১২:৫২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

নীরবতা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নয়

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতির বাস্তবতায় দুটি তাত্ত্বিক ফ্রেমওয়ার্ক আমাদের আলোকিত করতে পারে। একটি হলো রেমন্ড ইউলিয়মের ‘স্ট্রাকচার অব ফিলিং’—যার মাধ্যমে তিনি বলেন, প্রত্যক্ষ ভাষা বা প্রতিষ্ঠিত মতাদর্শের বাইরেও সমাজের মানুষের অনুভবের একটা অদৃশ্য কাঠামো থাকে, যেটি নির্দিষ্ট সময়কালের মনোভাবকে ধারণ করে। আরেকটি হলো এলিজাবেথ নোয়েল-নিউম্যানের ‘স্পাইরাল অব সাইলেন্স’—যেখানে বলা হয়, জনমতের দমন ও ভয়াবহ এক সামাজিক পরিবেশে মানুষ নিজের মত গোপন করে, নীরবতা ধারণ করে, আর এই নৈঃশব্দ্য আবার ক্ষমতাকে আরও দুঃসাহসী করে তোলে। এই দুটি ধারণাকে সামনে রেখে আমরা যদি বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে পর্যালোচনা করি, তাহলে বোঝা যায় যে, রাষ্ট্র এবং সমাজের মধ্যে একটি গভীর স্নায়বিক সংকট চলমান, যার অনেকটাই ভাষাহীন এবং বর্ণনাতীত।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসর এক সময় সরব ছিল। ছাত্র রাজনীতি, পত্রপত্রিকা, কবিতা, মিছিল, নাগরিক প্রতিবাদ—এসব ছিল সক্রিয় ও প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক চর্চার অংশ। কিন্তু গত প্রায় এক দশকে একটি পরিবর্তন লক্ষণীয়। মানুষ প্রতিবাদ করে না, কথা বলে না, রাজনীতি নিয়ে স্পষ্ট মত দেয় না। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে মানুষ কিছু অনুভব করে না। বরং একটি অদৃশ্য, অসমাপ্ত, প্রায়-নিষিদ্ধ অনুভূতির পরিসর তৈরি হয়েছে—যাকে ইউলিয়ম বলতেন স্ট্রাকচার অব ফিলিং।
এই অনুভূতির কাঠামো নিছক ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয়। এটি একধরনের ‘মুড’, এক জাতের ‘সমষ্টিগত অস্বস্তি’, যা সরাসরি রাজনীতির ভাষায় ধরা যায় না। মানুষ যখন অফিসে বসে চুপচাপ একটি সিদ্ধান্ত মেনে নেয়, কিংবা কোনো নির্বাচনে ভোট দিতে না গিয়েও নিজের বিবেককে প্রশ্ন করে না—তখন সেটা শুধু রাজনৈতিক নিষ্ক্রিয়তা নয়, বরং একধরনের সামাজিক অভ্যস্ততা, যা গড়ে উঠেছে যুগের বাস্তবতায়।

বাংলাদেশে ক্রমাগতভাবে এই অনুভবের কাঠামো তৈরি হয়েছে—যেখানে মানুষ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয়, রাজনীতির পক্ষেও নয়; বরং নিজের নিরাপত্তা, বাঁচার চেষ্টা ও সামাজিক চাপ থেকে নিরুত্তাপ হয়ে গেছে। এটি একটি ‘শীতল অনুভূতির জমাট বাঁধা’, যা কখনো সিনেমায়, কখনো গল্পে, কখনো ব্যক্তিগত আলাপে ফেটে বেরোয়।
অন্যদিকে নিউম্যানের স্পাইরাল অব সাইলেন্স তত্ত্ব বলছে—যখন একটি মত জনপ্রিয় বা অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্কিত হয়, তখন মানুষ বিরুদ্ধ মত প্রকাশে ভয় পায়। কারণ তারা মনে করে, যদি আমি একা হয়ে যাই? যদি সামাজিকভাবে প্রত্যাখ্যাত হই? যদি শাস্তি পাই? ফলে যে কোনো সরকার যখন একটি নির্দিষ্ট মত বা বয়ানকে একমাত্র সত্য হিসেবে তুলে ধরে, এবং সব ভিন্ন মতকে সন্দেহের চোখে দেখে, তখন স্পাইরাল শুরু হয়। একজন চুপ করে যায়, তার ফলে আরেকজনও চুপ করে যায় এবং ধীরে ধীরে সমাজ একটি নিষ্প্রাণ বাগাড়ম্বরের মধ্যে প্রবেশ করে, যেখানে অনেক কিছু বলা হয় কিন্তু খুব কমই আসলে অর্থবহ।
২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল ঘনীভূত, উত্তপ্ত, কিন্তু একইসঙ্গে অদ্ভুতভাবে নিস্তব্ধ। বিরোধী দলের অংশগ্রহণ না থাকা, একতরফা ফলাফল, স্বল্প ভোটার উপস্থিতি এবং বিরোধিতাকারী গোষ্ঠীর ওপর দমন-পীড়ন—সব কিছু সত্ত্বেও গণমাধ্যম, সামাজিক পরিসর কিংবা নাগরিক আলোচনায় সেই মাত্রার প্রতিক্রিয়া অনুপস্থিত ছিল। এটি স্পাইরাল অব সাইলেন্স-এর একটি নিখুঁত প্রতিচ্ছবি। মানুষ জানত ওই নির্বাচন বাস্তবতাবর্জিত, কিন্তু কেউ কিছু বলেনি। অনেকে সোশ্যাল মিডিয়ায়ও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। ফেসবুক-টুইটারে দেখা দেয় ভোট নিয়ে একধরনের অস্বস্তিকর মৌনতা। এই নৈঃশব্দ্যের ভেতরেই গড়ে ওঠে একটি স্ট্রাকচার অব ফিলিং—একধরনের দুর্বোধ্য ক্লান্তি, যেখানে মানুষ নিজের হতাশাকে ভাষা দিতে পারে না, কিন্তু তা অনুভব করে।
২০২৩ সালের শেষ প্রান্তে বিএনপি, জামায়াত ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে কিছুটা সক্রিয় হয়েছিল। আন্দোলন শুরু হয়, সমাবেশ হয়, কিন্তু রাষ্ট্রীয় দমননীতির কারণে আন্দোলন ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ে। প্রচুর সংখ্যক গ্রেফতার, বিচারবহির্ভূত হয়রানি, এবং মিডিয়ায় অপ্রতুল কভারেজ মানুষকে বুঝিয়ে দেয়—চুপ থাকাই নিরাপদ। এই ভয়-ভীতি সামাজিকভাবে এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ে যে, মিছিলের চেয়ে ঘরে বসে চুপচাপ থাকা ‘রাজনৈতিক কৌশল’ হয়ে দাঁড়ায়। এটাই স্পাইরাল অব সাইলেন্স । আর এই দমননীতির ছায়ায় জন্ম নেয় এক সামাজিক অনুভূতির কাঠামো—হতাশা, তাচ্ছিল্য, আত্মঘাতী নির্লিপ্তি।


ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন মানুষের মতপ্রকাশের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। পত্রিকা, ব্লগ, ইউটিউব, ফেসবুক—সব জায়গায় রাজনৈতিক মতপ্রকাশকে আইনগত হুমকির মুখে ফেলা হয়েছে। এর ফলাফল হলো আত্মনিয়ন্ত্রণ। ‘আমি কি এটা পোস্ট করব?’—এই প্রশ্ন প্রতিটি মানুষের মনে। কেউ সরাসরি বিরোধিতা করে না, বরং রূপকের আশ্রয় নেয়। কেউ ছদ্মনামে পোস্ট করে। কোনো রাজনৈতিক ব্যঙ্গ হলে সেটি হয় ‘রেনবো হ্যাশট্যাগ’ দিয়ে। এগুলো সবই স্পাইরাল অব সাইলেন্স-এর বহুমাত্রিক রূপ। আর এইসব সীমাবদ্ধতার মধ্যে মানুষ যে অনুভূতিগুলো প্রকাশ করতে পারে না, সেগুলো জমতে জমতে গড়ে তোলে একটি বিশাল অভ্যন্তরীণ সংকট—ইউলিয়ম যাকে বলেছিলেন ‘ঐতিহাসিক বাস্তবতার অবচেতন ভাষা।‘
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা কিছুটা কঠিন। সরকার পরিবর্তন হলেও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অবারিত হয়নি। সরকার প্রধান মন খুলে সমালোচনা করতে বললেও সমালোচনা করার ফল ভালো হয়নি, সরকারসংশ্লিষ্ট দাপুটে ব্যক্তিরা সেটা ভালোভাবে নেন না।

যদিও রাজনৈতিক মতপ্রকাশ সীমিত, কিন্তু এই নৈঃশব্দ্যের অবসান ঘটতে পারে নানা সাংস্কৃতিক মাধ্যমে। নাটকে উঠে আসতে পারে রাষ্ট্র বনাম ব্যক্তি দ্বন্দ্ব, দুর্নীতির ব্যঙ্গচিত্র। সরকারি অনুদানে তৈরি হলেও কিছু কিছু সিনেমা রূপকধর্মী বিরোধিতা নিয়ে আসতে। শিল্পীরা এখন সরাসরি রাজনীতি নয়, বরং আভাসিত রাজনৈতিক হতাশা আঁকতে পারেন—অন্ধ চোখ, বদ্ধ কণ্ঠ, শূন্য মাঠ। নতুন প্রজন্মের ব্যান্ড গান বা উচ্চারিত কবিতায় উঠে আসে, ‘তুমি চাইলেও কিছু বলতে পারো না।‘ কবিতা হয়ে যায় বিদ্রোহের জায়গা, কিন্তু সরাসরি নয়—ইশারায়, প্রশ্নে, মেটাফরে। এগুলোই সেই স্ট্রাকচার অব ফিলিং—যা যুক্তিবাদী রাজনীতির চেয়ে অনেক বেশি আন্তঃসম্পর্কিত, স্নায়বিক, অন্তরাত্মার ভাষা।

স্পাইরাল অব সাইলেন্স ভাঙার একমাত্র পথ হচ্ছে, কেউ একজন কথা বলা শুরু করুক। ভয়কে চ্যালেঞ্জ করলেই বাকিরা সাহস পায়। এক ব্যক্তি ফেসবুকে সাহস করে সত্য বলতে পারেন। কেউ হয়তো নতুন নাটকে ঘুরিয়ে বলতে পারেন সংলাপ। একজন লেখক লিখতে পারেন গল্পের ভেতরে অন্য গল্প। এইরকম ছোট ছোট প্রকাশ স্পাইরাল ভেঙে দিতে পারে। যেহেতু রাজনৈতিক মাঠ সংকুচিত, তাই সংস্কৃতির মাধ্যমেই স্ট্রাকচার অব ফিলিং-এর ভাষা উচ্চারিত হোক। সাহসী সিনেমা, সাহসী নাটক, স্বাধীন সাহিত্যিকেরা সম্মিলিতভাবে মানুষের চেপে থাকা অনুভূতি প্রকাশ করুক। শিক্ষিত তরুণ সমাজকে স্পষ্ট অবস্থান নিতে হবে। যদি তারা আবারও চুপ করে যায়, তবে পরবর্তী প্রজন্ম একটি ভয়-ভীতিপূর্ণ, অভিব্যক্তিহীন রাষ্ট্রব্যবস্থা পাবে।


বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিসর একটি দ্বৈত বাস্তবতায় আবদ্ধ—বহিরঙ্গে রয়েছে একপ্রকার কৃত্রিম ঐক্য, প্রচারের জাঁকজমক, নতুন বাংলাদেশের বয়ান; আর অন্তরঙ্গে রয়েছে স্তব্ধতা, সন্দেহ, হতাশা, ক্ষোভ এবং পুরনো পথে হাঁটা। এই স্তব্ধতা ভাষাহীন, কারণ ভয় রয়েছে। রেমন্ড ইউলিয়ম এবং এলিজাবেথ নিউম্যান আমাদের দেখিয়েছেন—একটি সমাজ তখনই বদলায়, যখন মানুষ আবার ভাষা খুঁজে পায়। সেই ভাষা হয়তো সরাসরি রাজনীতি নয়— হতে পারে কবিতা, নাটক, চিত্রকলা, ব্যঙ্গচিত্র।
নীরবতা যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নয়, তা বহুবার প্রমাণ হয়েছে। আবারও হবে। কবে এবং কীভাবে অপেক্ষা সেটার।

নীরবতা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নয়

০৮:০০:৫৬ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১১ জুন ২০২৫

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতির বাস্তবতায় দুটি তাত্ত্বিক ফ্রেমওয়ার্ক আমাদের আলোকিত করতে পারে। একটি হলো রেমন্ড ইউলিয়মের ‘স্ট্রাকচার অব ফিলিং’—যার মাধ্যমে তিনি বলেন, প্রত্যক্ষ ভাষা বা প্রতিষ্ঠিত মতাদর্শের বাইরেও সমাজের মানুষের অনুভবের একটা অদৃশ্য কাঠামো থাকে, যেটি নির্দিষ্ট সময়কালের মনোভাবকে ধারণ করে। আরেকটি হলো এলিজাবেথ নোয়েল-নিউম্যানের ‘স্পাইরাল অব সাইলেন্স’—যেখানে বলা হয়, জনমতের দমন ও ভয়াবহ এক সামাজিক পরিবেশে মানুষ নিজের মত গোপন করে, নীরবতা ধারণ করে, আর এই নৈঃশব্দ্য আবার ক্ষমতাকে আরও দুঃসাহসী করে তোলে। এই দুটি ধারণাকে সামনে রেখে আমরা যদি বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে পর্যালোচনা করি, তাহলে বোঝা যায় যে, রাষ্ট্র এবং সমাজের মধ্যে একটি গভীর স্নায়বিক সংকট চলমান, যার অনেকটাই ভাষাহীন এবং বর্ণনাতীত।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসর এক সময় সরব ছিল। ছাত্র রাজনীতি, পত্রপত্রিকা, কবিতা, মিছিল, নাগরিক প্রতিবাদ—এসব ছিল সক্রিয় ও প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক চর্চার অংশ। কিন্তু গত প্রায় এক দশকে একটি পরিবর্তন লক্ষণীয়। মানুষ প্রতিবাদ করে না, কথা বলে না, রাজনীতি নিয়ে স্পষ্ট মত দেয় না। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে মানুষ কিছু অনুভব করে না। বরং একটি অদৃশ্য, অসমাপ্ত, প্রায়-নিষিদ্ধ অনুভূতির পরিসর তৈরি হয়েছে—যাকে ইউলিয়ম বলতেন স্ট্রাকচার অব ফিলিং।
এই অনুভূতির কাঠামো নিছক ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয়। এটি একধরনের ‘মুড’, এক জাতের ‘সমষ্টিগত অস্বস্তি’, যা সরাসরি রাজনীতির ভাষায় ধরা যায় না। মানুষ যখন অফিসে বসে চুপচাপ একটি সিদ্ধান্ত মেনে নেয়, কিংবা কোনো নির্বাচনে ভোট দিতে না গিয়েও নিজের বিবেককে প্রশ্ন করে না—তখন সেটা শুধু রাজনৈতিক নিষ্ক্রিয়তা নয়, বরং একধরনের সামাজিক অভ্যস্ততা, যা গড়ে উঠেছে যুগের বাস্তবতায়।

বাংলাদেশে ক্রমাগতভাবে এই অনুভবের কাঠামো তৈরি হয়েছে—যেখানে মানুষ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয়, রাজনীতির পক্ষেও নয়; বরং নিজের নিরাপত্তা, বাঁচার চেষ্টা ও সামাজিক চাপ থেকে নিরুত্তাপ হয়ে গেছে। এটি একটি ‘শীতল অনুভূতির জমাট বাঁধা’, যা কখনো সিনেমায়, কখনো গল্পে, কখনো ব্যক্তিগত আলাপে ফেটে বেরোয়।
অন্যদিকে নিউম্যানের স্পাইরাল অব সাইলেন্স তত্ত্ব বলছে—যখন একটি মত জনপ্রিয় বা অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্কিত হয়, তখন মানুষ বিরুদ্ধ মত প্রকাশে ভয় পায়। কারণ তারা মনে করে, যদি আমি একা হয়ে যাই? যদি সামাজিকভাবে প্রত্যাখ্যাত হই? যদি শাস্তি পাই? ফলে যে কোনো সরকার যখন একটি নির্দিষ্ট মত বা বয়ানকে একমাত্র সত্য হিসেবে তুলে ধরে, এবং সব ভিন্ন মতকে সন্দেহের চোখে দেখে, তখন স্পাইরাল শুরু হয়। একজন চুপ করে যায়, তার ফলে আরেকজনও চুপ করে যায় এবং ধীরে ধীরে সমাজ একটি নিষ্প্রাণ বাগাড়ম্বরের মধ্যে প্রবেশ করে, যেখানে অনেক কিছু বলা হয় কিন্তু খুব কমই আসলে অর্থবহ।
২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল ঘনীভূত, উত্তপ্ত, কিন্তু একইসঙ্গে অদ্ভুতভাবে নিস্তব্ধ। বিরোধী দলের অংশগ্রহণ না থাকা, একতরফা ফলাফল, স্বল্প ভোটার উপস্থিতি এবং বিরোধিতাকারী গোষ্ঠীর ওপর দমন-পীড়ন—সব কিছু সত্ত্বেও গণমাধ্যম, সামাজিক পরিসর কিংবা নাগরিক আলোচনায় সেই মাত্রার প্রতিক্রিয়া অনুপস্থিত ছিল। এটি স্পাইরাল অব সাইলেন্স-এর একটি নিখুঁত প্রতিচ্ছবি। মানুষ জানত ওই নির্বাচন বাস্তবতাবর্জিত, কিন্তু কেউ কিছু বলেনি। অনেকে সোশ্যাল মিডিয়ায়ও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। ফেসবুক-টুইটারে দেখা দেয় ভোট নিয়ে একধরনের অস্বস্তিকর মৌনতা। এই নৈঃশব্দ্যের ভেতরেই গড়ে ওঠে একটি স্ট্রাকচার অব ফিলিং—একধরনের দুর্বোধ্য ক্লান্তি, যেখানে মানুষ নিজের হতাশাকে ভাষা দিতে পারে না, কিন্তু তা অনুভব করে।
২০২৩ সালের শেষ প্রান্তে বিএনপি, জামায়াত ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে কিছুটা সক্রিয় হয়েছিল। আন্দোলন শুরু হয়, সমাবেশ হয়, কিন্তু রাষ্ট্রীয় দমননীতির কারণে আন্দোলন ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ে। প্রচুর সংখ্যক গ্রেফতার, বিচারবহির্ভূত হয়রানি, এবং মিডিয়ায় অপ্রতুল কভারেজ মানুষকে বুঝিয়ে দেয়—চুপ থাকাই নিরাপদ। এই ভয়-ভীতি সামাজিকভাবে এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ে যে, মিছিলের চেয়ে ঘরে বসে চুপচাপ থাকা ‘রাজনৈতিক কৌশল’ হয়ে দাঁড়ায়। এটাই স্পাইরাল অব সাইলেন্স । আর এই দমননীতির ছায়ায় জন্ম নেয় এক সামাজিক অনুভূতির কাঠামো—হতাশা, তাচ্ছিল্য, আত্মঘাতী নির্লিপ্তি।


ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন মানুষের মতপ্রকাশের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। পত্রিকা, ব্লগ, ইউটিউব, ফেসবুক—সব জায়গায় রাজনৈতিক মতপ্রকাশকে আইনগত হুমকির মুখে ফেলা হয়েছে। এর ফলাফল হলো আত্মনিয়ন্ত্রণ। ‘আমি কি এটা পোস্ট করব?’—এই প্রশ্ন প্রতিটি মানুষের মনে। কেউ সরাসরি বিরোধিতা করে না, বরং রূপকের আশ্রয় নেয়। কেউ ছদ্মনামে পোস্ট করে। কোনো রাজনৈতিক ব্যঙ্গ হলে সেটি হয় ‘রেনবো হ্যাশট্যাগ’ দিয়ে। এগুলো সবই স্পাইরাল অব সাইলেন্স-এর বহুমাত্রিক রূপ। আর এইসব সীমাবদ্ধতার মধ্যে মানুষ যে অনুভূতিগুলো প্রকাশ করতে পারে না, সেগুলো জমতে জমতে গড়ে তোলে একটি বিশাল অভ্যন্তরীণ সংকট—ইউলিয়ম যাকে বলেছিলেন ‘ঐতিহাসিক বাস্তবতার অবচেতন ভাষা।‘
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা কিছুটা কঠিন। সরকার পরিবর্তন হলেও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অবারিত হয়নি। সরকার প্রধান মন খুলে সমালোচনা করতে বললেও সমালোচনা করার ফল ভালো হয়নি, সরকারসংশ্লিষ্ট দাপুটে ব্যক্তিরা সেটা ভালোভাবে নেন না।

যদিও রাজনৈতিক মতপ্রকাশ সীমিত, কিন্তু এই নৈঃশব্দ্যের অবসান ঘটতে পারে নানা সাংস্কৃতিক মাধ্যমে। নাটকে উঠে আসতে পারে রাষ্ট্র বনাম ব্যক্তি দ্বন্দ্ব, দুর্নীতির ব্যঙ্গচিত্র। সরকারি অনুদানে তৈরি হলেও কিছু কিছু সিনেমা রূপকধর্মী বিরোধিতা নিয়ে আসতে। শিল্পীরা এখন সরাসরি রাজনীতি নয়, বরং আভাসিত রাজনৈতিক হতাশা আঁকতে পারেন—অন্ধ চোখ, বদ্ধ কণ্ঠ, শূন্য মাঠ। নতুন প্রজন্মের ব্যান্ড গান বা উচ্চারিত কবিতায় উঠে আসে, ‘তুমি চাইলেও কিছু বলতে পারো না।‘ কবিতা হয়ে যায় বিদ্রোহের জায়গা, কিন্তু সরাসরি নয়—ইশারায়, প্রশ্নে, মেটাফরে। এগুলোই সেই স্ট্রাকচার অব ফিলিং—যা যুক্তিবাদী রাজনীতির চেয়ে অনেক বেশি আন্তঃসম্পর্কিত, স্নায়বিক, অন্তরাত্মার ভাষা।

স্পাইরাল অব সাইলেন্স ভাঙার একমাত্র পথ হচ্ছে, কেউ একজন কথা বলা শুরু করুক। ভয়কে চ্যালেঞ্জ করলেই বাকিরা সাহস পায়। এক ব্যক্তি ফেসবুকে সাহস করে সত্য বলতে পারেন। কেউ হয়তো নতুন নাটকে ঘুরিয়ে বলতে পারেন সংলাপ। একজন লেখক লিখতে পারেন গল্পের ভেতরে অন্য গল্প। এইরকম ছোট ছোট প্রকাশ স্পাইরাল ভেঙে দিতে পারে। যেহেতু রাজনৈতিক মাঠ সংকুচিত, তাই সংস্কৃতির মাধ্যমেই স্ট্রাকচার অব ফিলিং-এর ভাষা উচ্চারিত হোক। সাহসী সিনেমা, সাহসী নাটক, স্বাধীন সাহিত্যিকেরা সম্মিলিতভাবে মানুষের চেপে থাকা অনুভূতি প্রকাশ করুক। শিক্ষিত তরুণ সমাজকে স্পষ্ট অবস্থান নিতে হবে। যদি তারা আবারও চুপ করে যায়, তবে পরবর্তী প্রজন্ম একটি ভয়-ভীতিপূর্ণ, অভিব্যক্তিহীন রাষ্ট্রব্যবস্থা পাবে।


বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিসর একটি দ্বৈত বাস্তবতায় আবদ্ধ—বহিরঙ্গে রয়েছে একপ্রকার কৃত্রিম ঐক্য, প্রচারের জাঁকজমক, নতুন বাংলাদেশের বয়ান; আর অন্তরঙ্গে রয়েছে স্তব্ধতা, সন্দেহ, হতাশা, ক্ষোভ এবং পুরনো পথে হাঁটা। এই স্তব্ধতা ভাষাহীন, কারণ ভয় রয়েছে। রেমন্ড ইউলিয়ম এবং এলিজাবেথ নিউম্যান আমাদের দেখিয়েছেন—একটি সমাজ তখনই বদলায়, যখন মানুষ আবার ভাষা খুঁজে পায়। সেই ভাষা হয়তো সরাসরি রাজনীতি নয়— হতে পারে কবিতা, নাটক, চিত্রকলা, ব্যঙ্গচিত্র।
নীরবতা যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নয়, তা বহুবার প্রমাণ হয়েছে। আবারও হবে। কবে এবং কীভাবে অপেক্ষা সেটার।