বিশ্বব্যাপী সমুদ্রসম্পদ ব্যবস্থাপনায় টেকসইতার গুরুত্ব বাড়ছে, যাতে একদিকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উপকার অব্যাহত থাকে, অন্যদিকে পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা পায়।
প্রশান্ত মহাসাগরে আগামী প্রজন্মের জন্য সমুদ্র টিকিয়ে রাখা
২০০৭ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপদেশগুলোতে মাথাপিছু মাছ সরবরাহ ১৪ শতাংশ কমে গেছে। বিকল্প খাদ্যের অভাবে কিরিবাসে এই হ্রাস উদ্বেগজনক, কারণ দেশটি বিশ্বের সর্বোচ্চ মাছখাদক জাতিগুলোর একটি।
কিরিবাসের মোট দেশজ উৎপাদনের (GDP) ৩৪ শতাংশই আসে মৎস্য খাত থেকে। উপকূলীয় মাছ ধরার ওপর নির্ভরশীল বেশিরভাগ সম্প্রদায়ের জীবিকা ও খাদ্যনির্ভরতা বিবেচনায় টেকসই ব্যবস্থাপনা জরুরি।
মারিয়া হেনরি, কিরিবাস
“কিরিবাসে সমুদ্রই আমাদের জীবন,” বলেন উপকূলীয় মৎস্য বিভাগে কর্মরত ও সাবেক মৎস্য নিরাপত্তা কর্মকর্তা মারিয়া হেনরি।
২০২১ সালে তিনি দেশীয় মাছ রক্ষা ও অবৈধ, অটেকসই মাছ ধরার বিরুদ্ধে কাজ শুরু করেন। “আমরা ছোট মাছ ধরা বা নিষিদ্ধ জাল ব্যবহারের মতো কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করি,” বলেন তিনি।
মারিয়ার সরাসরি কমিউনিটি পর্যায়ে নজরদারির কারণে স্থানীয় জনগণের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে। ছোট নৌকা দিয়ে উপকূলের কাছাকাছি দিনে মাছ ধরে সন্ধ্যায় ফিরে আসা মাছজীবীদের টেকসই চর্চা গড়ে উঠেছে।
এই উদ্যোগের অংশ বিশ্বব্যাংকের সহায়তাপ্রাপ্ত Pacific Islands Regional Oceanscape Program (PROP), যা কিরিবাসের বিশাল Exclusive Economic Zone (EEZ) রক্ষা করছে। কিরিবাসের EEZ থেকে টুনা মাছ আহরণে দেশটির জাতীয় আয়ের ৬৫.৫ শতাংশ আসে।
PROP কর্মসূচির আওতায় প্রশান্ত মহাসাগরের সাতটি দেশের মৎস্য ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, কমিউনিটি-নির্ভর তত্ত্বাবধান ও শিল্প মাছ ধরার নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
পশ্চিম আফ্রিকায় উপকূল ভাঙন থেকে মানুষকে রক্ষা
উপকূলীয় দেশগুলোর জন্য সমুদ্রকে পেশা ও জীবিকার উৎস রাখতে হলে পরিবেশ পুনর্গঠন ও টেকসই ব্যবস্থাপনা জরুরি।
বিগত কয়েক দশক ধরে পশ্চিম আফ্রিকার উপকূল দ্রুত ক্ষয়ে যাচ্ছে। বেনিন ও টোগো প্রতিবছর গড়ে ১৫ মিটার করে উপকূল হারাচ্ছে।
কিন্তু West Africa Coastal Areas Management Program (WACA)-এর অর্থায়নে এখন ৪২ কিমি উপকূলীয় অবকাঠামো—ব্রেকওয়াটার, বালির দেয়াল ইত্যাদি—নির্মাণ হয়েছে।
বেনিনের গ্রান্ড-পোপো এলাকায় ৫.৩ কিমি অঞ্চলজুড়ে সমুদ্র ২০০ মিটার পর্যন্ত সরে গেছে। ১ লক্ষ ৪৫ হাজারের বেশি মানুষের জীবন ও জীবিকা এখন নিরাপদ।
আয়ায়ী হউনলেদে, টোগো
“আগে দুই মিটারের বেশি জোয়ারের ঢেউ আমাদের বাড়ির দরজা-জানালা ভেঙে প্লাবিত করত। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকত। পুরুষদের রাতভর পাহারা দিতে হতো,” বলেন আয়ায়ী।
“এখন ব্রেকওয়াটার নির্মাণের পর সৈকত বেড়েছে, ঘুমাতে পারি নিশ্চিন্তে।”
জর্ডে বুবুকারি, মৎস্যজীবী
সৈকতে আবার ফিরে এসেছে ছোট নৌকার মাছ ধরা। হারিয়ে যাওয়া মাছও ফিরেছে।
“ফিশ পিট তৈরি হয়েছে যেখানে মাছ জমে। একদিনে আমাদের আয় ৮ হাজার ডলার পর্যন্ত হতে পারে,” বলেন দোসে লেগবেজে, টোগোর মৎস্য সমবায় প্রধান।
WACA এখন পর্যন্ত ৯টি দেশে (বেনিন, আইভরি কোস্ট, গাম্বিয়া, ঘানা, গিনি-বিসাউ, মৌরিতানিয়া, সাও টোমে ও প্রিন্সিপে, সেনেগাল, টোগো) উপকূলীয় সম্পদ ব্যবস্থাপনায় নীতি সংস্কার ও স্থানীয় সহায়তা দিয়েছে। এখন পর্যন্ত ১৬,২৪২টি পরিবার বন্যার ঝুঁকি থেকে রক্ষা পেয়েছে, ৯,২৬০টি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে, এবং ২৮ হাজার হেক্টরের বেশি পরিবেশ পুনরুদ্ধার হয়েছে।
তানজানিয়ায় নারী উদ্যোক্তাদের সম্ভাবনা
নারী উদ্যোক্তাদের পথ আটকে আছে জামানত না থাকা, অর্থায়নের অভাব ও লিঙ্গ বৈষম্যের কারণে। কিন্তু সঠিক বিনিয়োগ তাদের গেম-চেঞ্জার করে তুলতে পারে।
জাঞ্জিবারে নারী সামুদ্রিক শৈবাল চাষিদের ৫০০টিরও বেশি নৌকা ও সহজ ঋণ সরবরাহ করেছে সরকার। এতে সময় ও খরচ কমেছে।
গভীর পানিতে আধুনিক পদ্ধতিতে চাষে শৈবালের মান বেড়েছে। তারা প্রতিদিন ৬ ডলার পর্যন্ত সাশ্রয় করতে পারছেন।
Cottonii নামের এক প্রজাতির শৈবাল উৎপাদন ছয় গুণ বেড়েছে এবং ১৬ হাজারের বেশি নারী উপকৃত হয়েছেন।
নারীরা এখন স্বাধীনভাবে তাদের পণ্য বিক্রি করছেন ও স্থানীয় ব্যবসায় পুনঃবিনিয়োগ করছেন।
সিশেলস ও রোমানিয়ায় ব্লু ফাইন্যান্সের জোর
টেকসই সামুদ্রিক বিনিয়োগে অর্থায়নের জন্য নতুন পথ—ব্লু ফাইন্যান্স—জীববৈচিত্র্য, জীবিকা ও মৎস্য ব্যবস্থাপনায় সহায়ক।
২০১৮ সালে সিশেলস বিশ্বের প্রথম sovereign blue bond ইস্যু করে ১.৫ কোটি ডলার সংগ্রহ করে।
২০২২ সালে রোমানিয়ায় International Finance Corporation (IFC) প্রথম ১০ কোটি ইউরোর ব্লু ফাইন্যান্স ঋণ দেয় Banca Transilvania-কে।
জর্জ আয়োনেস্কু-ভিৎসু, এক সফল মাছ চাষ উদ্যোক্তা, বলছেন:
“আমাদের প্রকৃত সফলতা পেতে হলে স্বাস্থ্যকর পরিবেশে স্বাস্থ্যকর মাছ চাষ করতেই হবে।”
তারা ওয়াসা লেকে খাঁচার সংখ্যা সীমিত করে, উন্নত যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে এবং নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে পানির মান ও মাছের গুণগত মান বজায় রেখেছেন।
সমুদ্র: মানুষ ও পরিবেশের জন্য
কিরিবাস থেকে বেনিন, টোগো থেকে জাঞ্জিবার—এই সব উদ্যোগের মূল লক্ষ্য এক: সমুদ্র সম্পদের টেকসই ব্যবহার, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, চাকরির সৃষ্টি এবং পরিবেশ রক্ষা।
PROBLUE ট্রাস্ট ফান্ডের সহায়তায় বিশ্বব্যাংকের ব্লু ইকোনমি কার্যক্রম এই পরিবর্তনের কেন্দ্রবিন্দুতে।
মারিয়া হেনরি ও জর্ডে বুবুকারির মতো উপকূলীয় গেম-চেঞ্জারদের ছাড়া এই পরিবর্তন সম্ভব হতো না। তাঁদের উদ্যোগ প্রমাণ করেছে—যদি প্রশিক্ষণ, সহায়তা ও অর্থায়ন দেওয়া যায়, তাহলে স্থানীয় নেতারাই হতে পারেন পরিবর্তনের মুখ।
এই গল্পগুলো দেখায়, কিভাবে বিনিয়োগ, সচেতনতা ও অর্থায়নের মাধ্যমে সমুদ্র জীবন বদলে দিতে পারে ও উন্নয়নের চালিকাশক্তি হতে পারে।
এক বাসযোগ্য পৃথিবীর জন্য গেম-চেঞ্জার বিষয়গুলো:
- নতুন খাদ্য অর্থনীতি: টেকসই খাদ্য ব্যবস্থার জন্য বর্তমান সংকটই হতে পারে রূপান্তরের সুযোগ।
- পরিষ্কার বাতাস: স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও অর্থনীতির জন্য বিশুদ্ধ বাতাস অপরিহার্য।
- জলবায়ু সহনশীল সেচ: খাদ্য নিরাপত্তা, জীবনমান ও কর্মসংস্থান গঠনে সহায়ক।
- আমাদের জন্য বন: বনাঞ্চল দারিদ্র্য বিমোচন ও জলবায়ু রক্ষায় মুখ্য ভূমিকা রাখে।
- কার্বন বাজার: উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বাস্তব পরিবর্তন আনতে হলে স্বচ্ছ ও কার্যকর কার্বন বাজার গড়ে তুলতে হবে।
- জলবায়ু অভিযোজন: জলবায়ু ঝুঁকির মোকাবেলায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রাপ্য দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা।
- নগর পরিবহন: টেকসই নগর পরিবহন ব্যবস্থা উন্নততর জীবনমান ও কম কার্বন নির্গমনের পথ।
- সূর্যের গল্প: শক্তির ঘাটতি পূরণ ও পরিবেশ সংরক্ষণে সৌরশক্তির গুরুত্ব এখন শীর্ষে।