০২:৩২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

ধ্বনিময় দেওয়ালপত্র নয়—শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে আবারও গুরুত্ব দিতে হবে

জকাল প্রায়ই দেখা যায়শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে রেডিও স্টেশনচলচ্চিত্র কিংবা টেলিভিশনে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বা আনন্দদায়ক শব্দপ্রবাহ” হিসেবে ব্যবহার করা হয়ঠিক যেন একটি শব্দময় দেওয়ালপত্র বা আরামদায়ক স্নান। ফলেযেসব সঙ্গীত এই শ্রেণিতে পড়ে নাসেগুলো ক্রমেই অবহেলিত হচ্ছে। এসব সৃষ্টি এখন কেবল এক ক্ষীণ মেধাবী শ্রোতা শ্রেণির অনুসন্ধানেই সীমাবদ্ধ।

রাখমানিনভের নাম নিলে বেশিরভাগ মানুষ কেবল তাঁর পিয়ানো কনচের্তো, ‘র‍্যাপসোডি অন এ থিম অব পাগানিনি’, ‘ভেসপার্স’ বা দ্বিতীয় সিম্ফনির কথাই মনে করেন। অথচলন্ডনের সিনফোনিয়া ও জন উইলসনের পরিচালনায় চ্যান্ডস থেকে সদ্য প্রকাশিত তাঁর প্রথম সিম্ফনির এক নতুন রেকর্ডিং আমাদের মনে করিয়ে দেয়এই কম পরিচিত কাজটিও ছিল এক নিখাদ প্রতিভার নিদর্শনযা আমরা প্রায় হারিয়েই ফেলেছিলাম।

রাখমানিনভ অনেকটাই ছিলেন তাঁর শ্রদ্ধেয় চায়কোভস্কির সঙ্গীতিক উত্তরসূরি। ১৮৯৩ সালে চায়কোভস্কির মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২০এবং সেই থেকে তিনি প্রথমবারের মতো রচনাকর্মে সংগ্রামে পড়েন। তবে ১৮৯৫ সালের জানুয়ারিতে এক রুশ অর্থোডক্স গির্জার গীত থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি প্রথম সিম্ফনি’ রচনা শুরু করেন। তাঁর সৃষ্টিশীলতা ফিরে আসে এবং সে বছরের সেপ্টেম্বরেই রচনাটি সম্পন্ন হয়। কিন্তু ১৮৯৭ সালের মার্চে সেন্ট পিটার্সবার্গে এই সিম্ফনির উদ্বোধনী পরিবেশনা ছিল এক বিপর্যয়।

এই ব্যর্থতার অনেকাংশের দায় বর্তেছিল কন্ডাক্টর গ্লাজুনভের ওপরযিনি অল্প মহড়ায় এক অপরিচিত রচনাকে উপস্থাপন করেন এক তেমনই অচেনা ধ্বনিমণ্ডলেযা শ্রোতা ও সঙ্গীতজ্ঞদের জন্যই নতুন ছিল। যদিও সিম্ফনিটি চায়কোভস্কিকে শ্রদ্ধা জানায় এবং প্রচলিত ফর্ম অনুসরণ করেতবুও তৎকালীন সময়ের প্রেক্ষিতে এটি ছিল স্পষ্টভাবে অগ্রসরচিন্তার প্রতিফলন। এর ওপরগ্লাজুনভ ছিলেন মদ্যপরাখমানিনভের স্ত্রীর মতেতিনি সেই পরিবেশনার দিন মাতাল অবস্থায় ছিলেন।

একজন প্রবীণ রক্ষণশীল সমালোচক একে মিশরের দশটি বিপদের প্রতিচ্ছবি বলেও বর্ণনা করেছিলেন। কিন্তু সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় ছিলরচনাটি নিজেও সেদিন হতাশায় ডুবে গিয়েছিলেন এবং বুঝতে পারেননি গ্লাজুনভের বাজে পরিচালনার কারণে তাঁর সঙ্গীতের প্রকৃত সৌন্দর্য কীভাবে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল।

রাখমানিনভ গভীর হতাশায় ডুবে যান এবং কয়েক মাস পর সম্ভবত যা আজকের ভাষায় মানসিক ভেঙে পড়া’ হিসেবে বর্ণনা করা যায়তেমন এক অবস্থা পার করেন। এরপর ১৯০০ সাল পর্যন্ত তিনি আর কিছু রচনা করতে পারেননি। বিস্ময়করভাবেতিনি রচনাটি পুড়িয়ে ফেলেননি বা ছিঁড়ে ফেলেননিযেমনটি একসময় তিনি হুমকি দিয়েছিলেন। এমনকি ১৯০৮ সালের দিকে দ্বিতীয় সিম্ফনির জনপ্রিয়তা পাওয়ার পর তিনি এটি আবার দেখার কথা ভাবেনকিন্তু আর করেননি। ১৯১৭ সালে রাশিয়া ত্যাগের সময় তিনি এই সিম্ফনির মূল স্কোরটিও সঙ্গে নেননি এবং এক বন্ধুকে বলেনতিনি আর কখনও কাউকে এটি দেখাবেন নাশুনানো তো দূরের কথাএবং বছরের পর বছর এটি হারিয়ে যায়।

মূল পাণ্ডুলিপিটি সত্যিই হারিয়ে যায়। তিনি এটি তাঁর মস্কোর ফ্ল্যাটের ডেস্কে তালাবদ্ধ অবস্থায় রেখে গিয়েছিলেন। চাবিটি তাঁর এক সাবেক গৃহপরিচারিকার হাতে গিয়েছিলযিনি তাঁর রচনাসমূহ মস্কোর একটি জাদুঘরে স্থানান্তরে সহায়তা করেছিলেনকিন্তু এই রচনাটি তাতে ছিল না।

এক দুর্লভ সৌভাগ্যে১৯৪৪ সালেরাখমানিনভের মৃত্যুর এক বছর পর ও অবরুদ্ধ লেনিনগ্রাদের মুক্তির শেষেশহরটির কনজারভেটরির গ্রন্থাগারে পাওয়া যায় সেই একমাত্র পরিবেশনার অর্কেস্ট্রাল পার্টস। রুশ কন্ডাক্টর গাউকের তত্ত্বাবধানে গবেষকরা সিম্ফনিটি পুনর্গঠনে সক্ষম হন এবং ১৯৪৫ সালের অক্টোবরে৪৮ বছর পরহয় এর দ্বিতীয় পরিবেশনা।

প্রথম সমালোচকদের অজ্ঞতা তখনই উন্মোচিত হয় এবং এরপর এই সিম্ফনি বিশ্বব্যাপী পরিবেশিত হতে শুরু করে। শুধু রাখমানিনভের ততকালে অর্জিত খ্যাতির কারণে নয়বরং কারণ এটি এক অসাধারণ সৃষ্টি হিসেবে তখন চিহ্নিত হয়। এটি আজও পরিবেশিত হয় এবং উইলসনের এই অপরিহার্য রেকর্ডিং হল বহু মহান কন্ডাক্টরের (যেমন আশকেনাজিওরম্যান্ডিপ্রেভিন) ধারাবাহিকতায় সাম্প্রতিকতম সংযোজন।

অবশ্যইরাখমানিনভের অধিকাংশ সঙ্গীতের মতো এটিও একসময় টেলিভিশন কর্তৃক ব্যবহৃত হয়েছে। নির্দিষ্ট প্রজন্মের পাঠকরা সিম্ফনির চতুর্থ অংশের যে বিজয়ী যুদ্ধবাদ্য থিমটি (যা উইলসন অত্যন্ত জোরালোভাবে উপস্থাপন করেছেন) শুনবেনসেটিকে চিনে নিতে পারবেনকারণ এটি ১৯৬০-এর দশকে বিবিসির প্যানোরামা‘ অনুষ্ঠানের সূচনাতেই বাজানো হতো। উইলসনের নতুন রেকর্ডিংয়ে কিছুই অনুপস্থিত নয় এবং যাঁরা এই অসাধারণ সিম্ফনিটি এখনো শোনেননিতাঁদের জন্য এটি এক নিখুঁত সুযোগ।

ধ্বনিময় দেওয়ালপত্র নয়—শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে আবারও গুরুত্ব দিতে হবে

০৭:০০:১৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৭ মে ২০২৫

জকাল প্রায়ই দেখা যায়শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে রেডিও স্টেশনচলচ্চিত্র কিংবা টেলিভিশনে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বা আনন্দদায়ক শব্দপ্রবাহ” হিসেবে ব্যবহার করা হয়ঠিক যেন একটি শব্দময় দেওয়ালপত্র বা আরামদায়ক স্নান। ফলেযেসব সঙ্গীত এই শ্রেণিতে পড়ে নাসেগুলো ক্রমেই অবহেলিত হচ্ছে। এসব সৃষ্টি এখন কেবল এক ক্ষীণ মেধাবী শ্রোতা শ্রেণির অনুসন্ধানেই সীমাবদ্ধ।

রাখমানিনভের নাম নিলে বেশিরভাগ মানুষ কেবল তাঁর পিয়ানো কনচের্তো, ‘র‍্যাপসোডি অন এ থিম অব পাগানিনি’, ‘ভেসপার্স’ বা দ্বিতীয় সিম্ফনির কথাই মনে করেন। অথচলন্ডনের সিনফোনিয়া ও জন উইলসনের পরিচালনায় চ্যান্ডস থেকে সদ্য প্রকাশিত তাঁর প্রথম সিম্ফনির এক নতুন রেকর্ডিং আমাদের মনে করিয়ে দেয়এই কম পরিচিত কাজটিও ছিল এক নিখাদ প্রতিভার নিদর্শনযা আমরা প্রায় হারিয়েই ফেলেছিলাম।

রাখমানিনভ অনেকটাই ছিলেন তাঁর শ্রদ্ধেয় চায়কোভস্কির সঙ্গীতিক উত্তরসূরি। ১৮৯৩ সালে চায়কোভস্কির মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২০এবং সেই থেকে তিনি প্রথমবারের মতো রচনাকর্মে সংগ্রামে পড়েন। তবে ১৮৯৫ সালের জানুয়ারিতে এক রুশ অর্থোডক্স গির্জার গীত থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি প্রথম সিম্ফনি’ রচনা শুরু করেন। তাঁর সৃষ্টিশীলতা ফিরে আসে এবং সে বছরের সেপ্টেম্বরেই রচনাটি সম্পন্ন হয়। কিন্তু ১৮৯৭ সালের মার্চে সেন্ট পিটার্সবার্গে এই সিম্ফনির উদ্বোধনী পরিবেশনা ছিল এক বিপর্যয়।

এই ব্যর্থতার অনেকাংশের দায় বর্তেছিল কন্ডাক্টর গ্লাজুনভের ওপরযিনি অল্প মহড়ায় এক অপরিচিত রচনাকে উপস্থাপন করেন এক তেমনই অচেনা ধ্বনিমণ্ডলেযা শ্রোতা ও সঙ্গীতজ্ঞদের জন্যই নতুন ছিল। যদিও সিম্ফনিটি চায়কোভস্কিকে শ্রদ্ধা জানায় এবং প্রচলিত ফর্ম অনুসরণ করেতবুও তৎকালীন সময়ের প্রেক্ষিতে এটি ছিল স্পষ্টভাবে অগ্রসরচিন্তার প্রতিফলন। এর ওপরগ্লাজুনভ ছিলেন মদ্যপরাখমানিনভের স্ত্রীর মতেতিনি সেই পরিবেশনার দিন মাতাল অবস্থায় ছিলেন।

একজন প্রবীণ রক্ষণশীল সমালোচক একে মিশরের দশটি বিপদের প্রতিচ্ছবি বলেও বর্ণনা করেছিলেন। কিন্তু সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় ছিলরচনাটি নিজেও সেদিন হতাশায় ডুবে গিয়েছিলেন এবং বুঝতে পারেননি গ্লাজুনভের বাজে পরিচালনার কারণে তাঁর সঙ্গীতের প্রকৃত সৌন্দর্য কীভাবে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল।

রাখমানিনভ গভীর হতাশায় ডুবে যান এবং কয়েক মাস পর সম্ভবত যা আজকের ভাষায় মানসিক ভেঙে পড়া’ হিসেবে বর্ণনা করা যায়তেমন এক অবস্থা পার করেন। এরপর ১৯০০ সাল পর্যন্ত তিনি আর কিছু রচনা করতে পারেননি। বিস্ময়করভাবেতিনি রচনাটি পুড়িয়ে ফেলেননি বা ছিঁড়ে ফেলেননিযেমনটি একসময় তিনি হুমকি দিয়েছিলেন। এমনকি ১৯০৮ সালের দিকে দ্বিতীয় সিম্ফনির জনপ্রিয়তা পাওয়ার পর তিনি এটি আবার দেখার কথা ভাবেনকিন্তু আর করেননি। ১৯১৭ সালে রাশিয়া ত্যাগের সময় তিনি এই সিম্ফনির মূল স্কোরটিও সঙ্গে নেননি এবং এক বন্ধুকে বলেনতিনি আর কখনও কাউকে এটি দেখাবেন নাশুনানো তো দূরের কথাএবং বছরের পর বছর এটি হারিয়ে যায়।

মূল পাণ্ডুলিপিটি সত্যিই হারিয়ে যায়। তিনি এটি তাঁর মস্কোর ফ্ল্যাটের ডেস্কে তালাবদ্ধ অবস্থায় রেখে গিয়েছিলেন। চাবিটি তাঁর এক সাবেক গৃহপরিচারিকার হাতে গিয়েছিলযিনি তাঁর রচনাসমূহ মস্কোর একটি জাদুঘরে স্থানান্তরে সহায়তা করেছিলেনকিন্তু এই রচনাটি তাতে ছিল না।

এক দুর্লভ সৌভাগ্যে১৯৪৪ সালেরাখমানিনভের মৃত্যুর এক বছর পর ও অবরুদ্ধ লেনিনগ্রাদের মুক্তির শেষেশহরটির কনজারভেটরির গ্রন্থাগারে পাওয়া যায় সেই একমাত্র পরিবেশনার অর্কেস্ট্রাল পার্টস। রুশ কন্ডাক্টর গাউকের তত্ত্বাবধানে গবেষকরা সিম্ফনিটি পুনর্গঠনে সক্ষম হন এবং ১৯৪৫ সালের অক্টোবরে৪৮ বছর পরহয় এর দ্বিতীয় পরিবেশনা।

প্রথম সমালোচকদের অজ্ঞতা তখনই উন্মোচিত হয় এবং এরপর এই সিম্ফনি বিশ্বব্যাপী পরিবেশিত হতে শুরু করে। শুধু রাখমানিনভের ততকালে অর্জিত খ্যাতির কারণে নয়বরং কারণ এটি এক অসাধারণ সৃষ্টি হিসেবে তখন চিহ্নিত হয়। এটি আজও পরিবেশিত হয় এবং উইলসনের এই অপরিহার্য রেকর্ডিং হল বহু মহান কন্ডাক্টরের (যেমন আশকেনাজিওরম্যান্ডিপ্রেভিন) ধারাবাহিকতায় সাম্প্রতিকতম সংযোজন।

অবশ্যইরাখমানিনভের অধিকাংশ সঙ্গীতের মতো এটিও একসময় টেলিভিশন কর্তৃক ব্যবহৃত হয়েছে। নির্দিষ্ট প্রজন্মের পাঠকরা সিম্ফনির চতুর্থ অংশের যে বিজয়ী যুদ্ধবাদ্য থিমটি (যা উইলসন অত্যন্ত জোরালোভাবে উপস্থাপন করেছেন) শুনবেনসেটিকে চিনে নিতে পারবেনকারণ এটি ১৯৬০-এর দশকে বিবিসির প্যানোরামা‘ অনুষ্ঠানের সূচনাতেই বাজানো হতো। উইলসনের নতুন রেকর্ডিংয়ে কিছুই অনুপস্থিত নয় এবং যাঁরা এই অসাধারণ সিম্ফনিটি এখনো শোনেননিতাঁদের জন্য এটি এক নিখুঁত সুযোগ।