০৭:৫৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫

রাস্তা কাঁপানো আন্দোলনের নায়ক এখন রাস্তার পারমিটে ব্যস্ত

  • Sarakhon Report
  • ০৪:০০:২৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ৪ মে ২০২৫
  • 68

সারাক্ষণ রিপোর্ট

২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে রাজপথ কাঁপানো কিছু ছাত্রনেতার মধ্যে অন্যতম ছিলেন মহিদুল ইসলাম দাউদ। তিতুমীর কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে তিনি গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক এবং একাধিক আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় মুখ। তবে সাম্প্রতিক সময়ে “চিত্রা পরিবহন লিমিটেড”-এর হয়ে আড়াইশ বাসের রুট পারমিট চেয়ে আবেদনের মাধ্যমে দাউদের নাম নতুন করে আলোচনায় এসেছে।

এই প্রতিবেদনে আমরা বিশ্লেষণ করব—ছাত্র রাজনীতি, আন্দোলন ও পরিচয় কীভাবে পরিবহন খাতে বাণিজ্যিক স্বার্থে রূপান্তরিত হচ্ছে এবং এর পেছনে কে বা কারা থাকছে।

পর্ব ১: চিত্রা পরিবহনএকটি নতুন কোম্পানির রহস্যময় উত্থান

২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে মাত্র ট্রেড লাইসেন্স পাওয়া চিত্রা পরিবহন লিমিটেড, ২০২৪ সালের মার্চেই রাজধানীর ব্যস্ততম ও লাভজনক দুইটি রুটের জন্য ২৪০টি বাস চালুর অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছে। এটি কোনো সাধারণ পরিবহন কোম্পানির আবির্ভাব নয়—এর পেছনে রয়েছে সংঘবদ্ধ ছাত্রনেতা, রাজনৈতিক সংযোগ এবং বিতর্কিত পরিচিতি।

কী কী রুটের জন্য আবেদন?

১. কালিয়াকৈর-নারায়ণগঞ্জ (গুলিস্তান, আজিমপুর, মাতুয়াইল, চাষাঢ়া সহ)
২. সাভার-গাজীপুর (মিরপুর-১, এয়ারপোর্ট, টঙ্গী, বোর্ডবাজার সহ)

প্রত্যেক রুটের জন্য ১২০টি করে বাসের পারমিট চাওয়া হয়েছে।

আমি মালিক না‘—তবু পরিচালক!

প্রথমিকভাবে মহিদুল দাউদ সংবাদমাধ্যমে জানান, তিনি চিত্রা পরিবহনের মালিক নন। তিনি বলেন, “সেলিম ভাই ম্যানেজিং ডিরেক্টর, উনি আমাকে শুধু সহযোগিতা চাইছেন।” কিন্তু অনুসন্ধানী তথ্য বলছে ভিন্ন কথা।

গুরুত্বপূর্ণ নথি থেকে জানা যায়:

  • যৌথ মূলধনি কোম্পানির নথিতে মহিদুল দাউদ ভাইস চেয়ারম্যান ও পরিচালক হিসেবে স্বাক্ষর করেছেন।
  • রুট পারমিটের আবেদনপত্রে জমা দেওয়া কাগজেও তার নাম পরিচালক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত।

শিক্ষার্থীদের সামনে রেখে পেছনে কারা?

চিত্রা পরিবহনের সাত পরিচালকের মধ্যে তিনজনের বয়স ২৫ বছরের নিচে, এবং অন্তত তিনজন এখনও শিক্ষার্থী। অন্যদিকে ট্রেড লাইসেন্সধারী মূল ব্যক্তি হলেন সেলিম সরদার, যিনি জানান যে তার অন্য কোম্পানির নয়টি বাস ইতোমধ্যে চলাচল করছে।

প্রশ্ন:

  • কেন শিক্ষার্থীদের দিয়ে কোম্পানির পরিচালক বানানো হলো?
  • তারা কি প্রকৃত বিনিয়োগকারী, নাকি কেবল মোড়ক?

রাজনৈতিক পরিচয় ও প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ

সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে রুট পারমিটের জন্য দাউদ তাকত রেখেই চাপ দিচ্ছেন, এমন অভিযোগ করেছেন পরিবহন সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র। উল্লেখযোগ্যভাবে, তিনি সরকারি পরিবহন দপ্তরের একটি সভাতেও অংশ নেন ‘নিসআ’ ব্যানারে।

তার রাজনৈতিক পরিচয়:

  • গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক
  • নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের অন্যতম মুখপাত্র
  • বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক
  • ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষার দাবিতে আন্দোলনের মুখ

অনুসন্ধানে জানা যায়:

এই পরিচয় ও অতীত আন্দোলনের পরিচিতি ব্যবহার করে তিনি রাজনৈতিক উপদেষ্টাদের কাছাকাছি গিয়ে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করছেন।

জুলাই অভ্যুত্থান ও অন্যান্য বিতর্ক

২০২৩ সালের ‘জুলাই ছাত্র অভ্যুত্থান’-এর সময় মহিদুল দাউদের নাম আবারও সামনে আসে। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া অভিযোগ অনুযায়ী তিনি ও তার ঘনিষ্ঠরা জড়িত ছিলেন—

  • ভর্তি সহায়তা ও আবাসন ব্যবসায় চাঁদাবাজিতে
  • একটি মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স দখলের চেষ্টায়
  • রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হুমকি দিয়ে ছাত্ররাজনীতিতে আধিপত্য কায়েমে

এসব অভিযোগের তদন্ত হয়নি, কারণ অভিযুক্তরা সরকারের নীতিনির্ধারকদের ‘ঘনিষ্ঠ’ হিসেবে বিবেচিত।

আন্দোলন থেকে বাণিজ্যপ্রশ্ন নৈতিকতায়

একসময় যাদেরকে আন্দোলনের নায়ক হিসেবে দেখা হয়েছিল, এখন তারা ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষায় সরকারের বিভিন্ন স্তরে যোগাযোগ রক্ষা করছেন। এই প্রক্রিয়া শুধুমাত্র নৈতিকতার প্রশ্ন তোলে না, বরং পুরো ছাত্ররাজনীতির উদ্দেশ্য ও নির্ভরযোগ্যতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে।

রাস্তা কাঁপানো আন্দোলনের নায়ক এখন রাস্তার পারমিটে ব্যস্ত

০৪:০০:২৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ৪ মে ২০২৫

সারাক্ষণ রিপোর্ট

২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে রাজপথ কাঁপানো কিছু ছাত্রনেতার মধ্যে অন্যতম ছিলেন মহিদুল ইসলাম দাউদ। তিতুমীর কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে তিনি গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক এবং একাধিক আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় মুখ। তবে সাম্প্রতিক সময়ে “চিত্রা পরিবহন লিমিটেড”-এর হয়ে আড়াইশ বাসের রুট পারমিট চেয়ে আবেদনের মাধ্যমে দাউদের নাম নতুন করে আলোচনায় এসেছে।

এই প্রতিবেদনে আমরা বিশ্লেষণ করব—ছাত্র রাজনীতি, আন্দোলন ও পরিচয় কীভাবে পরিবহন খাতে বাণিজ্যিক স্বার্থে রূপান্তরিত হচ্ছে এবং এর পেছনে কে বা কারা থাকছে।

পর্ব ১: চিত্রা পরিবহনএকটি নতুন কোম্পানির রহস্যময় উত্থান

২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে মাত্র ট্রেড লাইসেন্স পাওয়া চিত্রা পরিবহন লিমিটেড, ২০২৪ সালের মার্চেই রাজধানীর ব্যস্ততম ও লাভজনক দুইটি রুটের জন্য ২৪০টি বাস চালুর অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছে। এটি কোনো সাধারণ পরিবহন কোম্পানির আবির্ভাব নয়—এর পেছনে রয়েছে সংঘবদ্ধ ছাত্রনেতা, রাজনৈতিক সংযোগ এবং বিতর্কিত পরিচিতি।

কী কী রুটের জন্য আবেদন?

১. কালিয়াকৈর-নারায়ণগঞ্জ (গুলিস্তান, আজিমপুর, মাতুয়াইল, চাষাঢ়া সহ)
২. সাভার-গাজীপুর (মিরপুর-১, এয়ারপোর্ট, টঙ্গী, বোর্ডবাজার সহ)

প্রত্যেক রুটের জন্য ১২০টি করে বাসের পারমিট চাওয়া হয়েছে।

আমি মালিক না‘—তবু পরিচালক!

প্রথমিকভাবে মহিদুল দাউদ সংবাদমাধ্যমে জানান, তিনি চিত্রা পরিবহনের মালিক নন। তিনি বলেন, “সেলিম ভাই ম্যানেজিং ডিরেক্টর, উনি আমাকে শুধু সহযোগিতা চাইছেন।” কিন্তু অনুসন্ধানী তথ্য বলছে ভিন্ন কথা।

গুরুত্বপূর্ণ নথি থেকে জানা যায়:

  • যৌথ মূলধনি কোম্পানির নথিতে মহিদুল দাউদ ভাইস চেয়ারম্যান ও পরিচালক হিসেবে স্বাক্ষর করেছেন।
  • রুট পারমিটের আবেদনপত্রে জমা দেওয়া কাগজেও তার নাম পরিচালক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত।

শিক্ষার্থীদের সামনে রেখে পেছনে কারা?

চিত্রা পরিবহনের সাত পরিচালকের মধ্যে তিনজনের বয়স ২৫ বছরের নিচে, এবং অন্তত তিনজন এখনও শিক্ষার্থী। অন্যদিকে ট্রেড লাইসেন্সধারী মূল ব্যক্তি হলেন সেলিম সরদার, যিনি জানান যে তার অন্য কোম্পানির নয়টি বাস ইতোমধ্যে চলাচল করছে।

প্রশ্ন:

  • কেন শিক্ষার্থীদের দিয়ে কোম্পানির পরিচালক বানানো হলো?
  • তারা কি প্রকৃত বিনিয়োগকারী, নাকি কেবল মোড়ক?

রাজনৈতিক পরিচয় ও প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ

সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে রুট পারমিটের জন্য দাউদ তাকত রেখেই চাপ দিচ্ছেন, এমন অভিযোগ করেছেন পরিবহন সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র। উল্লেখযোগ্যভাবে, তিনি সরকারি পরিবহন দপ্তরের একটি সভাতেও অংশ নেন ‘নিসআ’ ব্যানারে।

তার রাজনৈতিক পরিচয়:

  • গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক
  • নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের অন্যতম মুখপাত্র
  • বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক
  • ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষার দাবিতে আন্দোলনের মুখ

অনুসন্ধানে জানা যায়:

এই পরিচয় ও অতীত আন্দোলনের পরিচিতি ব্যবহার করে তিনি রাজনৈতিক উপদেষ্টাদের কাছাকাছি গিয়ে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করছেন।

জুলাই অভ্যুত্থান ও অন্যান্য বিতর্ক

২০২৩ সালের ‘জুলাই ছাত্র অভ্যুত্থান’-এর সময় মহিদুল দাউদের নাম আবারও সামনে আসে। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া অভিযোগ অনুযায়ী তিনি ও তার ঘনিষ্ঠরা জড়িত ছিলেন—

  • ভর্তি সহায়তা ও আবাসন ব্যবসায় চাঁদাবাজিতে
  • একটি মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স দখলের চেষ্টায়
  • রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হুমকি দিয়ে ছাত্ররাজনীতিতে আধিপত্য কায়েমে

এসব অভিযোগের তদন্ত হয়নি, কারণ অভিযুক্তরা সরকারের নীতিনির্ধারকদের ‘ঘনিষ্ঠ’ হিসেবে বিবেচিত।

আন্দোলন থেকে বাণিজ্যপ্রশ্ন নৈতিকতায়

একসময় যাদেরকে আন্দোলনের নায়ক হিসেবে দেখা হয়েছিল, এখন তারা ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষায় সরকারের বিভিন্ন স্তরে যোগাযোগ রক্ষা করছেন। এই প্রক্রিয়া শুধুমাত্র নৈতিকতার প্রশ্ন তোলে না, বরং পুরো ছাত্ররাজনীতির উদ্দেশ্য ও নির্ভরযোগ্যতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে।