০৫:৫৬ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

নতুন বাজেটে লোকসানে থাকা ব্যবসার ওপর কর: ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উদ্যোক্তা পরিবেশ

লোকসানে চললেও কর দিতে হবে: বিতর্কিত নীতি ব্যবসায়ীদের দুশ্চিন্তায় ফেলেছে

২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে একটি নতুন বিতর্ক তৈরি করেছে সরকারের একটি সিদ্ধান্ত—যেসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লোকসানে চললেও, তাদেরকে ন্যূনতম হারে কর পরিশোধ করতে হবে। অর্থাৎ, আয় না থাকলেও আয়কর ফাঁকি রোধের যুক্তিতে সরকার এমন একটি বিধান চালু করতে যাচ্ছে যা অনেক উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দের মতে, দেশের বিনিয়োগ পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ‘ক্ষতিকর’।

কী বলছে নীতি?

অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাজেট প্রস্তাবে বলা হয়েছে, একটি প্রতিষ্ঠান যদি বার্ষিক আয়ের বিবরণী অনুযায়ী লোকসানে চলে, তবুও নির্ধারিত হারে ন্যূনতম কর পরিশোধ করতে হবে। প্রস্তাবিত নীতিমতে, মোট বিক্রয় বা মোট সম্পদের একটি নির্দিষ্ট শতাংশ হিসেবে এই ন্যূনতম কর নির্ধারিত হবে।

এর আগে এই ধরণের নীতি সীমিতভাবে প্রযোজ্য ছিল, তবে এবার একে আরও কঠোরভাবে বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এর যুক্তিতে বলা হয়েছে, অনেক প্রতিষ্ঠান লোকসানের অজুহাত দেখিয়ে কর ফাঁকি দিচ্ছে, অথচ তারা কার্যত ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে এবং নানা সুবিধা ভোগ করছে।

ব্যবসায়ীদের ক্ষোভ ও উদ্বেগ

বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড কমার্স (FBCCI), মেট্রোপলিটন চেম্বার (MCCI) এবং বিভিন্ন খাতভিত্তিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন। তাদের মতে, একদিকে অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে অনেক প্রতিষ্ঠান প্রকৃতপক্ষেই লোকসানের মধ্যে আছে, অন্যদিকে সরকার তাদের কাছ থেকেও কর আদায় করতে চাইছে—যা অনৈতিক এবং নিপীড়নমূলক।

FBCCI সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, “একটি প্রতিষ্ঠান যদি আয় না করতে পারে, তাহলে তাদের কাছ থেকে কর আদায় করা মানে ব্যবসাকে শাস্তি দেওয়া। এতে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হবে, নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হবে না।”

MCCI-র মহাসচিব তামজিদ খান বলেন, “বর্তমানে আমরা যে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চাপে আছি, তাতে ব্যবসা বাঁচিয়ে রাখাই চ্যালেঞ্জ। এর মধ্যে লোকসানে থাকা প্রতিষ্ঠানকে কর দিতে বাধ্য করলে তারা কর্মী ছাঁটাই করবে, উৎপাদন কমাবে, এমনকি কার্যক্রম বন্ধ করতে পারে।”

ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা সবচেয়ে বেশি বিপদে

এই নীতি সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের (SME)। যারা ধার-দেনা করে ব্যবসা শুরু করে এখনো লাভে যেতে পারেননি। এমন অনেক প্রতিষ্ঠান ২-৩ বছর লোকসান সহ্য করে টিকে থাকার চেষ্টা করে। এই ধরনের ন্যূনতম কর ব্যবস্থা তাদের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করবে বলে মনে করছেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা।

অর্থনীতিবিদ ড. সুলতানা আক্তার বলেন, “যেসব ব্যবসা টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করছে, তাদের কাছ থেকে জোর করে কর আদায় করলে অনেক প্রতিষ্ঠান অস্তিত্ব হারাবে। দীর্ঘমেয়াদে এটা কর্মসংস্থান, উৎপাদন এবং রপ্তানি আয়ে বিরূপ প্রভাব ফেলবে।”

আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক প্রেক্ষাপটে একক সিদ্ধান্ত?

ব্যবসায়ীরা বলছেন, অনেক দেশেই লোকসানে থাকা ব্যবসাকে কিছু নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কর থেকে ছাড় দেওয়া হয়, যাতে তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারে। অথচ বাংলাদেশে ঠিক উল্টো পথে হাঁটার চেষ্টা চলছে। ভারতের মতো প্রতিবেশী দেশে এমন ব্যবসাগুলোর জন্য কর রেয়াতের পাশাপাশি পুনঃবিনিয়োগে কর সুবিধা দেওয়া হয়।

সরকার কী বলছে?

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্র বলছে, এটি একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত যাতে কর ফাঁকি রোধ করা যায়। অনেক বড় কর্পোরেট হাউজ লোকসানের অজুহাত দেখিয়ে বছরের পর বছর কর পরিশোধ করছে না। নতুন নীতি এই প্রবণতা বন্ধ করতে সহায়ক হবে।

তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, বড় কর্পোরেটদের কর ফাঁকি রোধ করতে গিয়ে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ওপর এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। করনীতির এমন একচেটিয়া প্রয়োগ দেশের সার্বিক বিনিয়োগ পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

লোকসানে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর ন্যূনতম কর আদায়ের সিদ্ধান্ত সরকারের করনীতির একটি নতুন মোড় হলেও, তা ব্যবসা ও বিনিয়োগবান্ধব কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন বিশেষজ্ঞ ও উদ্যোক্তারা। সামগ্রিকভাবে এই নীতি সংশোধন বা পুনর্বিবেচনা না হলে দেশের উদ্যোক্তা সংস্কৃতি এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে সতর্ক করছেন তারা।

নতুন বাজেটে লোকসানে থাকা ব্যবসার ওপর কর: ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উদ্যোক্তা পরিবেশ

১১:৩৪:৪৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩ জুন ২০২৫

লোকসানে চললেও কর দিতে হবে: বিতর্কিত নীতি ব্যবসায়ীদের দুশ্চিন্তায় ফেলেছে

২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে একটি নতুন বিতর্ক তৈরি করেছে সরকারের একটি সিদ্ধান্ত—যেসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লোকসানে চললেও, তাদেরকে ন্যূনতম হারে কর পরিশোধ করতে হবে। অর্থাৎ, আয় না থাকলেও আয়কর ফাঁকি রোধের যুক্তিতে সরকার এমন একটি বিধান চালু করতে যাচ্ছে যা অনেক উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দের মতে, দেশের বিনিয়োগ পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ‘ক্ষতিকর’।

কী বলছে নীতি?

অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাজেট প্রস্তাবে বলা হয়েছে, একটি প্রতিষ্ঠান যদি বার্ষিক আয়ের বিবরণী অনুযায়ী লোকসানে চলে, তবুও নির্ধারিত হারে ন্যূনতম কর পরিশোধ করতে হবে। প্রস্তাবিত নীতিমতে, মোট বিক্রয় বা মোট সম্পদের একটি নির্দিষ্ট শতাংশ হিসেবে এই ন্যূনতম কর নির্ধারিত হবে।

এর আগে এই ধরণের নীতি সীমিতভাবে প্রযোজ্য ছিল, তবে এবার একে আরও কঠোরভাবে বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এর যুক্তিতে বলা হয়েছে, অনেক প্রতিষ্ঠান লোকসানের অজুহাত দেখিয়ে কর ফাঁকি দিচ্ছে, অথচ তারা কার্যত ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে এবং নানা সুবিধা ভোগ করছে।

ব্যবসায়ীদের ক্ষোভ ও উদ্বেগ

বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড কমার্স (FBCCI), মেট্রোপলিটন চেম্বার (MCCI) এবং বিভিন্ন খাতভিত্তিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন। তাদের মতে, একদিকে অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে অনেক প্রতিষ্ঠান প্রকৃতপক্ষেই লোকসানের মধ্যে আছে, অন্যদিকে সরকার তাদের কাছ থেকেও কর আদায় করতে চাইছে—যা অনৈতিক এবং নিপীড়নমূলক।

FBCCI সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, “একটি প্রতিষ্ঠান যদি আয় না করতে পারে, তাহলে তাদের কাছ থেকে কর আদায় করা মানে ব্যবসাকে শাস্তি দেওয়া। এতে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হবে, নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হবে না।”

MCCI-র মহাসচিব তামজিদ খান বলেন, “বর্তমানে আমরা যে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চাপে আছি, তাতে ব্যবসা বাঁচিয়ে রাখাই চ্যালেঞ্জ। এর মধ্যে লোকসানে থাকা প্রতিষ্ঠানকে কর দিতে বাধ্য করলে তারা কর্মী ছাঁটাই করবে, উৎপাদন কমাবে, এমনকি কার্যক্রম বন্ধ করতে পারে।”

ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা সবচেয়ে বেশি বিপদে

এই নীতি সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের (SME)। যারা ধার-দেনা করে ব্যবসা শুরু করে এখনো লাভে যেতে পারেননি। এমন অনেক প্রতিষ্ঠান ২-৩ বছর লোকসান সহ্য করে টিকে থাকার চেষ্টা করে। এই ধরনের ন্যূনতম কর ব্যবস্থা তাদের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করবে বলে মনে করছেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা।

অর্থনীতিবিদ ড. সুলতানা আক্তার বলেন, “যেসব ব্যবসা টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করছে, তাদের কাছ থেকে জোর করে কর আদায় করলে অনেক প্রতিষ্ঠান অস্তিত্ব হারাবে। দীর্ঘমেয়াদে এটা কর্মসংস্থান, উৎপাদন এবং রপ্তানি আয়ে বিরূপ প্রভাব ফেলবে।”

আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক প্রেক্ষাপটে একক সিদ্ধান্ত?

ব্যবসায়ীরা বলছেন, অনেক দেশেই লোকসানে থাকা ব্যবসাকে কিছু নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কর থেকে ছাড় দেওয়া হয়, যাতে তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারে। অথচ বাংলাদেশে ঠিক উল্টো পথে হাঁটার চেষ্টা চলছে। ভারতের মতো প্রতিবেশী দেশে এমন ব্যবসাগুলোর জন্য কর রেয়াতের পাশাপাশি পুনঃবিনিয়োগে কর সুবিধা দেওয়া হয়।

সরকার কী বলছে?

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্র বলছে, এটি একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত যাতে কর ফাঁকি রোধ করা যায়। অনেক বড় কর্পোরেট হাউজ লোকসানের অজুহাত দেখিয়ে বছরের পর বছর কর পরিশোধ করছে না। নতুন নীতি এই প্রবণতা বন্ধ করতে সহায়ক হবে।

তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, বড় কর্পোরেটদের কর ফাঁকি রোধ করতে গিয়ে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ওপর এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। করনীতির এমন একচেটিয়া প্রয়োগ দেশের সার্বিক বিনিয়োগ পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

লোকসানে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর ন্যূনতম কর আদায়ের সিদ্ধান্ত সরকারের করনীতির একটি নতুন মোড় হলেও, তা ব্যবসা ও বিনিয়োগবান্ধব কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন বিশেষজ্ঞ ও উদ্যোক্তারা। সামগ্রিকভাবে এই নীতি সংশোধন বা পুনর্বিবেচনা না হলে দেশের উদ্যোক্তা সংস্কৃতি এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে সতর্ক করছেন তারা।