০২:৫১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

কর সংস্কারের ঝড়: এনবিআর ভাঙনে রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় নতুন যাত্রা নাকি বিভ্রান্তি?

বাংলাদেশের রাজস্ব আহরণ কাঠামোতে বড় ধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এক উত্তপ্ত সময় পার করছে জাতীয় রাজস্ব প্রশাসন। সরকারের ঘোষিত রাজস্ব সংস্কার উদ্যোগ, এনবিআরের বিলুপ্তি এবং রাজস্ব নীতি ও ব্যবস্থাপনা বিভাগে পুনর্গঠনের ঘোষণায় সৃষ্টি হয়েছে অনিশ্চয়তা, ক্ষোভ এবং আন্দোলনের ঝড়।

এনবিআরের বিলুপ্তি: সংস্কার নাকি আত্মঘাতী পদক্ষেপ?

২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য জারি করা এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয় এনবিআর বিলুপ্ত করে ‘রাজস্ব নীতি বিভাগ’ ও ‘রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ’ নামে দুটি নতুন সংস্থা গঠন করেছে। সরকার বলছে, এটি কর-নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়নকে পৃথক করে জবাবদিহিমূলক ও দক্ষ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার প্রয়াস। প্রধান উপদেষ্টা তার অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে বলেন, ৫০ বছর ধরে এনবিআর কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ, কর-জিডিপি অনুপাত এখনো মাত্র ৭.৪ শতাংশ—যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন।

তবে এনবিআরের কর ও কাস্টমস ক্যাডার কর্মকর্তাদের মতে, এ অধ্যাদেশে না রয়েছে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা, না রয়েছে তাদের চাকরির নিরাপত্তা ও পদোন্নতির নিশ্চয়তা। বরং অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা নেতৃত্বে আসবেন—এমন ধারণা তাদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় গঠিত হয় ‘এনবিআর সংস্কার ঐক্যপরিষদ’, যারা ২৬ মে পর্যন্ত কলম বিরতিসহ লাগাতার কর্মসূচি পালন করে এবং বর্তমান চেয়ারম্যানের অপসারণের দাবি তোলে।

অচলাবস্থার প্রভাব: রাজস্ব ঘাটতিতে নতুন রেকর্ড

বিগত ১০ মাসে রাজস্ব ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭১ হাজার কোটি টাকা। এই ঘাটতি দেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে অন্যতম উচ্চতম। রাজস্ব প্রবৃদ্ধি মাত্র ৩.২৪ শতাংশ, যা ২০১৯-২০ অর্থবছর (করোনাকাল) ছাড়া গত এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। কলম বিরতির কারণে রাজস্ব সংগ্রহ কার্যক্রম প্রায় থমকে যায়। কাস্টমস হাউজ, ইনকম ট্যাক্স অফিস, ভ্যাট সার্কেল—সবখানেই কাজের গতি মন্থর।

অর্থনীতির মন্দাভাব, বিনিয়োগ স্থবিরতা, জনগণের কম খরচ করার সক্ষমতা, বেকারত্ব—সব মিলিয়ে রাজস্ব সংগ্রহে জটিলতা আরো বেড়েছে। তার ওপর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলন সরকারের ঘোষিত সংস্কারকেও প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে।

সরকার-পদক্ষেপ ও আশ্বাস: কতটা যথাযথ?

আন্দোলনের চাপ মোকাবিলায় অর্থ মন্ত্রণালয় ২৫ মে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ৪টি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা দেয়:

১. ৩১ জুলাই পর্যন্ত অধ্যাদেশ কার্যকর স্থগিত থাকবে।
২. এনবিআর-এর প্রশাসনিক কাঠামো ও কর্মকর্তা স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রেখে পুনর্গঠন হবে।
৩. পদসংখ্যা কমবে না; বরং পদোন্নতির সুযোগ বাড়বে।
৪. এনবিআর বিলুপ্ত না করে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগে একীভূত করে সংস্কার হবে।

এই ঘোষণার পর ‘ঐক্য পরিষদ’ কর্মসূচি স্থগিত করে। তবে তারা ২৯ মে পর্যন্ত এনবিআর চেয়ারম্যান অপসারণের জন্য সময় বেঁধে দেয়।

ভেঙে ফেলা নাকি ঢেলে সাজানো?

সাবেক এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়ার মতে, এনবিআরের রাজস্ব আহরণ সক্ষমতা বিবেচনায় ১৯৭২ সালে ১৬৬ কোটি টাকা থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৩ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত রাজস্ব সংগ্রহে প্রতিষ্ঠানটির সফলতা রয়েছে। নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়ন এক ছাদের নিচে থাকার ফলে সমন্বিত পরিকল্পনা সম্ভব হয়েছে। তাই তাড়াহুড়ো করে এনবিআর ভেঙে ফেলা অযৌক্তিক।

অনেক বিশেষজ্ঞও মনে করেন, নীতি ও আহরণ বিভাজনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পদ্ধতিটি ছিল কেন্দ্রীয়কৃত ও অংশীজনবিমুখ। সিপিডি’র মতে, যাদের সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে—কর ও কাস্টমস ক্যাডার—তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও মতামত উপেক্ষা করা হয়েছে।

করজাল ও অফিস বিস্তার: আর কত বিলম্ব?

বর্তমানে দেশে কর প্রদানকারী ব্যক্তি মাত্র ৪৩ লাখ। এর মধ্যে সরাসরি করদাতা ৩০ লাখের নিচে। অথচ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কয়েক কোটিতে দাঁড়িয়েছে। করজাল সম্প্রসারণ ছাড়া রাজস্ব বৃদ্ধি সম্ভব নয়। যদিও ২৩টি নতুন কমিশনারেট যোগ করে মোট কমিশনারেট সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৪টিতে, তবে এখনো অনেক জেলায় কাস্টমস ও ভ্যাট অফিস নেই। ইএফডি মেশিন চালুর প্রচেষ্টা চললেও দেশের বড় বড় বিপণিকেন্দ্রের অনেকেই কর ফাঁকি দিচ্ছে।

সরকার এখনো কাস্টমস, ভ্যাট ও আয়কর অফিস সম্প্রসারণের প্রস্তাব অনুমোদন করেনি। জনবলও সংকটাপন্ন। ফলে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও করজাল বৃদ্ধি—সবই আটকে রয়েছে কাঠামোগত দুর্বলতায়।

কী হতে পারে পথ?

এই মুহূর্তে সরকারের জন্য তিনটি বিষয় জরুরি:

  • নীতিনির্ধারণে অংশীজনের সুনির্দিষ্ট মতামত অন্তর্ভুক্ত করা
  • আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবস্থার মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ে স্বচ্ছতা আনা
  • কর কর্মকর্তাদের পেশাগত মর্যাদানিরাপত্তা ও পদোন্নতির নিশ্চয়তা দেয়া

রাজস্ব প্রশাসনে যেকোনো সংস্কার দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গি ও অংশীজন-সহযোগিতার ভিত্তিতে হওয়া উচিত। সরকার যদি দ্রুত রাজনৈতিক সমঝোতা, প্রযুক্তিগত বিনিয়োগ ও কাঠামোগত সমন্বয় করতে পারে, তবেই রাজস্ব ব্যবস্থার অচলাবস্থা কাটিয়ে উঠা সম্ভব।

কর সংস্কারের ঝড়: এনবিআর ভাঙনে রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় নতুন যাত্রা নাকি বিভ্রান্তি?

০৩:৩৬:৫৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৩০ মে ২০২৫

বাংলাদেশের রাজস্ব আহরণ কাঠামোতে বড় ধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এক উত্তপ্ত সময় পার করছে জাতীয় রাজস্ব প্রশাসন। সরকারের ঘোষিত রাজস্ব সংস্কার উদ্যোগ, এনবিআরের বিলুপ্তি এবং রাজস্ব নীতি ও ব্যবস্থাপনা বিভাগে পুনর্গঠনের ঘোষণায় সৃষ্টি হয়েছে অনিশ্চয়তা, ক্ষোভ এবং আন্দোলনের ঝড়।

এনবিআরের বিলুপ্তি: সংস্কার নাকি আত্মঘাতী পদক্ষেপ?

২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য জারি করা এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয় এনবিআর বিলুপ্ত করে ‘রাজস্ব নীতি বিভাগ’ ও ‘রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ’ নামে দুটি নতুন সংস্থা গঠন করেছে। সরকার বলছে, এটি কর-নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়নকে পৃথক করে জবাবদিহিমূলক ও দক্ষ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার প্রয়াস। প্রধান উপদেষ্টা তার অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে বলেন, ৫০ বছর ধরে এনবিআর কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ, কর-জিডিপি অনুপাত এখনো মাত্র ৭.৪ শতাংশ—যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন।

তবে এনবিআরের কর ও কাস্টমস ক্যাডার কর্মকর্তাদের মতে, এ অধ্যাদেশে না রয়েছে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা, না রয়েছে তাদের চাকরির নিরাপত্তা ও পদোন্নতির নিশ্চয়তা। বরং অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা নেতৃত্বে আসবেন—এমন ধারণা তাদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় গঠিত হয় ‘এনবিআর সংস্কার ঐক্যপরিষদ’, যারা ২৬ মে পর্যন্ত কলম বিরতিসহ লাগাতার কর্মসূচি পালন করে এবং বর্তমান চেয়ারম্যানের অপসারণের দাবি তোলে।

অচলাবস্থার প্রভাব: রাজস্ব ঘাটতিতে নতুন রেকর্ড

বিগত ১০ মাসে রাজস্ব ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭১ হাজার কোটি টাকা। এই ঘাটতি দেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে অন্যতম উচ্চতম। রাজস্ব প্রবৃদ্ধি মাত্র ৩.২৪ শতাংশ, যা ২০১৯-২০ অর্থবছর (করোনাকাল) ছাড়া গত এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। কলম বিরতির কারণে রাজস্ব সংগ্রহ কার্যক্রম প্রায় থমকে যায়। কাস্টমস হাউজ, ইনকম ট্যাক্স অফিস, ভ্যাট সার্কেল—সবখানেই কাজের গতি মন্থর।

অর্থনীতির মন্দাভাব, বিনিয়োগ স্থবিরতা, জনগণের কম খরচ করার সক্ষমতা, বেকারত্ব—সব মিলিয়ে রাজস্ব সংগ্রহে জটিলতা আরো বেড়েছে। তার ওপর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলন সরকারের ঘোষিত সংস্কারকেও প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে।

সরকার-পদক্ষেপ ও আশ্বাস: কতটা যথাযথ?

আন্দোলনের চাপ মোকাবিলায় অর্থ মন্ত্রণালয় ২৫ মে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ৪টি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা দেয়:

১. ৩১ জুলাই পর্যন্ত অধ্যাদেশ কার্যকর স্থগিত থাকবে।
২. এনবিআর-এর প্রশাসনিক কাঠামো ও কর্মকর্তা স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রেখে পুনর্গঠন হবে।
৩. পদসংখ্যা কমবে না; বরং পদোন্নতির সুযোগ বাড়বে।
৪. এনবিআর বিলুপ্ত না করে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগে একীভূত করে সংস্কার হবে।

এই ঘোষণার পর ‘ঐক্য পরিষদ’ কর্মসূচি স্থগিত করে। তবে তারা ২৯ মে পর্যন্ত এনবিআর চেয়ারম্যান অপসারণের জন্য সময় বেঁধে দেয়।

ভেঙে ফেলা নাকি ঢেলে সাজানো?

সাবেক এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়ার মতে, এনবিআরের রাজস্ব আহরণ সক্ষমতা বিবেচনায় ১৯৭২ সালে ১৬৬ কোটি টাকা থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৩ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত রাজস্ব সংগ্রহে প্রতিষ্ঠানটির সফলতা রয়েছে। নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়ন এক ছাদের নিচে থাকার ফলে সমন্বিত পরিকল্পনা সম্ভব হয়েছে। তাই তাড়াহুড়ো করে এনবিআর ভেঙে ফেলা অযৌক্তিক।

অনেক বিশেষজ্ঞও মনে করেন, নীতি ও আহরণ বিভাজনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পদ্ধতিটি ছিল কেন্দ্রীয়কৃত ও অংশীজনবিমুখ। সিপিডি’র মতে, যাদের সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে—কর ও কাস্টমস ক্যাডার—তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও মতামত উপেক্ষা করা হয়েছে।

করজাল ও অফিস বিস্তার: আর কত বিলম্ব?

বর্তমানে দেশে কর প্রদানকারী ব্যক্তি মাত্র ৪৩ লাখ। এর মধ্যে সরাসরি করদাতা ৩০ লাখের নিচে। অথচ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কয়েক কোটিতে দাঁড়িয়েছে। করজাল সম্প্রসারণ ছাড়া রাজস্ব বৃদ্ধি সম্ভব নয়। যদিও ২৩টি নতুন কমিশনারেট যোগ করে মোট কমিশনারেট সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৪টিতে, তবে এখনো অনেক জেলায় কাস্টমস ও ভ্যাট অফিস নেই। ইএফডি মেশিন চালুর প্রচেষ্টা চললেও দেশের বড় বড় বিপণিকেন্দ্রের অনেকেই কর ফাঁকি দিচ্ছে।

সরকার এখনো কাস্টমস, ভ্যাট ও আয়কর অফিস সম্প্রসারণের প্রস্তাব অনুমোদন করেনি। জনবলও সংকটাপন্ন। ফলে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও করজাল বৃদ্ধি—সবই আটকে রয়েছে কাঠামোগত দুর্বলতায়।

কী হতে পারে পথ?

এই মুহূর্তে সরকারের জন্য তিনটি বিষয় জরুরি:

  • নীতিনির্ধারণে অংশীজনের সুনির্দিষ্ট মতামত অন্তর্ভুক্ত করা
  • আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবস্থার মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ে স্বচ্ছতা আনা
  • কর কর্মকর্তাদের পেশাগত মর্যাদানিরাপত্তা ও পদোন্নতির নিশ্চয়তা দেয়া

রাজস্ব প্রশাসনে যেকোনো সংস্কার দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গি ও অংশীজন-সহযোগিতার ভিত্তিতে হওয়া উচিত। সরকার যদি দ্রুত রাজনৈতিক সমঝোতা, প্রযুক্তিগত বিনিয়োগ ও কাঠামোগত সমন্বয় করতে পারে, তবেই রাজস্ব ব্যবস্থার অচলাবস্থা কাটিয়ে উঠা সম্ভব।