০৪:৫০ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫

জুলাই আন্দোলনকারীদের বিষপানের করুণ সুর ও বিলাসের অন্ধকার

চোখে গুলিবিদ্ধ চার ‘জুলাই আন্দোলনকারী’ রবিবার জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালকের কক্ষেই কীটনাশক খেয়ে ফেলেন। দ্রুত সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকেরা জানান, তাঁরা আপাতত শঙ্কামুক্ত। তবু ঘটনাটি চিনি-মেশানো তেতো প্রশ্ন রেখে যায়—দশ মাস পেরিয়েও কেন পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা কিংবা বিদেশে পাঠানোর সুপারিশ পেলেন না তাঁরা?

আহত শিমুলের কথায়, ‘মরে গেলে হয়তো অন্যরা বাঁচবে।’ তাঁর সঙ্গী আখতার যোগ করেন, সিঙ্গাপুরে ছয় মাস চিকিৎসা লাগবে জেনেও ‘সরকার ভাড়া দ্বিগুণ লিখে দুর্নীতি করেছে’। তাঁদের অভিযোগ—হাসপাতাল ফলো-আপের নামে আটকে রাখলেও বিদেশে রেফার্ডের তালিকায় ঠিকই ‘বাছাই করা’ ১০ জনের নাম গেছে।

দৃষ্টিহীনতার পাশাপাশি যে অসহায়ত্ব জমে উঠেছে, তার মূল খুঁজতে গিয়ে চোখ পড়ে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের দিকে। অনুদানের তালিকায় ভুয়া আহত ব্যক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করা, থানায় একের পর এক জালিয়াতি মামলা—সব মিলিয়ে প্রকৃত ভুক্তভোগীরাই সহায়তার বাইরে থেকে যাচ্ছেন।

এই বিড়ম্বনার পটভূমিতে ভেসে ওঠে আন্দোলনের অন্যতম মুখ সার্জিস আলমের নাম। উত্তরাঞ্চলের প্রত্যন্ত আটোয়ারী থেকে ঢাকার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে কোটা-বিরোধী প্ল্যাটফর্মে নেতৃত্ব—এই ‘গ্রাম্য উত্থান’-এর গল্প নিঃসন্দেহে সংগ্রামী শোনায়। কিন্তু মাত্র এক বছরেই ছবিটা পাল্টে যায়। দল বদলে জাতীয় সিটিজেন পার্টির (এনসিপি) প্রধান সংগঠক; ঢাকায় অভিজাত ফ্ল্যাট, শোরুম থেকে ভাড়া নেওয়া ল্যান্ড ক্রুজার, ফেব্রুয়ারির ‘মোটরকেড’—সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়। দলের কেন্দ্রীয় বৈঠকেও তাঁর ‘অতিরঞ্জিত বিলাস’ ও ‘আর্থিক অনিয়মের’ অভিযোগ ওঠে।

রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানী ড. তানভীর মাহমুদ মনে করেন, হঠাৎ ক্ষমতার কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া প্রথম-প্রজন্মের নেতাদের মধ্যে ‘দ্রুত আয়-টুপি-আরোপ সিন্ড্রোম’ দেখা যায়—আদর্শ গড়ে ওঠার আগেই ভোগবিলাসের আকর্ষণ তাদের গ্রাস করে। ফলে ‘রাস্তায় ফেলা রক্তকে পুঁজি করে’ আন্দোলনের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠানবিরোধী ইমেজ রক্ষায় ব্যর্থ হয়।

ফাউন্ডেশনেই নানান বিতর্ক

শুধু ব্যক্তিগত বিলাস নয়, প্রতিষ্ঠানগত স্বচ্ছতার সংকটও প্রকট। ফাউন্ডেশনের সিইও মির মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ এই মাসের শুরুতেই পদত্যাগ করেছেন; অর্থ ব্যয়ের জবাবদিহি ও হতাহত পরিবারের অনুদান-বণ্টন নিয়ে প্রশ্নের মুখে তিনি ‘পড়াশোনার চাপ’ দেখিয়ে সরে যান।

অভিযোগ ওঠে, ফাউন্ডেশনের ১০০ কোটির বেশি তহবিল ব্যয়ের খতিয়ানের বড় অংশ ‘প্রশাসনিক খরচ’ হিসেবে দেখানো হয়েছে, অথচ টাকার সিংহভাগ এখনও ভুক্তভোগীর হাতে পৌঁঁছায়নি। বঞ্চিতেরা বলছেন, নিয়মিত অডিট ও সম্পত্তি ঘোষণার ব্যবস্থা না থাকলে এই প্রতিষ্ঠানের মানে দাঁড়ায়—ভবিষ্যৎ রাজনীতির ‘ওয়ার চেস্ট’।

সাম্প্রতিক বিষপান-ঘটনা প্রমাণ করল, আন্দোলন-পরবর্তী পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় বড় ফাঁক রয়ে গেছে। একদিকে আহতদের চিকিৎসা-খরচ, অন্যদিকে তদন্তের অজুহাতে ভোগান্তি দীর্ঘ হওয়ায় ক্ষোভ জমেছে। এর সঙ্গে নেতৃত্বের বিলাসিতা ঘিরে উঠছে নৈতিক প্রশ্ন: আন্দোলনের মূল আদর্শ—অবৈধ সুবিধা ও বৈষম্যের বিরোধিতা—নিজেদের জীবনেই টিকে থাকল কোথায়?

‘জুলাইয়ের কোটা আন্দোলন ও মেটিকুলাস ডিজাইন—সব মিলিয়ে হাসিনার পতন হলেও—ওই আন্দোলন ও ডিজাইনের নেতৃত্ব আজ আদর্শের পরীক্ষায় দাঁড়িয়ে। গুলিবিদ্ধ ছাত্ররা যখন বিষের বোতল তুলে নিচ্ছেন, তখন অভিজাত গাড়ির কাচ তুলছে সেই নেতৃত্ব—এটি তাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভবিষ্যৎ পরিণতি কী, সেই প্রশ্ন এখন আগুনের মতো জ্বলছে।’

জুলাই আন্দোলনকারীদের বিষপানের করুণ সুর ও বিলাসের অন্ধকার

০৫:০০:৪৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৬ মে ২০২৫

চোখে গুলিবিদ্ধ চার ‘জুলাই আন্দোলনকারী’ রবিবার জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালকের কক্ষেই কীটনাশক খেয়ে ফেলেন। দ্রুত সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকেরা জানান, তাঁরা আপাতত শঙ্কামুক্ত। তবু ঘটনাটি চিনি-মেশানো তেতো প্রশ্ন রেখে যায়—দশ মাস পেরিয়েও কেন পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা কিংবা বিদেশে পাঠানোর সুপারিশ পেলেন না তাঁরা?

আহত শিমুলের কথায়, ‘মরে গেলে হয়তো অন্যরা বাঁচবে।’ তাঁর সঙ্গী আখতার যোগ করেন, সিঙ্গাপুরে ছয় মাস চিকিৎসা লাগবে জেনেও ‘সরকার ভাড়া দ্বিগুণ লিখে দুর্নীতি করেছে’। তাঁদের অভিযোগ—হাসপাতাল ফলো-আপের নামে আটকে রাখলেও বিদেশে রেফার্ডের তালিকায় ঠিকই ‘বাছাই করা’ ১০ জনের নাম গেছে।

দৃষ্টিহীনতার পাশাপাশি যে অসহায়ত্ব জমে উঠেছে, তার মূল খুঁজতে গিয়ে চোখ পড়ে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের দিকে। অনুদানের তালিকায় ভুয়া আহত ব্যক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করা, থানায় একের পর এক জালিয়াতি মামলা—সব মিলিয়ে প্রকৃত ভুক্তভোগীরাই সহায়তার বাইরে থেকে যাচ্ছেন।

এই বিড়ম্বনার পটভূমিতে ভেসে ওঠে আন্দোলনের অন্যতম মুখ সার্জিস আলমের নাম। উত্তরাঞ্চলের প্রত্যন্ত আটোয়ারী থেকে ঢাকার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে কোটা-বিরোধী প্ল্যাটফর্মে নেতৃত্ব—এই ‘গ্রাম্য উত্থান’-এর গল্প নিঃসন্দেহে সংগ্রামী শোনায়। কিন্তু মাত্র এক বছরেই ছবিটা পাল্টে যায়। দল বদলে জাতীয় সিটিজেন পার্টির (এনসিপি) প্রধান সংগঠক; ঢাকায় অভিজাত ফ্ল্যাট, শোরুম থেকে ভাড়া নেওয়া ল্যান্ড ক্রুজার, ফেব্রুয়ারির ‘মোটরকেড’—সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়। দলের কেন্দ্রীয় বৈঠকেও তাঁর ‘অতিরঞ্জিত বিলাস’ ও ‘আর্থিক অনিয়মের’ অভিযোগ ওঠে।

রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানী ড. তানভীর মাহমুদ মনে করেন, হঠাৎ ক্ষমতার কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া প্রথম-প্রজন্মের নেতাদের মধ্যে ‘দ্রুত আয়-টুপি-আরোপ সিন্ড্রোম’ দেখা যায়—আদর্শ গড়ে ওঠার আগেই ভোগবিলাসের আকর্ষণ তাদের গ্রাস করে। ফলে ‘রাস্তায় ফেলা রক্তকে পুঁজি করে’ আন্দোলনের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠানবিরোধী ইমেজ রক্ষায় ব্যর্থ হয়।

ফাউন্ডেশনেই নানান বিতর্ক

শুধু ব্যক্তিগত বিলাস নয়, প্রতিষ্ঠানগত স্বচ্ছতার সংকটও প্রকট। ফাউন্ডেশনের সিইও মির মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ এই মাসের শুরুতেই পদত্যাগ করেছেন; অর্থ ব্যয়ের জবাবদিহি ও হতাহত পরিবারের অনুদান-বণ্টন নিয়ে প্রশ্নের মুখে তিনি ‘পড়াশোনার চাপ’ দেখিয়ে সরে যান।

অভিযোগ ওঠে, ফাউন্ডেশনের ১০০ কোটির বেশি তহবিল ব্যয়ের খতিয়ানের বড় অংশ ‘প্রশাসনিক খরচ’ হিসেবে দেখানো হয়েছে, অথচ টাকার সিংহভাগ এখনও ভুক্তভোগীর হাতে পৌঁঁছায়নি। বঞ্চিতেরা বলছেন, নিয়মিত অডিট ও সম্পত্তি ঘোষণার ব্যবস্থা না থাকলে এই প্রতিষ্ঠানের মানে দাঁড়ায়—ভবিষ্যৎ রাজনীতির ‘ওয়ার চেস্ট’।

সাম্প্রতিক বিষপান-ঘটনা প্রমাণ করল, আন্দোলন-পরবর্তী পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় বড় ফাঁক রয়ে গেছে। একদিকে আহতদের চিকিৎসা-খরচ, অন্যদিকে তদন্তের অজুহাতে ভোগান্তি দীর্ঘ হওয়ায় ক্ষোভ জমেছে। এর সঙ্গে নেতৃত্বের বিলাসিতা ঘিরে উঠছে নৈতিক প্রশ্ন: আন্দোলনের মূল আদর্শ—অবৈধ সুবিধা ও বৈষম্যের বিরোধিতা—নিজেদের জীবনেই টিকে থাকল কোথায়?

‘জুলাইয়ের কোটা আন্দোলন ও মেটিকুলাস ডিজাইন—সব মিলিয়ে হাসিনার পতন হলেও—ওই আন্দোলন ও ডিজাইনের নেতৃত্ব আজ আদর্শের পরীক্ষায় দাঁড়িয়ে। গুলিবিদ্ধ ছাত্ররা যখন বিষের বোতল তুলে নিচ্ছেন, তখন অভিজাত গাড়ির কাচ তুলছে সেই নেতৃত্ব—এটি তাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভবিষ্যৎ পরিণতি কী, সেই প্রশ্ন এখন আগুনের মতো জ্বলছে।’