দেশের প্রায় চার লাখ সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকের মধ্য থেকে অন্তত ৬৫ হাজার শিক্ষক সোমবার থেকে অনির্দিষ্টকালের পূর্ণদিবস কর্মবিরতিতে যাচ্ছেন। লক্ষ্য একটাই—প্রবেশ পদেই ১১তম গ্রেডের বেতন ও দ্রুত পদোন্নতির নিশ্চয়তা। আন্দোলন ঘিরে শুধু শ্রেণিকক্ষই নিস্তব্ধ নয়; প্রাথমিক শিক্ষার ভবিষ্যৎ নিয়েও বাড়ছে উৎকণ্ঠা।
প্রেক্ষাপট: বেতন গ্রেডের দ্বন্দ্ব
বর্তমানে সহকারী শিক্ষকরা জাতীয় পে-স্কেলের ১৩তম গ্রেডে (মূল বেতন ১১,০০০ টাকা) বেতন পান, আর প্রধান শিক্ষকরা পান ১১তম গ্রেডে (১২,৫০০ টাকা)। কনসালটেশন কমিটি ১২তম গ্রেডের সুপারিশ করায় শিক্ষকরা তা প্রত্যাখ্যান করেন; তাঁদের দাবি—প্রবেশ পদেই ১১তম গ্রেড এবং ১০ ও ১৬ বছর পূর্তিতে স্বয়ংক্রিয় উচ্চতর গ্রেড।
আন্দোলনের পথচালা
· ৫–১৫ মে: প্রতিদিন ১ ঘণ্টা কর্মবিরতি
· ১৬–২০ মে: ২ ঘণ্টা কর্মবিরতি
· ২১–২৫ মে: অর্ধদিবস কর্মবিরতি
· ২৬ মে থেকে: লাগাতার পূর্ণদিবস কর্মবিরতি, পরীক্ষা থাকবে কর্মসূচির বাইরে
কেন গুরুত্বপূর্ণ এখনও
বাংলাদেশে প্রাথমিক পর্যায়ে নিবন্ধিত শিক্ষক সংখ্যা ৩৮ লাখের একটু কম, ছাত্র–শিক্ষক অনুপাত ১ : ৩৩ — যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অলরেডি ইতিবাচক ধাপ। কিন্তু বিগত বছরেই ৮.৩২ লাখ শিক্ষার্থী কমে গেছে; বাজেটে শিক্ষা খাতে জিডিপির মাত্র ১.৬৯ শতাংশ বরাদ্দ, ১৬ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এই প্রেক্ষাপটে শিক্ষক অনুপস্থিতি শিক্ষার মানকে আরও চাপের মুখে ফেলবে।
শিক্ষকদের বক্তব্য
‘১২তম গ্রেড মানি না, মানবো না,’—বলেছেন আন্দোলনের আহ্বায়ক মোহাম্মদ শামছুদ্দীন মাসুদ। আরেক শিক্ষক খায়রুন নাহার লিপির ভাষ্য, ‘সুদীর্ঘ সময় ১৩তম গ্রেডে ঠেকানো আমাদের পেশাগত মানসিকতা ভেঙে দিচ্ছে; অবিলম্বে সমাধান না এলে কর্মসূচি আরও কঠোর হবে।’
সরকার কী করতে পারে
দ্রুত ত্রিপক্ষীয় সংলাপ: শিক্ষক প্রতিনিধি, অর্থ মন্ত্রণালয় ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরকে নিয়ে নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে সমঝোতা।
পোস্ট সৃষ্টি ও পদোন্নতি নীতিমালা হালনাগাদ: প্রধান শিক্ষক পদে ১০০ শতাংশ পদোন্নতি নিশ্চিত করতে কারিগরি বিধিমালা সংশোধন।
ধাপে ধাপে বেতন পুনর্গঠন: অবিলম্বে ১২তম গ্রেড ঘোষণা ও পরবর্তী বাজেটে ১১তম গ্রেডে টাকাসহ সমতায় উন্নীত করার রোডম্যাপ।
পেশাগত উন্নয়ন তহবিল: নির্দিষ্ট বাজেটের অংশ শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি সহায়তায় বরাদ্দ, যাতে বেতন বাড়লেও দক্ষতা অনুপাতে ফল পাওয়া যায়।
পারফরমেন্স অডিট: বেতন বৃদ্ধির ফলাফল শিক্ষার্থীর শিখনফল, উপস্থিতি ও পরীক্ষায় মাপকাঠির মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ।
সম্ভাব্য পরিণতি
· শিক্ষার্থীর শেখার ক্ষতি: দীর্ঘমেয়াদি স্কুলবিরতি প্রাথমিক স্তরে পঠিত বিষয় বিস্মৃতির ঝুঁকি বাড়ায়; কোভিড-পরবর্তী পুনরুদ্ধার পিছিয়ে যাবে।
· ড্রপআউট ও অসমতা: গ্রামাঞ্চলে বিকল্প শিক্ষা না থাকায় ঝরে পড়া বাড়তে পারে; শিশু শ্রম ও কম বয়সে বিয়ের হারও বাড়ার আশঙ্কা।
· SDG ৪ ঝুঁকিতে: ২০৩০ সালের ‘সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা’ লক্ষ্য ব্যাহত হবে।
· সরকারি ব্যয়ের চাপ: ১১তম গ্রেডে উন্নীত করলে বছরে আনুমানিক ২,০০০–২,২০০ কোটি টাকা বাড়তি ব্যয় হতে পারে—কিন্তু ডিজিটাল শিক্ষায় বিনিয়োগ ও শিক্ষার্থীর দক্ষতায় এর সামাজিক রিটার্ন আরও বেশি হবে।
বিশেষজ্ঞদের কণ্ঠ
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মঞ্জুর আহমেদ বলেন, ‘শিক্ষকদের আর্থিক স্বস্তি নিশ্চিত না করলে শিখন ফলাফলে উন্নতি হবে না। বেতন দাবি পুরোপুরি বাস্তবসম্মত; বরং দেরি শিক্ষার ক্ষতির খেসারত আরও দিতে হবে।
সর্বোপরি, প্রাথমিক শিক্ষার মান গড়ে তোলার মূল চালিকাশক্তি শিক্ষক। তাঁদের ন্যায্য বেতন ও ক্যারিয়ার কাঠামো নিশ্চিত না করলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভিত্তি দুর্বল হতে বাধ্য। সরকার দ্রুত সময়সীমা নির্ধারণ করে সমাধান না করলে শুধু বিদ্যালয়ই নয়, দেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতিও অনিশ্চয়তা সামনে পাবে।