এক রাত, দুইটি নিঃশ্বাস—চিরতরে থেমে গেল
রবিবার রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার কুড়ের পাড়ের একটি ছোট ঘরে ছেলেমেয়ে রেখে একসঙ্গে পৃথিবী ছেড়ে গেলেন আল আমিন (২৫) ও জরিনা (২০)।
তারা কোনো অপরাধী ছিলেন না, কোনো রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকারও নন—তাদের একমাত্র অপরাধ ছিল ‘অভাব’।
আল আমিন ছিলেন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার চালক। জীবনের সর্বস্ব দিয়ে একটা ইজিবাইক কিস্তিতে কেনেন। সেটা দিয়েই চলছিল ছোট সংসার। কিন্তু কয়েকদিন আগে চেপে বসে দেনার ভার। কোনো উপায় না পেয়ে ইজিবাইকটিও বিক্রি করে দেন। আর তখনই যেন সংসারের ভিতটা নড়বড়ে হয়ে যায়।
আত্মীয়-স্বজনের কাছে হাত পাততে না পেরে, দিনমজুরি জোটাতে না পেরে, অর্ধভোজন আর অভিমান নিয়ে শেষবারের মতো জরিনা ও আল আমিন সিদ্ধান্ত নেন—এই পৃথিবীতে তাদের আর জায়গা নেই।
‘কিস্তি’ নয়, শেষ কিস্তি ছিল সেটা
জরিনার ভাই আনোয়ার হোসেন বলেন, “ওদের সংসারে খুব টানাটানি ছিল। ইজিবাইকটা বিক্রি করার পর প্রায়ই ঝগড়া হতো। কিন্তু ভাবিনি এত বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে নেবে।”
রবিবার রাতে তারা একসঙ্গে বিষাক্ত কেরির ট্যাবলেট খেয়ে শুয়ে পড়েন। হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান জরিনা। রাত ১টার দিকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন আল আমিন। তাদের দুই সন্তান—একজন ছেলে, একজন মেয়ে—এখন বেঁচে আছে অথচ সবচেয়ে ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন নিয়ে।
বাস্তব চিত্র: দারিদ্র্য আর ক্ষুধার বাংলাদেশ
গত ৯ মাসে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার প্রায় ৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা এশিয়ার মধ্যে অন্যতম দ্রুতগতির।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি ও বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের আগস্টে শহরাঞ্চলে নতুন করে ১৮ লাখ মানুষ দারিদ্র্যের নিচে চলে গেছে, গ্রামাঞ্চলে সংখ্যাটা প্রায় ২৫ লাখ।
এর প্রধান কারণ:
- জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়া
- প্রোটিনজাত খাবারের মূল্য বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যাওয়া
- স্বাস্থ্যসেবা, গৃহভাড়া ও শিক্ষাব্যয়ের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি
ডিমের দাম ১৫-১৮ টাকা, এক কেজি মুরগি ২৮০-৩০০ টাকা, মাছ তো এখন রীতিমতো বিলাসিতা।
আর ডাল? একসময় গরিবের খাবার ছিল, এখন সেটাও হাতের বাইরে।
কেবল আল আমিন না, এমন হাজারো গল্প জমে আছে
রাজধানী ঢাকার বস্তিতে থাকা রিকশাচালক রুহুল আমিন বলেন, “সন্ধ্যায় বাচ্চারা ডিম চাইলে বলি—কাল কিনব। ওই ‘কাল’টা কখনো আসে না।”
অন্যদিকে রাজশাহীর মোহনপুরের দিনমজুর নুরজাহান বলেন, “মেয়েটা আগে রোজ ফল খেত—আম, কাঁঠাল। এখন শুধু পানি খেয়ে ঘুমায়।”
সরকার ও সমাজের কাছে প্রশ্ন
আল আমিন ও জরিনার মৃত্যুর জন্য দায়ী কে?
শুধু অভাব, না আমাদের সামষ্টিক ব্যর্থতা?
একটি পরিবার ধ্বংস হলো—কিন্তু সমাজ কি একটু থামবে, ভাববে?
শেষ কথা
একটি ফ্রেমে হাস্যোজ্জ্বল ছবি—আল আমিন, জরিনা ও তাদের দুই সন্তান।
আজ সেই ফ্রেমে নেই বাবা-মা, রয়ে গেছে শুধু দুটি চোখ ভেজা শিশু, যারা জানেই না কেন তাদের ছোট্ট পৃথিবী এত তাড়াতাড়ি ভেঙে গেল।
অভাব কখনো সংখ্যায় ধরা যায় না।
তাকে ছোঁয়া যায়—একটি আত্মহত্যার খবরের ভেতরে, একটি শোকাভিভূত শিশুর চোখে।