খুলনার নিম্নাঞ্চলের বুকে বর্ণাঢ্য শস্যচাষের একসময় সোনালী অধ্যায় ছিল—ধানক্ষেতের শ্যামল রেখা, কলাবাগানের ঝর্ণাধার, ভুট্টার সোনালি গ্রন্থি আর নানা রঙের শাকসবজির সারি। সেই জমিতে আজকের চিত্র যেন এক ভিন্ন বাস্তবতার আভাস: লবণজলে প্রতিনিয়ত সিক্ত হয়ে উঠছে চিংড়ি পুকুর, আর পুরনো ফসলেরা পরিচ্ছন্নতা হারিয়ে অতীতের স্মৃতিতে ছায়া ফেলে।
গত দশক জুড়ে হয়ে উঠেছে চিংড়ি বিপ্লব। ঝড়ের গতিতে বেড়েছে চিংড়ি চাষের পুকুর, অর্থনৈতিক উৎসাহকেই প্রধান প্রেরণা হিসেবে নিয়েছে স্থানীয় কৃষক। কিন্তু এই লাভের সঙ্গে পিছনে ফেলে এসেছে ভাত, শাকসবজি ও মৌসুমী ফলের রসালো বৈচিত্র্য—যে ফসলগুলো একসময় বাজার এবং ঘরের খাদ্যতালিকাকে সুষম করে তুলত। ফলস্বরূপ, গৃহস্থ শিশুদের চলছে মৌসুমী ফলাবর্জনার দুঃখ—সেসব আম, লিচু, বিভিন্ন ফল এখন ইতিহাসের পাতায় রূপ নিয়েছে।
এই পাঁচ পর্বের সিরিজে আমরা অনুসন্ধান করবো: কী করে খুলনার কৃষকদের জীবিকা বদলে দিয়েছে চিংড়ির উচ্চমূল্য; হারিয়ে যাওয়া ফসলগুলো ফিরিয়ে আনতে কি কোনো পথ রয়েছে; খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি সংকটের মুখে গ্রামের মানুষদের সংগ্রাম; পাশাপাশি পরিবেশগত প্রভাব, সামুদ্রিক লবণের ছোঁয়া আর সরকারের কৃষি নীতি কতটা ভূমিকা রাখছে এই পরিবর্তনে। থাকছে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের গল্প এবং বাস্তবতার চিত্র, যার আলোকে আমরা তুলে ধরব চিংড়ি চাষের অজানা দিক এবং সম্ভাব্য সমাধান।
খুলনার পাইকগাছা, দাকোপ আর কয়রা উপজেলার ছোট ছোট গ্রামগুলোতে এক সময় সারা বছর ধান, কলা, ভুট্টা ও শাকসবজির সবুজ গালিচা দেখা যেত।
১৯৮০-র দশকে যখন ‘বাগদা-সোনালী স্বপ্ন’ নামে চিংড়ি রপ্তানি জোরালো সরকারি প্রণোদনা পেল, তখনই লবণাক্ত খাল ও নদীর পানি কাঠের স্লুইস দিয়ে ধানের মাঠে ঢুকতে শুরু করে। গ্রামের যারাই প্রথম ঘের বানালেন, কয়েক মৌসুমেই দ্বিগুণ আয় দেখে প্রতিবেশীদের ছুঁতে পারলেন না—সবাই নিজেদের খেত মাটি কেটে চৌকোনা ঘের বানাতে নেমে গেলেন। সরকারের তথ্য বলছে, খুলনা জেলায় এখন ৮০ হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে বাগদা ও গলদা চাষ হয়, যা তিন দশক আগের তুলনায় প্রায় পাঁচ গুণ। অথচ একই সময়ে এ জেলায় আমন-বোরোর জমি কমেছে ৪৩ শতাংশ।
আজ ৬২ বছর বয়সী কৃষক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, “আমাদের পৈতৃক জমিতে আগে তিন ফসল হতো; এখন সেখানে কেবল লবণজল। ধান তো দূরের কথা, বাড়ির পাশে ভিটাতেও শাক জন্মে না।” তাঁর মতো হাজারো কৃষক শুরুতে লাভবান হলেও এখন লবণনেশা মাটিতে ফসলের বীজ পুঁততেও সাহস পান না।
শ্রমবাজারেও বড় ধাক্কা লেগেছে। ধান কাটার সময় যেখানে প্রতি একর জমিতে ১২-১৫ জন শ্রমিক লাগত, সেখানে একটি চারবিঘা-ঘের সামলাতে দুই-তিনজনই যথেষ্ট। ফলে মৌসুমি শ্রমিকদের কাজের দিন কমে গেছে, গ্রামীণ দারিদ্র্য বেড়েছে। কৃষিশ্রমিক রেজিয়া বেগমের কথায়, “আগে খেতে ধান-গম তুলতাম; এখন পানি সামলানোর কাজও কম, আবার হাতে অন্য কাজও নেই।”
সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাজারনির্ভরতা। নিজের জমির ধান না থাকায় কৃষক পরিবারগুলোকে পুরো বছর চাল-ডাল-সবজি কিনে খেতে হয়। ফলে চিংড়ির ডলার আয়ের প্রতিটি ওঠানামা সরাসরি তাদের পাতে চাপ ফেলে। গত সাত বছরে দেশের চিংড়ি রপ্তানি অর্ধেকে নেমে যাওয়ায় গ্রামে নগদ টাকা আর ঢুকে না; ঘের মালিকেরা পর্যন্ত ঋণের ঘানি টানছেন।
চার দশক আগের লোভনীয় মুনাফা আজ আর নেই; পরিবর্তে আছে মাটি-পানি-জীবিকার দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি। তবু অনেকে বিকল্প দেখতে পাচ্ছেন না—এই টানাপোড়েনই আমাদের ধারাবাহিক অনুসন্ধানের শুরু। পরবর্তী পর্বে থাকছে, কীভাবে এক রাতেই বদলে যায় ধানের মাঠ, আর তার চাপে কীভাবে ভাঙে কৃষকের স্বপ্ন।