সারাক্ষণ রিপোর্ট
বিলাসবহুল জীবন বনাম বাস্তব ভারত
যে ভিলাগুলোর দাম শুরু হয় ৩০ কোটি রুপি থেকে, সেগুলো কেবল বাড়ি নয়—এগুলো এক নতুন ‘ভারত’তে প্রবেশের টিকিট। যেখানে পরিবারগুলো ছুটিতে প্রাইভেট জেটে মালদ্বীপ যায়, সন্তানরা নির্বিঘ্নে আইভি লিগে পড়তে যায়, যেন দোকান থেকে দুধ আনতে বলছে কেউ।
এই স্তরের সম্পদ ভারতে বিরল হলেও, যে সংখ্যক মানুষ এই গোষ্ঠীতে আছে তা আইসল্যান্ডের জনসংখ্যার দ্বিগুণ। ভারতীয় অর্থনীতির বৈচিত্র্যই এর বিশেষত্ব—একেকটি শ্রেণি এত বিস্তৃত যে সার্বিকভাবে একটি অসমসংগত চিত্র দাঁড়ায়।
আয় ও সম্পদের পরিসংখ্যান
ভারতে শীর্ষ ১০ শতাংশ আয়কারী হতে বছরে মাত্র ২.৯ লাখ রুপি আয় করলেই চলবে। শীর্ষ ১ শতাংশে ঢুকতে চাইলে দরকার ২০.৭ লাখ রুপি। কিন্তু শীর্ষ ০.১ শতাংশের গড় বার্ষিক আয় ২.২৫ কোটি রুপি—যা একেবারেই সাধারণ ‘ধনী’দেরও ছাড়িয়ে যায়।
সম্পদের হিসাবেও একইরকম চিত্র। নিট সম্পদ ২১ লাখ রুপি হলে আপনি শীর্ষ ১০ শতাংশে, আর ৮২ লাখ থাকলে শীর্ষ ১ শতাংশে। অথচ এই টাকায় অনেক শহরে একটা অ্যাপার্টমেন্টও কেনা যায় না।
ভারতের অর্ধেক জনগণের হাতে ৫ লাখ টাকারও কম সম্পদ, অনেকের তো কিছুই নেই।
গড়ের ফাঁদে
সম্পদ ও আয়ের গড় অনেক সময় বিভ্রান্ত করে। লেখক নিজে এলন মাস্কের সঙ্গে একটি ছবি পোস্ট করেন, ক্যাপশনে মজা করে লেখেন: “এই ছবির গড় সম্পদ ২০০ বিলিয়ন ডলার”—কারণ মাস্কের একারই সম্পদ ৪০০ বিলিয়ন। এভাবে গড় সংখ্যাগুলো বাস্তবতা আড়াল করে।
ভারতে অনেক ধনী লোক তাঁদের পরিচয় গোপন রাখেন কর বা চাঁদা এড়াতে। অন্যদিকে, অনেকেই নিজেদের ধনী প্রমাণ করে বিনিয়োগ বা প্রভাব বাড়াতে চান। অনেকে আবার প্রকৃত গরিব না হয়েও গরিবের রেশন কার্ড সংগ্রহ করেন। এসব কারণেই গড় বা পরিসংখ্যান দিয়ে প্রকৃত চিত্র ধরা কঠিন।
ধনী-গরিবের দুই ভুবন
আমরা যদি ধন-দারিদ্র্য পরিমাপ করতে চাই, তাহলে প্রশ্ন আসে—কী দিয়ে পরিমাপ করব? আয় দিয়ে? সম্পদ দিয়ে? ব্যয় বা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে?
গ্রাম-শহরের হিসাব একভাবে করা যায় না। আসল সত্য হলো—ভারতে ধনী ও গরিব আলাদা গ্রহে বাস করে। একজন প্রাইভেট গেটের পেছনে, বিশেষ বিমান টার্মিনালে, বিশেষ বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্তান পাঠায়, যেখানে ভবিষ্যতের নেতাদের সঙ্গে পরিচয় হবে। অন্যদিকে কেউ কেউ পিৎজা খাওয়ার স্বপ্ন দেখে—যা তাদের কাছে একটি বিলাসিতার চেয়েও দূরের কিছু।
একটি সিনেমার প্রতিচ্ছবি
২০১৫ সালের তামিল ছবি Kaaka Muttai-তে দুই বস্তির শিশু একটি পিৎজার স্বপ্ন দেখে। শেষে তারা এক দোকানদারের করুণা পায়, পিৎজা খায়—তবে দাদির ডোশা দিয়ে বানানো পিৎজার স্মৃতি বেশি ভালো লাগে। বাস্তব ভারতে চাওয়া সহজ, পাওয়া কঠিন।
২০১৮ সালে ইকোনমিস্ট এক রিপোর্টে লেখে—ভারতের ‘মিসিং মিডল ক্লাস’ নিয়ে। একশো কোটি মানুষের দেশ মানেই একশো কোটি ক্রেতা নয়।
মধ্যবিত্ত মানে কী?
লেখকের মতে—আপনার জীবনসঙ্গী যদি চাকরি না করে, আপনি মধ্যবিত্ত। দুজনই যদি না করে, আপনি ধনী। সন্তানরাও যদি না করে, আপনি ধনকুবের।
মধ্যবিত্তরা ইএমআই, স্কুল ফি, দুধের দাম, Zara–সব মিলিয়ে জীবনের নানা চাপে আছে। আইফোন কেনার আগে তারা ইউটিউবে “best mid-range air purifier” সার্চ করে। তারা খরচের চাপে পিষে যায়, কিন্তু উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছাড়ে না।
তবে এই শ্রেণির অনেকেই মানসিকভাবে নিজেদের ‘উপর-মধ্যবিত্ত’ ভাবে। অনেক গরিব মানুষ নিজের পরিচয় বদলাতে চান। কিন্তু বাস্তবতা হলো—মধ্যবিত্তরাও দিন দিন অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তায় ভুগছে। আয় বাড়ছে না, কিন্তু ব্যয় বাড়ছে।
প্রান্তের মানুষ কোথায়?
অসুস্থ, একক মা, মানসিক রোগে ভোগা, আসক্ত—এদের কথা কোথাও নেই। তারা একবার শ্রেণি থেকে ছিটকে গেলে আর ফিরে আসা মুশকিল। ভারতে এমন কোনো কাঠামো নেই যা মধ্যবিত্তকে পতনের পর রক্ষা করতে পারে।
এ কারণেই ভারতের গড় আয় যতই বাড়ুক, দেশের বেশিরভাগ মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। ভারতীয় স্বপ্ন এখনো আছে—কিন্তু সেটা ভাগ্য, পরিচয় ও দুর্ভাগ্যকে অতিক্রম করে পাওয়া কঠিন।
পরিবর্তনের উপায়?
ভারতের অর্থনৈতিক বৈষম্যের শেকড় বহু পুরনো—বর্ণপ্রথা, জমিদারি ব্যবস্থা, ঔপনিবেশিক শোষণ আর ধীর উন্নয়ন সব মিলিয়ে বিপুল জনগণ আজো পিছিয়ে আছে।
উপরের শ্রেণিরা এখনো ক্ষমতার দখলদার। গাঁধী বলেছিলেন: “সবচেয়ে গরিব, সবচেয়ে দুর্বল মানুষের মুখ মনে করুন—আপনার সিদ্ধান্ত কি তার কোনো কাজে লাগবে?”
এই প্রশ্নই আমাদের সামনে থাকা উচিত। তা না হলে সমাজের সীমাহীন বৈষম্যই আমাদের জাতিসত্তা নির্ধারণ করে ফেলবে। উন্নয়ন তখন আর সত্যিকারের উন্নয়ন থাকবে না—শুধু শীর্ষ ১০ শতাংশের ঘুমের স্বপ্ন হয়ে থাকবে।