০৬:০৭ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

ঢাকার ছাদ থেকে ধ্বংসাবশেষে: হারিয়ে যাওয়া বানরেরা

সারাংশ

  • পুরান ঢাকায় বানর ও মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ছিল; হিন্দু পরিবারগুলো তাদের আশ্রয় ও খাবার দিত।

  • নগরায়ণ ও হিন্দু পরিবারের দেশত্যাগে বানরের বাসস্থান ও সহায়তা কমে যায়।

  •  কিছু বানর এখনো গেণ্ডারিয়ায় টিকে আছে, তবে খাদ্য সংকট ও উত্ত্যক্ততার কারণে তারা হুমকির মুখে।


রিসাস ম্যাকাক (Macaca mulatta) প্রজাতির বানর ঢাকার শহরাঞ্চলের পরিবেশে শত বছরেরও বেশি সময় ধরে একটি পরিচিত উপস্থিতি ছিল। বিশেষ করে পুরান ঢাকার গেণ্ডারিয়া এলাকায় এসব বানরের অবস্থান এক সময় ছিল খুবই স্বাভাবিক দৃশ্য। মানুষ ও বানরের সহাবস্থান ছিল চেনা বাস্তবতা।

ঐতিহাসিক উপস্থিতি (১৯৫০১৯৭০-এর দশক)

উনিশ শতকের মধ্যভাগে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায়, বিশেষ করে যেখানে সবুজ গাছপালা ও ফলজ বৃক্ষ বেশি ছিল, সেসব জায়গায় রিসাস ম্যাকাক প্রজাতির বানর ভালভাবেই টিকে ছিল। বহু হিন্দু পরিবার এসব বানরকে শ্রদ্ধা করত, তাদের খেতে দিত এবং বাগান ও ছাদে আশ্রয় নিতে দিত। ১৯৭৬ সালে এক গবেষণায় দেখা যায়, পুরান ঢাকায় ১১টি দলে মোট ১৯৬টি বানর ছিল; একই বছর প্রজনন মৌসুম শেষে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২২০। ১৯৮৩ সালে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ২৯টি দলে মোট ২২৯টি বানর।

 বানরের সংখ্যা কমা শুরু

২০শ শতকের শেষ ভাগ থেকে ঢাকায় রিসাস ম্যাকাক প্রজাতির সংখ্যা কমতে শুরু করে। এর প্রধান কারণ ছিল দ্রুত নগরায়ণ। একতলা বাড়ি ও বাগান ধ্বংস করে বহুতল ভবন গড়ে ওঠায় বানরদের বাসস্থান নষ্ট হয়ে যায়। পাশাপাশি, যারা ঐতিহ্যগতভাবে বানরের দেখভাল করতেন, সেই হিন্দু পরিবারগুলোর বড় অংশের দেশত্যাগের ফলে বানররা মানুষের সহায়তা থেকেও বঞ্চিত হতে থাকে। ২০০৫ সালের এক জরিপে দেখা যায়, পুরান ঢাকায় মাত্র ১০টি দলে ১৭৮টি বানর অবশিষ্ট ছিল—যা পূর্বের তুলনায় একটি উল্লেখযোগ্য হ্রাস।

বর্তমান অবস্থা

বর্তমানে ঢাকায় রিসাস ম্যাকাক প্রজাতির বানর খুব সীমিত কিছু জায়গায় ছড়িয়ে রয়েছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য একটি দল অবস্থান করছে পুরান ঢাকার গেণ্ডারিয়ায় অবস্থিত সাধনা ঔষধালয়ের ভেতরে। ১৯১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এই আয়ুর্বেদিক কারখানা এক ধরনের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে বানরগুলোর জন্য। এখানে কর্মীরা এখনও প্রতিষ্ঠাতার ঐতিহ্য ধরে রেখে বানরদের খাওয়ান ও আশ্রয় দেন।

তবে এসব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ঢাকায় বানরদের অস্তিত্ব এখনো হুমকির মুখে। স্থানীয়দের দ্বারা উত্ত্যক্ত করার ঘটনা যেমন ইট-পাটকেল ছোড়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে, তেমনি খাদ্যের অভাব তাদের টিকে থাকাকে আরও কঠিন করে তুলছে। ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন বানরদের আইনি সুরক্ষা দিলেও এর বাস্তব প্রয়োগ খুবই সীমিত। সংরক্ষণবিদেরা বলছেন, মানুষের সঙ্গে বানরের সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হলে সম্প্রদায়ভিত্তিক উদ্যোগই সবচেয়ে কার্যকর পন্থা।

এক সময় ঢাকার শহরজীবনের প্রাণবন্ত অংশ ছিল রিসাস ম্যাকাক প্রজাতির বানর। কিন্তু বাসস্থান হারানো ও মানুষের সহায়তা হ্রাস পাওয়ায় তাদের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। এই প্রজাতির বেঁচে থাকা ও নগর পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় প্রয়োজন আইনি ও সমাজভিত্তিক সমন্বিত সংরক্ষণ প্রচেষ্টা।

ঢাকার ছাদ থেকে ধ্বংসাবশেষে: হারিয়ে যাওয়া বানরেরা

০৭:১৮:৪০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫

সারাংশ

  • পুরান ঢাকায় বানর ও মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ছিল; হিন্দু পরিবারগুলো তাদের আশ্রয় ও খাবার দিত।

  • নগরায়ণ ও হিন্দু পরিবারের দেশত্যাগে বানরের বাসস্থান ও সহায়তা কমে যায়।

  •  কিছু বানর এখনো গেণ্ডারিয়ায় টিকে আছে, তবে খাদ্য সংকট ও উত্ত্যক্ততার কারণে তারা হুমকির মুখে।


রিসাস ম্যাকাক (Macaca mulatta) প্রজাতির বানর ঢাকার শহরাঞ্চলের পরিবেশে শত বছরেরও বেশি সময় ধরে একটি পরিচিত উপস্থিতি ছিল। বিশেষ করে পুরান ঢাকার গেণ্ডারিয়া এলাকায় এসব বানরের অবস্থান এক সময় ছিল খুবই স্বাভাবিক দৃশ্য। মানুষ ও বানরের সহাবস্থান ছিল চেনা বাস্তবতা।

ঐতিহাসিক উপস্থিতি (১৯৫০১৯৭০-এর দশক)

উনিশ শতকের মধ্যভাগে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায়, বিশেষ করে যেখানে সবুজ গাছপালা ও ফলজ বৃক্ষ বেশি ছিল, সেসব জায়গায় রিসাস ম্যাকাক প্রজাতির বানর ভালভাবেই টিকে ছিল। বহু হিন্দু পরিবার এসব বানরকে শ্রদ্ধা করত, তাদের খেতে দিত এবং বাগান ও ছাদে আশ্রয় নিতে দিত। ১৯৭৬ সালে এক গবেষণায় দেখা যায়, পুরান ঢাকায় ১১টি দলে মোট ১৯৬টি বানর ছিল; একই বছর প্রজনন মৌসুম শেষে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২২০। ১৯৮৩ সালে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ২৯টি দলে মোট ২২৯টি বানর।

 বানরের সংখ্যা কমা শুরু

২০শ শতকের শেষ ভাগ থেকে ঢাকায় রিসাস ম্যাকাক প্রজাতির সংখ্যা কমতে শুরু করে। এর প্রধান কারণ ছিল দ্রুত নগরায়ণ। একতলা বাড়ি ও বাগান ধ্বংস করে বহুতল ভবন গড়ে ওঠায় বানরদের বাসস্থান নষ্ট হয়ে যায়। পাশাপাশি, যারা ঐতিহ্যগতভাবে বানরের দেখভাল করতেন, সেই হিন্দু পরিবারগুলোর বড় অংশের দেশত্যাগের ফলে বানররা মানুষের সহায়তা থেকেও বঞ্চিত হতে থাকে। ২০০৫ সালের এক জরিপে দেখা যায়, পুরান ঢাকায় মাত্র ১০টি দলে ১৭৮টি বানর অবশিষ্ট ছিল—যা পূর্বের তুলনায় একটি উল্লেখযোগ্য হ্রাস।

বর্তমান অবস্থা

বর্তমানে ঢাকায় রিসাস ম্যাকাক প্রজাতির বানর খুব সীমিত কিছু জায়গায় ছড়িয়ে রয়েছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য একটি দল অবস্থান করছে পুরান ঢাকার গেণ্ডারিয়ায় অবস্থিত সাধনা ঔষধালয়ের ভেতরে। ১৯১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এই আয়ুর্বেদিক কারখানা এক ধরনের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে বানরগুলোর জন্য। এখানে কর্মীরা এখনও প্রতিষ্ঠাতার ঐতিহ্য ধরে রেখে বানরদের খাওয়ান ও আশ্রয় দেন।

তবে এসব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ঢাকায় বানরদের অস্তিত্ব এখনো হুমকির মুখে। স্থানীয়দের দ্বারা উত্ত্যক্ত করার ঘটনা যেমন ইট-পাটকেল ছোড়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে, তেমনি খাদ্যের অভাব তাদের টিকে থাকাকে আরও কঠিন করে তুলছে। ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন বানরদের আইনি সুরক্ষা দিলেও এর বাস্তব প্রয়োগ খুবই সীমিত। সংরক্ষণবিদেরা বলছেন, মানুষের সঙ্গে বানরের সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হলে সম্প্রদায়ভিত্তিক উদ্যোগই সবচেয়ে কার্যকর পন্থা।

এক সময় ঢাকার শহরজীবনের প্রাণবন্ত অংশ ছিল রিসাস ম্যাকাক প্রজাতির বানর। কিন্তু বাসস্থান হারানো ও মানুষের সহায়তা হ্রাস পাওয়ায় তাদের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। এই প্রজাতির বেঁচে থাকা ও নগর পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় প্রয়োজন আইনি ও সমাজভিত্তিক সমন্বিত সংরক্ষণ প্রচেষ্টা।