০১:১৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫

খুলনা—দূরত্বের শহরে আহমেদের সংগ্রাম (পর্ব-৩)

এক সময় গ্রামের মেঠোপথে খাকি ব্যাগ ঝুলিয়ে যাওয়া পোস্টম্যানের পায়ের শব্দে মানুষ বুঝে নিত—চিঠি এসেছে। আজ সেই চিঠির জায়গা নিয়েছে স্ক্রিনের ‘নটিফিকেশন’, আর খাকি ব্যাগ বদলে গেছে বাইকের পিঠে বাঁধা বক্সে। এই নতুন যুগের “আধুনিক postal man”-রা হলেন আমাদের ডেলিভারি বয়—যাঁরা প্রতিদিন শহরের রক্তমোহনায় রোদ-বৃষ্টি পাড়ি দিয়ে পৌঁছে দেন ওষুধ, খাবার, বই, কখনও বা জন্মদিনের কেক ও প্রেমিকের চমক।

ড. সৌমিক দাসের ঝাঁঝালো গানের কথায়ই তাঁদের জীবনের সুর—

আমি সেই ডেলিভারি বয়কাঁধে স্বপ্নের বাক্স,
রোদ্দুর-বৃষ্টি মুছে ছুটে চলি দিন-রাত।’’

গানের পরের পংক্তিগুলো যেন আরও স্পষ্ট করে দেয় এই পেশার না-বলা লড়াই—

দেয়ালে টাঙানো ক্যালেন্ডারতারিখ শুধু বেতনহীন,
নীরব সিগন্যালে গল্প লিখে যায় হর্নের সুর।

বহুতল শহরের অগণন দরজায় তাঁদের নকই এখনকার ‘চিঠি-বেল’—

দরজায় কড়া নাড়িলিফটহীন সিঁড়ি পেরিয়ে,
বাড়ির ছাদে আলো জ্বলেফিরতি পথে একটাই ঠিকানা।

এই গান যেমন তাদের ক্লান্ত হাতের গল্প বলে, তেমনি হাড়ভাঙা খাটনি, অনিশ্চিত আয় আর ভারী ট্র্যাফিকেও লুকিয়ে থাকা দৃঢ় আশা—

ফুটপাতে ভাঙা স্বপ্নপকেটে সম্বল স্বল্প,
তবু হাসি মুখে বলে যাই—‘সার্ভিস অলওয়েজ অন-টাইম!’”

ডেলিভারি বয়রা সেই অবিরাম ছুটে চলা মানবিক সেতু, যাঁরা অফলাইনের কাঁধে অনলাইনকে বয়ে আনেন। তাঁদের আর্তি, আনন্দ, ঘাম, এবং স্বপ্ন মিলিয়ে যে কাব্য রচিত হয়, ‘ডেলিভারি বয়’ গানটি তার শব্দযাপন। এই সিরিজ-রিপোর্টে আমরা ঢাকার আরিফ থেকে সিলেটের রাজু পর্যন্ত পাঁচ শহরের পাঁচ জন ডেলিভারি বয়ের দিনমান, পরিবার, স্বপ্ন ও সংশয়ের বাঁকগুলো তুলে ধরব—আলোয়-অন্ধকারে যে জীবন, তা গানের পংক্তির মতোই সহজ-প্রাণ yet সংগ্রামী।

পাঠকের আহ্বান—চাইলে আপনি যখন পরের বার খাবার বা প্যাকেট হাতে নেবেন, মনে করবেন ওই প্যাকেটের গায়ে ভাসছে গানেরই লাইন:

আমি সেই ডেলিভারি বয়স্বপ্ন যে পৌঁছে দেই বাড়ি-বাড়ি।

বাংলাদেশের পাঁচ প্রধান সিটি’র ডেলিভারী বয়দের নিয়ে পাঁচ পর্বের ধারাবাহিক রিপোর্ট –


খুলনাদূরত্বের শহরে আহমেদের সংগ্রাম

রূপসা নদীর পূর্ব পাড়, আহমেদ আলির ঘর কাঠের বেড়া আর টিনের ছাউনি; সকাল ছয়টায় নদীর ওপারে ভেসে আসে আযানের ধ্বনি, তিনি হাতে তুলে নেন নিজের তিন বছরের পুরোনো ১০০-সিসি মোটরসাইকেলের চাবি।

ভোর (৬টা৯টা): কুরিয়ার প্রথম ধাক্কা
রূপসার শিববাড়ি ঘাট থেকে ৭টা ১৫-তে কুরিয়ার গুদাম—বস্ত্রপল্লির ডি-এইচএল সেন্টার। খুলনায় ফুড অর্ডার কম; মূল চাপ ব্যাঙ্কের ডকুমেন্ট কুরিয়ার আর অনলাইন পোশাকের প্যাকেট। প্রতিটি পার্সেল বাবদ তাকে মেলে ২০-২৫ টাকা, দিনে গড়ে ১৪-১৬টি ডেলিভারি। কিন্তু খুলনার রাস্তা দীর্ঘ ও ফাঁকা—প্রতিটি ডেলিভারিতে ৮-১০ কিলোমিটার, পেট্রোলে খরচ হয় ৬-৭ টাকা।

দুপুর (৯টা২টা): লম্বা রুটের একাকিত্ব
টিপিক্যাল দুপুরে তিনি সেনের বাজার হয়ে খানজাহান আলী সড়ক ধরে ডেপজিট দেখান পোস্ট অফিসে; দুপুর ১টায় মাত্র পাঁচ মিনিটের বিরতি। কখনো পকেট থেকে বের করা খেজুর আর বাদামই দুপুরের খাবার।

বিকেল-সন্ধ্যা (২টা৭টা): ফুড অর্ডারের ক্ষণিকা ঝাঁপ
খুলনা শহরে বিকেল পাঁচটার পরেই খাবার অর্ডার বাড়ে—বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রাবাস, হাসপাতালের গার্ডরা মিলে ‘বিকাশ পেমেন্ট’ দিয়ে বিরিয়ানি নেয়। ফ্ল্যাট ফি মাত্র ২৫ টাকা; তবু সন্ধ্যায় তিন-চারটি অর্ডার থেকে আরেকটু বাড়তি মেলে।

রাত (৭টা১০টা): নীরব ফেরত
নদীর ওপারের ঘাটে পৌঁছাতে রাত সাড়ে ন’টা; ঘরে ফিরে প্রথমে খোঁজ নেন বাবার ডায়াবেটিক ইনসুলিন আছে কি না। মা পুকুরপাড়ের শাক-সবজি তুলে বিদুতে রান্না করেন, আহমেদ পাশে এসে বসে মোবাইলে পরের দিনের পান্ডা দেখে নেন।

পরিবারের দায়
বাবা আগে জাহাজভাঙা কারখানায় ছিলেন; হাঁটুর সমস্যা নিয়ে এখন কর্মহীন। ছোট দুই ভাই মাদ্রাসায় পড়ে। মাসে আয় ১৫-১৬ হাজার। থেকে ৮-৯ হাজার বাড়িভাড়া ও সংসার খরচ, ২-৩ হাজার মা-বাবার ওষুধ; নিজের হাতে থাকে শুধু বাইকের কিস্তি পরিশোধের টাকা।

আহমেদের স্বাক্ষর স্বপ্ন
“অনেকের দুনিয়া ছোট; আমার বাইক আর বাবা-মার হাসিই বড় দুনিয়া। কিন্তু যদি একটা বীমা থাকত, অন্তত দুর্ঘটনায় পড়ে কাউকে ধার চাইতে হতো না,”—নিঃশব্দে বলেন আহমেদ।

খুলনা—দূরত্বের শহরে আহমেদের সংগ্রাম (পর্ব-৩)

০৬:০০:৫০ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৬ মে ২০২৫

এক সময় গ্রামের মেঠোপথে খাকি ব্যাগ ঝুলিয়ে যাওয়া পোস্টম্যানের পায়ের শব্দে মানুষ বুঝে নিত—চিঠি এসেছে। আজ সেই চিঠির জায়গা নিয়েছে স্ক্রিনের ‘নটিফিকেশন’, আর খাকি ব্যাগ বদলে গেছে বাইকের পিঠে বাঁধা বক্সে। এই নতুন যুগের “আধুনিক postal man”-রা হলেন আমাদের ডেলিভারি বয়—যাঁরা প্রতিদিন শহরের রক্তমোহনায় রোদ-বৃষ্টি পাড়ি দিয়ে পৌঁছে দেন ওষুধ, খাবার, বই, কখনও বা জন্মদিনের কেক ও প্রেমিকের চমক।

ড. সৌমিক দাসের ঝাঁঝালো গানের কথায়ই তাঁদের জীবনের সুর—

আমি সেই ডেলিভারি বয়কাঁধে স্বপ্নের বাক্স,
রোদ্দুর-বৃষ্টি মুছে ছুটে চলি দিন-রাত।’’

গানের পরের পংক্তিগুলো যেন আরও স্পষ্ট করে দেয় এই পেশার না-বলা লড়াই—

দেয়ালে টাঙানো ক্যালেন্ডারতারিখ শুধু বেতনহীন,
নীরব সিগন্যালে গল্প লিখে যায় হর্নের সুর।

বহুতল শহরের অগণন দরজায় তাঁদের নকই এখনকার ‘চিঠি-বেল’—

দরজায় কড়া নাড়িলিফটহীন সিঁড়ি পেরিয়ে,
বাড়ির ছাদে আলো জ্বলেফিরতি পথে একটাই ঠিকানা।

এই গান যেমন তাদের ক্লান্ত হাতের গল্প বলে, তেমনি হাড়ভাঙা খাটনি, অনিশ্চিত আয় আর ভারী ট্র্যাফিকেও লুকিয়ে থাকা দৃঢ় আশা—

ফুটপাতে ভাঙা স্বপ্নপকেটে সম্বল স্বল্প,
তবু হাসি মুখে বলে যাই—‘সার্ভিস অলওয়েজ অন-টাইম!’”

ডেলিভারি বয়রা সেই অবিরাম ছুটে চলা মানবিক সেতু, যাঁরা অফলাইনের কাঁধে অনলাইনকে বয়ে আনেন। তাঁদের আর্তি, আনন্দ, ঘাম, এবং স্বপ্ন মিলিয়ে যে কাব্য রচিত হয়, ‘ডেলিভারি বয়’ গানটি তার শব্দযাপন। এই সিরিজ-রিপোর্টে আমরা ঢাকার আরিফ থেকে সিলেটের রাজু পর্যন্ত পাঁচ শহরের পাঁচ জন ডেলিভারি বয়ের দিনমান, পরিবার, স্বপ্ন ও সংশয়ের বাঁকগুলো তুলে ধরব—আলোয়-অন্ধকারে যে জীবন, তা গানের পংক্তির মতোই সহজ-প্রাণ yet সংগ্রামী।

পাঠকের আহ্বান—চাইলে আপনি যখন পরের বার খাবার বা প্যাকেট হাতে নেবেন, মনে করবেন ওই প্যাকেটের গায়ে ভাসছে গানেরই লাইন:

আমি সেই ডেলিভারি বয়স্বপ্ন যে পৌঁছে দেই বাড়ি-বাড়ি।

বাংলাদেশের পাঁচ প্রধান সিটি’র ডেলিভারী বয়দের নিয়ে পাঁচ পর্বের ধারাবাহিক রিপোর্ট –


খুলনাদূরত্বের শহরে আহমেদের সংগ্রাম

রূপসা নদীর পূর্ব পাড়, আহমেদ আলির ঘর কাঠের বেড়া আর টিনের ছাউনি; সকাল ছয়টায় নদীর ওপারে ভেসে আসে আযানের ধ্বনি, তিনি হাতে তুলে নেন নিজের তিন বছরের পুরোনো ১০০-সিসি মোটরসাইকেলের চাবি।

ভোর (৬টা৯টা): কুরিয়ার প্রথম ধাক্কা
রূপসার শিববাড়ি ঘাট থেকে ৭টা ১৫-তে কুরিয়ার গুদাম—বস্ত্রপল্লির ডি-এইচএল সেন্টার। খুলনায় ফুড অর্ডার কম; মূল চাপ ব্যাঙ্কের ডকুমেন্ট কুরিয়ার আর অনলাইন পোশাকের প্যাকেট। প্রতিটি পার্সেল বাবদ তাকে মেলে ২০-২৫ টাকা, দিনে গড়ে ১৪-১৬টি ডেলিভারি। কিন্তু খুলনার রাস্তা দীর্ঘ ও ফাঁকা—প্রতিটি ডেলিভারিতে ৮-১০ কিলোমিটার, পেট্রোলে খরচ হয় ৬-৭ টাকা।

দুপুর (৯টা২টা): লম্বা রুটের একাকিত্ব
টিপিক্যাল দুপুরে তিনি সেনের বাজার হয়ে খানজাহান আলী সড়ক ধরে ডেপজিট দেখান পোস্ট অফিসে; দুপুর ১টায় মাত্র পাঁচ মিনিটের বিরতি। কখনো পকেট থেকে বের করা খেজুর আর বাদামই দুপুরের খাবার।

বিকেল-সন্ধ্যা (২টা৭টা): ফুড অর্ডারের ক্ষণিকা ঝাঁপ
খুলনা শহরে বিকেল পাঁচটার পরেই খাবার অর্ডার বাড়ে—বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রাবাস, হাসপাতালের গার্ডরা মিলে ‘বিকাশ পেমেন্ট’ দিয়ে বিরিয়ানি নেয়। ফ্ল্যাট ফি মাত্র ২৫ টাকা; তবু সন্ধ্যায় তিন-চারটি অর্ডার থেকে আরেকটু বাড়তি মেলে।

রাত (৭টা১০টা): নীরব ফেরত
নদীর ওপারের ঘাটে পৌঁছাতে রাত সাড়ে ন’টা; ঘরে ফিরে প্রথমে খোঁজ নেন বাবার ডায়াবেটিক ইনসুলিন আছে কি না। মা পুকুরপাড়ের শাক-সবজি তুলে বিদুতে রান্না করেন, আহমেদ পাশে এসে বসে মোবাইলে পরের দিনের পান্ডা দেখে নেন।

পরিবারের দায়
বাবা আগে জাহাজভাঙা কারখানায় ছিলেন; হাঁটুর সমস্যা নিয়ে এখন কর্মহীন। ছোট দুই ভাই মাদ্রাসায় পড়ে। মাসে আয় ১৫-১৬ হাজার। থেকে ৮-৯ হাজার বাড়িভাড়া ও সংসার খরচ, ২-৩ হাজার মা-বাবার ওষুধ; নিজের হাতে থাকে শুধু বাইকের কিস্তি পরিশোধের টাকা।

আহমেদের স্বাক্ষর স্বপ্ন
“অনেকের দুনিয়া ছোট; আমার বাইক আর বাবা-মার হাসিই বড় দুনিয়া। কিন্তু যদি একটা বীমা থাকত, অন্তত দুর্ঘটনায় পড়ে কাউকে ধার চাইতে হতো না,”—নিঃশব্দে বলেন আহমেদ।