পরিবারের সংকটে পরিচয় খোঁজা
২০১২ সালের জানুয়ারি তোমবারি, আমার বাবা—অবসরপ্রাপ্ত গবেষণা বিজ্ঞানী ও কম্পিউটার বিজ্ঞান অধ্যাপক—একটি বড় স্ট্রোক করলেন। আইসিইউ-তে শোয়া, মাথায় ব্যান্ডেজ, হাতে অক্সিজেন টিউব আর আইভি লাইনে আবদ্ধ অচল ব্যক্তিটি আমার বাবার মতো দেখাচ্ছিল না। তবু আমি জানতাম, সেই বদলে যাওয়া দেহের ভিতর তিনি রয়েছেন। মায়ের ও আমার চার ভাইবোনের সঙ্গে বারবার হাসপাতালে যেয়ে আমরা জিজ্ঞাসা করছিলাম: এই নির্জীব দেহের সঙ্গে আমরা যে মানুষটিকে চিনেছি, তাঁর কোনো “অন্তর্লীন সত্তা” কি অবিকল রয়ে গেছে?
পুরনো কবিতার নতুন ভূমিকা
ড্যানিয়েল মেন্ডেলসোহ্ন নির্মিত “অডিসি: বাবা, বাপ, আর একটি মহাকাব্য”–এর লেখক হিসেবে সম্প্রতি হোমারের “ওডিসি” অনুবাদ করেছেন। এই গ্রিক মহাকাব্য, যাত্রাপথে থাকা রাক্ষস-দাবানল, বিভীষিকাময় মনুষ্যরূপী দৈত্য আর প্রেমমগ্ন নিম্ফদের কাহিনি, সময়ের পরিক্রমায় অবিশ্বাস্যভাবে সমকালীন প্রশ্ন তোলে: আমরা কে, আমাদের পরিচয় কীভাবে জানা যায়।
এবার কী দেখে ভালোবাসা বাড়ছে?
পশ্চিমা সাহিত্য–জগতের মূলধারার এই মাস্টারপিসটিতে সম্প্রতি অতিরঞ্জিত আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। অক্সফোর্ডস্থ আমেরিকান রিপার্টরি থিয়েটারে নারীপ্রধান নাট্যকার কেইট হামিল এর অভিনব মঞ্চন, তারপর রালফ ফাইনস ও জুলিয়েট বিনোশ পরিচালিত “দ্য রিটার্ন” সিনেমা, আর Christopher Nolan এর মাট ডেমন অভিনীত ‘মন অফ ম্যানি টার্নস’ আসন্ন চলচ্চিত্র—সবই “ওডিসি”কে নতুন করে জনপ্রিয় করে তুলছে। বর্তমান পৃথিবীর রাজনৈতিক, সামাজিক, লিঙ্গভিত্তিক পরিচয়–আলোচনায়, আমাদেরও যেন ওডিসিয়াসের মত নিজেকে বাঁকানো, লুকানো আর নতুন করে উন্মোচনের কাহিনি চওড়া অনুরণন পাচ্ছে।
পরিচয়ের জটিলতা
মহাকাব্য শুরু থেকেই পরিচয়ের ধোঁয়াশা ছড়ায়। উদ্বোধনী শ্লোকে হোমার নাম এলে শুধু “একজন মানুষ”—ওডিসিয়াস নাম কেউ উচ্চারণ করে না। “বলও, মিউজ, সেই মানুষটির কাহিনি, যে কত ঘুরপথ বেয়ে ঘুরে গেল…” কোথায় সে? কেমন সে? আদতেই জানা কঠিন। পরে একবার সাইক্লোপসের মুখোমুখি হয়ে হিরো নিজের নাম বদলে রাখে “কেউ নয়”—পরবর্তীতে এই মিথ্যে নাম তাঁর হাতকড়ির কাজও করে।
ধ্বংসাত্মক প্রতারণা ও নায়কত্ব
ওডিসিয়াসের বিভ্রান্তি, ছল, আর গোপনীয়তার দক্ষতা তাঁকে জীবন্ত রেখেছিল। কিন্তু ওই ক্ষমতাই বাড়িয়ে দেয় তার সমস্যার মাত্রা: বাসায় ফেরার পর স্ত্রী পেনেলোপি বিশ্বাস করতে চান না, যে জর্মি বুড়ো গরিব ভিক্ষুক সেজে এসেছিল, তিনি কি সেই সাহসী নাবিক? অবশেষে প্রাচীন পাসওয়ার্ড–এর আদলে এক গোপন সংকেত বিনিময়ের পর তিনি প্রমান করেন। তবু প্রশ্ন থেকেই যায়: কতটা বদলে গিয়েও কি তিনি আগের সেই মানুষ?
পরিচয়ের প্যারাডক্স
এই প্রশ্ন আজও উদকাতুর: জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আমরা কতখানি অপরিবর্তিত থাকি, কতখানি বদলাতে বাধ্য হই—বেদনা, গ্লানি, বয়সের খোঁজে? ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর বাহ্যিক প্রদর্শনের ফাঁকে কতখানি “আমি” অবিকল থাকে?
পোস্টনেসের প্রতিধ্বনি
“ইলিয়াড” এর স্থানে দেবদেবতা থাকলেও, “ওডিসি”–তে যুদ্ধের গৌরব অতীত, ঈশ্বরেরা দূরে সরে গেছে। একাকী নায়ক, অচেনা পৃথিবীতে—অজ্ঞাত রূপ, অচেনা জনসাধারণ, অনিশ্চিত গন্তব্য—একা পথচলা, অজানা বাড়ির খোঁজ। কফকা-জয়েস–র মনস্তাত্ত্বিক বিপ্লবের পূর্বসূরী তীব্রতা এখানে আছে।
ব্যক্তিগত প্রতিবিম্ব ও শেষ মন্তব্য
আজ আমি জানি, আমার বাবার জীবনযুদ্ধের সঙ্গে ওডিসিয়াসের যাত্রার মিল। দু’জনেরই পরিচয়ের প্যারাডক্স, দেহ-মন–দৈহিক পরিবর্তনের মাঝে “আমি” অবিকল থাকা। হোমার এই মহাকাব্য জানতে শিখায়, মানবধর্ম কেন জীবন্ত: মৃত্যুর ভয়াবহতার সাথেও ভালোবাসা, সম্পর্ক, অস্থিরতার মধ্যেও অটল আত্মাধিকার মূল্যবান। আমাদের অনিশ্চিতা, বিচ্ছিন্নতা, পরিচয়–বিভ্রম এই পাণ্ডুলিপিতে আজও কথা বলে, যুগে যুগে।