এক সময় গ্রামের মেঠোপথে খাকি ব্যাগ ঝুলিয়ে যাওয়া পোস্টম্যানের পায়ের শব্দে মানুষ বুঝে নিত—চিঠি এসেছে। আজ সেই চিঠির জায়গা নিয়েছে স্ক্রিনের ‘নটিফিকেশন’, আর খাকি ব্যাগ বদলে গেছে বাইকের পিঠে বাঁধা বক্সে। এই নতুন যুগের “আধুনিক postal man”-রা হলেন আমাদের ডেলিভারি বয়—যাঁরা প্রতিদিন শহরের রক্তমোহনায় রোদ-বৃষ্টি পাড়ি দিয়ে পৌঁছে দেন ওষুধ, খাবার, বই, কখনও বা জন্মদিনের কেক ও প্রেমিকের চমক।
ড. সৌমিক দাসের ঝাঁঝালো গানের কথায়ই তাঁদের জীবনের সুর—
“আমি সেই ডেলিভারি বয়, কাঁধে স্বপ্নের বাক্স,
রোদ্দুর-বৃষ্টি মুছে ছুটে চলি দিন-রাত।’’
গানের পরের পংক্তিগুলো যেন আরও স্পষ্ট করে দেয় এই পেশার না-বলা লড়াই—
“দেয়ালে টাঙানো ক্যালেন্ডার, তারিখ শুধু বেতনহীন,
নীরব সিগন্যালে গল্প লিখে যায় হর্নের সুর।”
বহুতল শহরের অগণন দরজায় তাঁদের নকই এখনকার ‘চিঠি-বেল’—
“দরজায় কড়া নাড়ি, লিফটহীন সিঁড়ি পেরিয়ে,
বাড়ির ছাদে আলো জ্বলে, ফিরতি পথে একটাই ঠিকানা।”
এই গান যেমন তাদের ক্লান্ত হাতের গল্প বলে, তেমনি হাড়ভাঙা খাটনি, অনিশ্চিত আয় আর ভারী ট্র্যাফিকেও লুকিয়ে থাকা দৃঢ় আশা—
“ফুটপাতে ভাঙা স্বপ্ন, পকেটে সম্বল স্বল্প,
তবু হাসি মুখে বলে যাই—‘সার্ভিস অলওয়েজ অন-টাইম!’”
ডেলিভারি বয়রা সেই অবিরাম ছুটে চলা মানবিক সেতু, যাঁরা অফলাইনের কাঁধে অনলাইনকে বয়ে আনেন। তাঁদের আর্তি, আনন্দ, ঘাম, এবং স্বপ্ন মিলিয়ে যে কাব্য রচিত হয়, ‘ডেলিভারি বয়’ গানটি তার শব্দযাপন। এই সিরিজ-রিপোর্টে আমরা ঢাকার আরিফ থেকে সিলেটের রাজু পর্যন্ত পাঁচ শহরের পাঁচ জন ডেলিভারি বয়ের দিনমান, পরিবার, স্বপ্ন ও সংশয়ের বাঁকগুলো তুলে ধরব—আলোয়-অন্ধকারে যে জীবন, তা গানের পংক্তির মতোই সহজ-প্রাণ yet সংগ্রামী।
পাঠকের আহ্বান—চাইলে আপনি যখন পরের বার খাবার বা প্যাকেট হাতে নেবেন, মনে করবেন ওই প্যাকেটের গায়ে ভাসছে গানেরই লাইন:
“আমি সেই ডেলিভারি বয়—স্বপ্ন যে পৌঁছে দেই বাড়ি-বাড়ি।”
বাংলাদেশের পাঁচ প্রধান সিটি’র ডেলিভারী বয়দের নিয়ে পাঁচ পর্বের ধারাবাহিক রিপোর্ট –
চট্টগ্রাম—পাহাড়ি ঢালে জুনায়েদের লড়াই
বহদ্দারহাট বাস টার্মিনালের গলিতে ছোট্ট একটি মেস-ঘরে ২৬-বছরের মো. জুনায়েদের দিন শুরু ভোর পাঁচটায়। দোতলার বারান্দা থেকে তিনি বন্দরের দিগন্তে ওঠা লাল সূর্য দেখেন; বাঁশখালীর পাহাড়ি রাস্তায় আজ কতটা চড়াই-উতরাই পাড়ি দিতে হবে, সেটিই তার মূল চিন্তা।
সকাল (৫টা–৯টা): কুরিয়ার রাউন্ড
সকাল ৬টায় চাক্তাই খালের ধারে কুরিয়ার হাব থেকে প্যাকেজ তোলেন—ই-কমার্সের মোবাইল কভার, বন্দর স্টাফদের জরুরি পার্টস, এমনকি মাঝেমধ্যে ডিউটি-ফ্রি সিগারেটও। চট্টগ্রামের ট্রাক কনভয় ভোরেই শুরু হয়, তাই এক লেন আটকা থাকলে বিকল্প হলো পাহাড়ি ঘোরওয়ালা পথ। প্রতিটি পার্সেল বাবদ ২৫-৩০ টাকা ফি, কিন্তু তেলের দাম পাহাড়ি রাস্তায় দ্বিগুণ খরচায় উঠে যায়।
দুপুর (৯টা–৩টা): বৃষ্টির সাথে সমঝোতা
বর্ষাকালে জুন-আগস্টে দুপুর আচমকা মেঘ জমে; তিন বছরে তিনবার তিনি বাইক সহ ফ্লাইওভারের নিচে আশ্রয় নিয়েছেন। ফুড অর্ডার তুলতে হয় জিইসি কনকর্ডের ফাস্ট-ফুড দোকান থেকে আগ্রাবাদে। কন্টেইনার ট্রাক পেছনে রেখে বাইক চালানো মানে ধোঁয়া-ধুলো আর ব্রেক-প্যাডের ক্রমাগত ক্ষয়।
সন্ধ্যা (৩টা–৭টা): পাহাড়ি সোপান
বন্দর থেকে বেরোনো কন্টেইনার কাড়িকাড়ির ভিড়ে টানাটানি; পাহাড়ি সোপান যখন ভেজা, তখন সাইকেল-রাইডাররা পিছলে পড়ে। জুনায়েদ টায়ারে অতিরিক্ত গেইজ রাখেন না, কারণ চড়াই নেমে যাওয়ার সময় বেশি গতি দুর্ঘটনা ডেকে আনে। সন্ধ্যা সাতটার পর ফুডপান্ডার “ডিনার বুস্ট” শুরু, যেখানে ফি বেড়ে দেড়গুণ হয়, কিন্তু কাজও কঠিন—পাহাড় ছুঁয়ে থাকা বাসার পাঁচতলা লিফটহীন সিঁড়ি।
রাত (৭টা–১১টা): ফিরতি ক্লান্তি
রাত ১০টা নাগাদ শেষ অর্ডার— দ্বিতীয় শাটল গলির বাড়ি, যেখানে বৃষ্টি জমা পানিতে কোমর ডুবিয়ে বাইক ঠেলে নেন। ঘরে ফিরতে ফিরতে ১১টা বাজে; মেস-রুমের দু’জন রুমমেট ইতিমধ্যে ঘুমিয়ে, স্পর্শকাতর টিউব-লাইট জ্বলছে আধা।
পরিবার ও স্বপ্ন
জুনায়েদের বাবা গ্রামে দিন-মজুর; মাসে ৬-৭ হাজার টাকা পাঠান। মা ডান হাতে বাতের ব্যথায় কাতর; পোস্ত-দানা তেল আর ফিজিওথেরাপির খরচ জোগাতে জুনায়েদেরই টাকা লাগে। মাসে ২২-২৪ হাজার টাকা ইনকাম, খরচ বাদে ১০-১১ হাজার যায় বাড়িতে। তিনি ইউডেমি থেকে গ্রাফিক ডিজাইন শেখার কোর্স কিনেছেন সাড়ে তিন হাজার টাকায়—রাত একটা পর্যন্ত ল্যাপটপের ছোট স্ক্রিনে লেগে থাকেন।
জুনায়েদের কথা
“হাব-টু-হাব মডেল চালু হলে দূরত্ব কমতে পারে, কিন্তু যদি প্রতি প্যাকেজে ফি কমে যায়, তবে লাভ নেই। আমরা চাই—যতটা মাইল, ততটুকুই ন্যায্য ফি আর দুর্ঘটনা-বীমা,”—জুনায়েদের কণ্ঠে ভরসা আর সংশয় পাশাপাশি।