নারী নিয়োগে বাধ্যবাধকতা তুলে নিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়
বেসরকারি স্কুল ও কলেজে এমপিওভুক্ত শিক্ষক নিয়োগে নারীদের জন্য নির্ধারিত কোটা বাতিল করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ২০২১ সালের একটি নির্দেশনার ভিত্তিতে এতদিন পর্যন্ত শহরাঞ্চলে মোট শূন্যপদের ৪০ শতাংশ এবং গ্রামীণ এলাকায় ২০ শতাংশ পদে নারী প্রার্থীদের নিয়োগ বাধ্যতামূলক ছিল। নতুন সিদ্ধান্তে এই বাধ্যবাধকতা আর থাকছে না।
সরকারি প্রজ্ঞাপনে কোটা বাতিলের ঘোষণা
২০২৫ সালের ১৫ মে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ (শেড) থেকে সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়ের স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে নারী কোটার এই বাতিলের ঘোষণা আসে। এতে বলা হয়, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে নারী প্রার্থীদের জন্য আর বিশেষ কোটা থাকবে না। তবে নারী বিদ্যালয় ও কলেজে শারীরিক শিক্ষা শিক্ষকের ক্ষেত্রে পুরনো নিয়মই বহাল থাকবে।
নিয়োগ সুপারিশে এনটিআরসিএর বাধ্যবাধকতা ছিল
বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) এতদিন নারী কোটার শর্ত পূরণ করতেই অনেক পুরুষ প্রার্থীকে সুপারিশ করতে পারত না। এনটিআরসিএর পেডাগজি ও শিক্ষাগত মান শাখার পরিচালক কাজী কামরুল আহসান জানান, “২০২১ সালের নির্দেশনায় নারী কোটার বাধ্যবাধকতা আসায় শহরাঞ্চলে ৪০ শতাংশ এবং গ্রামীণ এলাকায় ২০ শতাংশ নারী নিয়োগ নিশ্চিত করতে হতো।” তবে হাওর, দুর্গম ও পার্বত্য জেলার বাইরে অনেক জায়গায় এমন বাধ্যবাধকতা ছিল না।
নারী কোটার অবসান: নীতিগত দৃষ্টিভঙ্গি বদলের ইঙ্গিত?
এই সিদ্ধান্ত দেশের শিক্ষক নিয়োগ নীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের সূচনা করল। এটি একদিকে পুরুষ প্রার্থীদের সুযোগ বাড়ালেও, অন্যদিকে নারীশিক্ষক নিয়োগে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি করতে পারে। বিশেষত, শহর ও গ্রামীণ বিদ্যালয়ে নারী শিক্ষকের প্রতিনিধিত্ব কমে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে।
এই সিদ্ধান্তের সম্ভাব্য সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রভাব বিশ্লেষণ
নারীর শিক্ষায় পতনের ঝুঁকি?
একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, ছাত্রীদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে অনেক অভিভাবক নারী শিক্ষকের উপস্থিতিকে প্রধান শর্ত হিসেবে বিবেচনা করেন। বিশেষ করে রক্ষণশীল সমাজে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখন যদি নারী শিক্ষকের সংখ্যা কমে যায়, তাহলে অনেক মেয়েশিশু বিদ্যালয়ে যাওয়া থেকে বঞ্চিত হতে পারে। ফলে এই সিদ্ধান্ত দীর্ঘমেয়াদে নারীর শিক্ষায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
কর্মসংস্থানের সুযোগ হ্রাস এবং অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণে বাধা
বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্র, বিশেষত মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে, নারীর জন্য একটি বড় কর্মক্ষেত্র। নারী কোটার মাধ্যমে যারা আগে সরাসরি নিয়োগের সুযোগ পেতেন, এখন তাদের সেই সুবিধা হারাতে হবে। তীব্র প্রতিযোগিতায় অনেক যোগ্য নারী প্রার্থী হয়তো চাকরি থেকে বঞ্চিত হবেন, যা দেশের অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণে সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে।
নারীর ক্ষমতায়নের পথে প্রতিবন্ধকতা?
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে নারীর ক্ষমতায়নের অন্যতম হাতিয়ার হলো শিক্ষা ও কর্মসংস্থান। শিক্ষকতা ছিল এমন একটি ক্ষেত্র, যেখানে সমাজ ও পরিবারের সম্মতিতে নারীরা সহজেই প্রবেশ করতে পারতেন। কোটার অবসানে সেই প্রবেশ পথ সংকীর্ণ হয়ে গেলে এটি নারীর সার্বিক ক্ষমতায়নের জন্য এক ধরণের পরোক্ষ বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
ধর্মীয় কট্টরপন্থীদের জন্য এটি সুবিধাজনক?
নারীশিক্ষার বিরোধিতাকারী ধর্মীয় কট্টরপন্থীরা বরাবরই নারী শিক্ষক ও নারী শিক্ষার পরিবেশকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। নারী কোটার অবসান অনেক অঞ্চলে তাদের বক্তব্যকে শক্তিশালী করতে পারে। নারী শিক্ষকের সংখ্যা কমে গেলে ছাত্রীদের স্কুলে যাওয়া বাধাগ্রস্ত হতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে কট্টরপন্থীদের সামাজিক নিয়ন্ত্রণ বাড়াতে সহায়ক হতে পারে।
সংরক্ষিত কিছু পদে নারীদের অগ্রাধিকার বজায়
শারীরিক শিক্ষার ক্ষেত্রে নারী স্কুল ও কলেজে নারী প্রার্থীদের অগ্রাধিকার নীতিতে কোনো পরিবর্তন হয়নি। শেডের উপসচিব দিপায়ন দাস শুভ জানান, “নারী বিদ্যালয়ে সহকারী শারীরিক শিক্ষকের পদে এবং নারী কলেজে শারীরিক শিক্ষকের পদে এখনও নারী প্রার্থীদের জন্য আগের নিয়মই বহাল থাকবে।”
সর্বোপরি নারী কোটা বাতিলের মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ‘যোগ্যতা নির্ভর’ নীতির জোরালো প্রয়োগের চেষ্টা দেখা গেলেও, এর সামাজিক প্রতিক্রিয়া বিস্তৃত। নারীশিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং ক্ষমতায়নের মতো মৌলিক উন্নয়ন সূচকে এটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের এ সিদ্ধান্তের দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল সুস্পষ্টভাবে মূল্যায়ন করে প্রয়োজন হলে পুনর্বিবেচনার পথে হাঁটা উচিত।