০১:৫৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫

মোংলায় ‘সেঁজুতি’ জাহাজে ডাকাতি

সোমবার ভোররাতে পশুর চ্যানেলের বেসক্রিক এলাকায় নোঙর করা বাংলাদেশি পতাকাবাহী বাণিজ্যিক জাহাজ এমভি সেঁজুতি’-তে ১৪ জনের এক দল দস্যু হানা দেয়। দেশি অস্ত্রের মুখে সাতজন নাবিকের হাত-পা বেঁধে প্রায় তিন ঘণ্টাজুড়ে তাণ্ডব চালিয়ে তারা যন্ত্রাংশলোহার ওয়্যার রোপবেয়ারিংজ্বালানি ও মোবাইল ফোনসহ মোট প্রায় ৫০ লাখ টাকার মালামাল লুট করেআহত হয়েছেন তিন নাবিক। পাথর খালাসের পর গত জুন থেকে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে জাহাজটি চ্যানেলে পড়ে ছিল বলে কর্তৃপক্ষ জানায়।

বারবার আক্রান্ত এমভি সেঁজুতি
জাহাজটির লোকাল এজেন্ট আল সাফা শিপিং লাইনস’ জানায়গত এক বছরে এটি আগেও দুই দফা ডাকাতির শিকার হয়েছেতবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে অভিযোগ দিয়েও প্রতিকার মেলেনি। শেষ হামলার পর কোস্টগার্ড পশ্চিম জোন দস্যুদমন অভিযান শুরু করেছে বলে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার হারুন-অর-রশিদ সাংবাদিকদের জানান।

নদীপথে সংগঠিত গ্যাংগুলোর গতিবিধি
মার্চে কোস্টগার্ড সুমন বাহিনী’ নামের সংঘবদ্ধ চক্রের পাঁচ সদস্যকে পশুর চ্যানেলেই অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করেযাদের বিরুদ্ধে একাধিক জলদস্যুতার মামলা রয়েছে।
এর আগে ৬ মে সুন্দরবনের আদা চাঁচি এলাকায় করিম শরীফ বাহিনীর দুই দস্যু অস্ত্রগুলি ও ২৮টি মোবাইলসহ আটক হয়।
স্থানীয় শিপিং কর্মীদের মতেএকাধিক ছোট গোষ্ঠী নদী ও বনাঞ্চল জুড়ে পেটি পাইরেসি’ চালিয়ে যাচ্ছেসুযোগ পাচ্ছে অন্ধকারে নোঙর করা বা দীর্ঘদিন পড়ে থাকা জাহাজে।

পরিসংখ্যানের ভাষায় নিরাপত্তাজট
আন্তঃজাতিক সামুদ্রিক ব্যুরোর (আইসিসি-আইএমবি) ২০২৪-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছেবাংলাদেশি নোঙর এলাকায় গত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ ১৪টি সশস্ত্র হামলার রেকর্ড হয়েছেএর মধ্যে চট্টগ্রামে ১৩টি ও মোংলা চ্যানেলে ১টি। (ICC Commercial Crime Services)
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেনঘটনাগুলো নিম্ন স্তরের’ হলেও ক্রু জিম্মি কিংবা আহত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছেবীমা প্রিমিয়াম ও ভাড়া ব্যয়ও এতে বাড়তে পারে।

বন্দরের অর্থনৈতিক স্বার্থ
মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্যানুযায়ী২০২৫ সালের জানুয়ারি-জুনে ৪১৩টি বিদেশি বাণিজ্যিক জাহাজ এসেছেটিইইউ হ্যান্ডলিং ও রাজস্বদুটিতেই প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে।
বিমর্যাড-এর মার্চ বুলেটিন জানায়২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসেই বন্দরে ভিড়েছে ৪৯৬টি বিদেশি জাহাজ এবং পণ্য আয়তন ছিল ৬৫ লাখ টনের বেশিযা আগের বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি।
এই বাড়তি প্রবাহে নিরাপত্তাহীনতার খবর আন্তর্জাতিক শিপিং কমিউনিটিতে নেতিবাচক বার্তা দিতে পারেযা বন্দরের ব্যবসা-বান্ধব’ ইমেজকে ক্ষুণ্ণ করবে বলে শঙ্কা করছেন অপারেটররা।

কোস্টগার্ড-বন্দর কর্তৃপক্ষের করণীয়
• রাত্রিকালীন যৌথ টহল ও মোবাইল কিউআর টিম বাড়ানো
• এআইএস-সজ্জিত সিসিটিভি ও ভিটিএস কভারেজ বিস্তৃত করে চ্যানেলের ব্লাইন্ড স্পট কমানো
• জবরদস্তি পণ্য মজুত বা স্ক্র্যাপ বিক্রির পথে নজরদারি
• দস্যুচক্রের আর্থিক লেনদেন শনাক্তে বিএফআইইউসহ সমন্বিত অভিযান

শিপিং এজেন্ট ও নাবিক ইউনিয়নের দাবিজাহাজ ছেড়ে দেওয়ার আগে দীর্ঘস্থায়ী রাডার-ডাউন’, ‘ইঞ্জিন-ফল্ট’ জাতীয় সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধানে বন্দর ও পতাকাধারী কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করতে হবেনা হলে ইচ্ছাকৃত লয়েড্‌স অবৈধ অবস্থান’ নানা অপরাধের সুযোগ তৈরি করে।

বিশেষজ্ঞ অভিমত
সমুদ্র নিরাপত্তা বিশ্লেষক কমোডর (অব.) এমদাদ-উল-আলম মনে করেন, “নদীপথে ছোট অস্ত্রে সজ্জিত দস্যু বাহিনীকে প্রতিহত করতে স্থল-বন-নদীর সমন্বিত কমান্ড স্ট্রাকচার জরুরিশুধু অপারেশনের পরপর দ্রুত সংবাদ সম্মেলন নয়নিয়মিত গোয়েন্দা ম্যাপিং দরকার।” তিনি আইএমবি-এর হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী নোঙর এলাকায় জাহাজমালিক-ক্যাপ্টেনদের সতর্কতামূলক চেকলিস্ট’ বাধ্যতামূলক করার পরামর্শ দেন।

উপসংহার
এমভি সেঁজুতি’-তে বারবার ডাকাতি মোংলা বন্দরের নিরাপত্তা কাঠামোকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ক্রু জিম্মি ঝুঁকি কমাতে দ্রুত বিচারদৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি বাড়ানো এখন সময়ের দাবিনয়তো বাড়তি জাহাজ প্রবাহের অর্জনই আখেরে ক্ষতিতে রূপ নেবে।

মোংলায় ‘সেঁজুতি’ জাহাজে ডাকাতি

০৬:১০:০৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৬ মে ২০২৫

সোমবার ভোররাতে পশুর চ্যানেলের বেসক্রিক এলাকায় নোঙর করা বাংলাদেশি পতাকাবাহী বাণিজ্যিক জাহাজ এমভি সেঁজুতি’-তে ১৪ জনের এক দল দস্যু হানা দেয়। দেশি অস্ত্রের মুখে সাতজন নাবিকের হাত-পা বেঁধে প্রায় তিন ঘণ্টাজুড়ে তাণ্ডব চালিয়ে তারা যন্ত্রাংশলোহার ওয়্যার রোপবেয়ারিংজ্বালানি ও মোবাইল ফোনসহ মোট প্রায় ৫০ লাখ টাকার মালামাল লুট করেআহত হয়েছেন তিন নাবিক। পাথর খালাসের পর গত জুন থেকে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে জাহাজটি চ্যানেলে পড়ে ছিল বলে কর্তৃপক্ষ জানায়।

বারবার আক্রান্ত এমভি সেঁজুতি
জাহাজটির লোকাল এজেন্ট আল সাফা শিপিং লাইনস’ জানায়গত এক বছরে এটি আগেও দুই দফা ডাকাতির শিকার হয়েছেতবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে অভিযোগ দিয়েও প্রতিকার মেলেনি। শেষ হামলার পর কোস্টগার্ড পশ্চিম জোন দস্যুদমন অভিযান শুরু করেছে বলে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার হারুন-অর-রশিদ সাংবাদিকদের জানান।

নদীপথে সংগঠিত গ্যাংগুলোর গতিবিধি
মার্চে কোস্টগার্ড সুমন বাহিনী’ নামের সংঘবদ্ধ চক্রের পাঁচ সদস্যকে পশুর চ্যানেলেই অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করেযাদের বিরুদ্ধে একাধিক জলদস্যুতার মামলা রয়েছে।
এর আগে ৬ মে সুন্দরবনের আদা চাঁচি এলাকায় করিম শরীফ বাহিনীর দুই দস্যু অস্ত্রগুলি ও ২৮টি মোবাইলসহ আটক হয়।
স্থানীয় শিপিং কর্মীদের মতেএকাধিক ছোট গোষ্ঠী নদী ও বনাঞ্চল জুড়ে পেটি পাইরেসি’ চালিয়ে যাচ্ছেসুযোগ পাচ্ছে অন্ধকারে নোঙর করা বা দীর্ঘদিন পড়ে থাকা জাহাজে।

পরিসংখ্যানের ভাষায় নিরাপত্তাজট
আন্তঃজাতিক সামুদ্রিক ব্যুরোর (আইসিসি-আইএমবি) ২০২৪-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছেবাংলাদেশি নোঙর এলাকায় গত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ ১৪টি সশস্ত্র হামলার রেকর্ড হয়েছেএর মধ্যে চট্টগ্রামে ১৩টি ও মোংলা চ্যানেলে ১টি। (ICC Commercial Crime Services)
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেনঘটনাগুলো নিম্ন স্তরের’ হলেও ক্রু জিম্মি কিংবা আহত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছেবীমা প্রিমিয়াম ও ভাড়া ব্যয়ও এতে বাড়তে পারে।

বন্দরের অর্থনৈতিক স্বার্থ
মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্যানুযায়ী২০২৫ সালের জানুয়ারি-জুনে ৪১৩টি বিদেশি বাণিজ্যিক জাহাজ এসেছেটিইইউ হ্যান্ডলিং ও রাজস্বদুটিতেই প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে।
বিমর্যাড-এর মার্চ বুলেটিন জানায়২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসেই বন্দরে ভিড়েছে ৪৯৬টি বিদেশি জাহাজ এবং পণ্য আয়তন ছিল ৬৫ লাখ টনের বেশিযা আগের বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি।
এই বাড়তি প্রবাহে নিরাপত্তাহীনতার খবর আন্তর্জাতিক শিপিং কমিউনিটিতে নেতিবাচক বার্তা দিতে পারেযা বন্দরের ব্যবসা-বান্ধব’ ইমেজকে ক্ষুণ্ণ করবে বলে শঙ্কা করছেন অপারেটররা।

কোস্টগার্ড-বন্দর কর্তৃপক্ষের করণীয়
• রাত্রিকালীন যৌথ টহল ও মোবাইল কিউআর টিম বাড়ানো
• এআইএস-সজ্জিত সিসিটিভি ও ভিটিএস কভারেজ বিস্তৃত করে চ্যানেলের ব্লাইন্ড স্পট কমানো
• জবরদস্তি পণ্য মজুত বা স্ক্র্যাপ বিক্রির পথে নজরদারি
• দস্যুচক্রের আর্থিক লেনদেন শনাক্তে বিএফআইইউসহ সমন্বিত অভিযান

শিপিং এজেন্ট ও নাবিক ইউনিয়নের দাবিজাহাজ ছেড়ে দেওয়ার আগে দীর্ঘস্থায়ী রাডার-ডাউন’, ‘ইঞ্জিন-ফল্ট’ জাতীয় সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধানে বন্দর ও পতাকাধারী কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করতে হবেনা হলে ইচ্ছাকৃত লয়েড্‌স অবৈধ অবস্থান’ নানা অপরাধের সুযোগ তৈরি করে।

বিশেষজ্ঞ অভিমত
সমুদ্র নিরাপত্তা বিশ্লেষক কমোডর (অব.) এমদাদ-উল-আলম মনে করেন, “নদীপথে ছোট অস্ত্রে সজ্জিত দস্যু বাহিনীকে প্রতিহত করতে স্থল-বন-নদীর সমন্বিত কমান্ড স্ট্রাকচার জরুরিশুধু অপারেশনের পরপর দ্রুত সংবাদ সম্মেলন নয়নিয়মিত গোয়েন্দা ম্যাপিং দরকার।” তিনি আইএমবি-এর হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী নোঙর এলাকায় জাহাজমালিক-ক্যাপ্টেনদের সতর্কতামূলক চেকলিস্ট’ বাধ্যতামূলক করার পরামর্শ দেন।

উপসংহার
এমভি সেঁজুতি’-তে বারবার ডাকাতি মোংলা বন্দরের নিরাপত্তা কাঠামোকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ক্রু জিম্মি ঝুঁকি কমাতে দ্রুত বিচারদৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি বাড়ানো এখন সময়ের দাবিনয়তো বাড়তি জাহাজ প্রবাহের অর্জনই আখেরে ক্ষতিতে রূপ নেবে।