করে এবং মাসিক বিল পরিশোধের শর্তে চুক্তিটি কার্যকর থাকে। মোট বিলিং পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার একটি বড় অংশ পরিশোধের বাইরে থেকে যায়।
বকেয়া সমস্যার শুরু
২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি ও কয়লার দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। বাংলাদেশ, যেহেতু বিদেশি মুদ্রার ঘাটতিতে পড়েছিল, তখন থেকেই আমদানি বিল পরিশোধে ব্যাঘাত ঘটে। এর পাশাপাশি, ২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা চরমে ওঠে—যার প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেন। এই অস্থিরতা সরকারি অর্থনৈতিক নীতিমালাতেও অনিশ্চয়তা তৈরি করে।
এই পরিস্থিতিতে আদানি পাওয়ার তাদের সরবরাহ অর্ধেকে নামিয়ে আনে, কারণ পাওনা অর্থ আদায়ে বিলম্ব হচ্ছিল।
সাম্প্রতিক উন্নয়ন
আদানি পাওয়ারের প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা দিলীপ ঝা এক পোস্ট-আর্নিংস কলে জানান যে, বাংলাদেশ এখন আবার পূর্ণ মাত্রায় বিদ্যুৎ গ্রহণ করছে এবং সাম্প্রতিক মাসগুলোতে পরিশোধের পরিমাণ মাসিক বিলের তুলনায় বেশি হচ্ছে। তিনি বলেন:
“আমরা বাংলাদেশে পূর্ণমাত্রায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করছি… বর্তমানে আমরা যে অর্থ পাচ্ছি তা মাসিক বিলিংয়ের চেয়েও বেশি। আমরা আশাবাদী যে শুধু চলতি মাসের বিল নয়, আগের বকেয়াগুলোও ধীরে ধীরে পরিশোধ হবে।”
এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ প্রায় ১.২ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছে, যদিও এখনও প্রায় ৯০০ মিলিয়ন ডলার বাকি রয়েছে।
কেন এই পরিশোধ গুরুত্বপূর্ণ?
১. আন্তর্জাতিক ঋণদাতাদের আস্থা রক্ষা: বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থার ঋণ সহায়তা নিচ্ছে। এসব ঋণচুক্তিতে দায়িত্বশীল পরিশোধ আচরণ গুরুত্বপূর্ণ।
২. বিদ্যুৎ সরবরাহ স্থিতিশীল রাখা: শিল্প উৎপাদন, কৃষি এবং আবাসিক ব্যবহারে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ বজায় রাখতে হলে আদানি পাওয়ারের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখা জরুরি।
৩. ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক: বাংলাদেশ-ভারত কৌশলগত সম্পর্কের অংশ হিসেবেও এ ধরনের চুক্তি কার্যকর রাখা গুরুত্বপূর্ণ।
ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ
- ডলার সংকট: বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ এখনও চাপের মুখে রয়েছে, যা বড় পরিসরে আমদানির ব্যয় বহনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে।
- বিদ্যুৎ খাতে পরিকল্পনার ঘাটতি: দীর্ঘমেয়াদি বিদ্যুৎ চাহিদা নিরূপণ এবং উৎপাদনের উৎস বহুমুখীকরণে বাংলাদেশ এখনও পিছিয়ে।
- নির্বাচনী ও নীতিনির্ধারণী অনিশ্চয়তা: ২০২৬ সালের সম্ভাব্য জাতীয় নির্বাচনের আগ পর্যন্ত রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বকেয়া পরিশোধে গতি শ্লথ করতে পারে।
উপসংহার
আদানি পাওয়ারের পাওনা পরিশোধে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অগ্রগতি যেমন ইতিবাচক ইঙ্গিত দেয়, তেমনি ভবিষ্যতে আর্থিক শৃঙ্খলা, আমদানি নীতির সুসংগঠিত বাস্তবায়ন এবং বিদ্যুৎ খাতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তা আরও জোরালোভাবে সামনে আসে।