১১:২৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১১ নভেম্বর ২০২৫
জাপানে বাড়ছে ভাল্লুক আতঙ্ক: নিরাপত্তা জোরদারে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ সংযুক্ত আরব আমিরাতের শারজাহ বইমেলায় ৩০০ শিশুর লেখক অভিষেক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ঢাকা (পর্ব-৫৩) শাহজালালসহ দেশের সব বিমানবন্দরে সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি আল-ওথমান মসজিদের পুনঃস্থাপন কাজ শেষের পথে, রমজানের আগেই পুনরায় খোলা হবে ভুলভাবে উপস্থাপিত বক্তব্য নিয়ে ব্যাখ্যা দিলেন মির্জা ফখরুল দিল্লিতে হামলার ছক তৈরির অভিযোগে ভারতের দাবি প্রত্যাখ্যান করল ঢাকা ২৪ ঘণ্টায় আরও ৩ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৯১২ জন সূত্রাপুরে দাঁড়িয়ে থাকা বাসে আগুনে আতঙ্ক হামাস যোদ্ধাদের আটকে থাকা পরিস্থিতি গাজা চুক্তির অগ্রগতি ব্যাহত করছে

আগে টাকা, পরে পণ্য: চীনে ব্যক্তিগত ঋণের ব্যতিক্রমী সংস্কৃতি

ভোক্তা খরচে উৎসাহ দিতে চীনের নতুন কৌশল

চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য যুদ্ধের অভিঘাত সামাল দিতে চীনা সরকার এখন দেশীয় অর্থনীতিকে সচল রাখার লক্ষ্যে সাধারণ ভোক্তাদের আরও বেশি খরচে উৎসাহ দিচ্ছে। এর অংশ হিসেবে সরকার গ্রাহক ঋণে ভর্তুকি দেওয়ার পরিকল্পনা করছে, আর ব্যাংকগুলোকে ভালো গ্রাহকদের ঋণসীমা বাড়ানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু চীনের ক্রেডিট সংস্কৃতি পশ্চিমা দুনিয়ার তুলনায় একেবারেই আলাদা। যেখানে পশ্চিমে দোকানদার বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের ঋণ দেয়, সেখানে চীনে অনেক ক্ষেত্রেই গ্রাহকই ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে আগে টাকা দিয়ে রাখে।

চীনের আগে টাকাপরে পণ্য” পদ্ধতি

চীনের রেস্টুরেন্ট বা বিউটি সেলুনে গেলে অনেক সময় ক্রেতাদের একাধিক সেবার জন্য আগেভাগেই টাকা জমা রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ, কেউ হয়তো একসঙ্গে দশবার চুল কাটার টাকা দিয়ে রাখে, অথবা ১,০০০ ইউয়ান (প্রায় ১৪০ মার্কিন ডলার) একটি প্রিপেইড কার্ডে জমা রাখে—যার বদলে অতিরিক্ত কিছু মূল্যছাড় পাওয়া যায়।

এই প্রক্রিয়াটি অনেকটা পশ্চিমা দেশগুলোর “Buy now, pay later” বা “এখন কিনুন, পরে পরিশোধ করুন” সংস্কৃতির বিপরীত। চীনে মূলত “Pay now, buy later” বা “আগে টাকা দিন, পরে পণ্য নিন” সংস্কৃতি চালু আছে।

প্রিপেইড কার্ডের বিস্তার

২০২৩ সালে চীনে প্রায় ১৫০ কোটিরও বেশি প্রিপেইড কার্ড ইস্যু করা হয়েছে, যেগুলোর আর্থিক মূল্য ছিল প্রায় ৭৪০ বিলিয়ন ইউয়ান। এসব কার্ড থেকে অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের আয়ের ১০ শতাংশেরও বেশি পায়। এতে প্রতিষ্ঠানগুলো আগাম বিক্রির নিশ্চয়তা পায় এবং নগদ অর্থও জোগাড় করতে পারে।

এই প্রিপেইড ব্যবস্থায় যত বেশি অগ্রিম অর্থ জমা রাখা হয়, তত বেশি প্রণোদনা পাওয়া যায়। কেউ যদি ১০,০০০ ইউয়ান জমা রাখে, তাহলে সে অতিরিক্ত ২,০০০ ইউয়ান ব্যবহার করতে পারে—যা এক অর্থে বার্ষিক ২০ শতাংশ সুদের সমতুল্য, যদিও তা নগদ নয়, বরং পণ্যের মাধ্যমে প্রদান করা হয়।

ভ্যাংশ এবং ঝুঁকি

বিশ্বের অন্যান্য দেশেও লয়্যালটি স্কিম জনপ্রিয়। উদাহরণস্বরূপ, নয়টি কফির কাপ কিনলে দশমটি বিনামূল্যে পাওয়া যায়। জিম বা যোগ ক্লাসেও প্রিপেইড প্যাকেজ প্রচলিত, তবে সেখানে নির্দিষ্ট সময়সূচির ভিত্তিতে ব্যবহার করতে হয়। চীনের প্রিপেইড কার্ডগুলো অনেকটা গিফট কার্ডের মতো হলেও এগুলোর মেয়াদ থাকে না—ফলে অনেকেই দীর্ঘ সময় পরও এগুলো ব্যবহার করতে পারেন।

তবে বড় ঝুঁকিটা হল—যদি কোনো প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে গ্রাহকের টাকাও হারিয়ে যেতে পারে। ২০২১ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, ৮০ শতাংশ মানুষ প্রিপেইড স্কিমে অংশ নিয়েছেন, আর তাদের মধ্যে ৪৫ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায়। শুধু দেউলিয়া নয়, কিছু প্রতারক প্রতিষ্ঠানও এই ব্যবস্থাকে প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ আদায়ে ব্যবহার করছে।

আইনি সুরক্ষা ও নতুন নীতিমালা

প্রিপেইড ব্যবস্থা নিয়ে জনঅসন্তোষ সৃষ্টি হওয়ায় বিষয়টি চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নজরে এসেছে। ২০২৫ সালের মার্চে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট নতুন নির্দেশনা দিয়েছে, যার ভিত্তিতে ১ মে থেকে কার্যকর হওয়া আইনের মাধ্যমে কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নাম বা মালিকানা বদলে গ্রাহকের দায় এড়াতে পারবে না।

এছাড়াও শপিং মলের মালিকদের ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, যাতে তারা ভাড়াটিয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর গ্রহণযোগ্যতা যাচাই করে। যদি কোনো প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের অর্থ আত্মসাত্ করে চলে যায়, তাহলে মলের মালিককেও দায় নিতে হবে।

সরকারি পত্রিকা ‘লিগ্যাল ডেইলিতে’ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—এই সুরক্ষা নীতিমালার মাধ্যমে জনগণ “নির্ভয়ে খরচ করতে পারবে”, যা অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি গতি আনবে।

আরও লোভনীয় অফার

বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়াতে কিছু প্রতিষ্ঠান আরও আকর্ষণীয় অফার দিচ্ছে। ১ মে বেইজিংয়ের একটি রিফ্লেক্সোলজি স্পা ঘোষণা দিয়েছে—যদি কেউ ১০,০০০ ইউয়ান জমা রাখে, তবে সে অতিরিক্ত ৭,২০০ ইউয়ানের মানসিক চাপ কমানোর থেরাপি নিতে পারবে।

এই প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘদিনের সুনাম রয়েছে। এমন অফারের পর প্রতিবেদক স্বয়ং একবার ভাবছিলেন, “ভোক্তা হওয়া যায় কি না”।

চীনে “আগে টাকা, পরে সেবা” সংস্কৃতি বৈশ্বিক ঋণ ব্যবস্থার একটি ব্যতিক্রমী দিক। এই ব্যবস্থায় ব্যবসা যেমন আগাম অর্থ পায়, তেমনি গ্রাহকেরাও লাভবান হয়—তবে দেউলিয়া হওয়ার ঝুঁকিও থেকেই যায়। সরকার এখন এই ব্যবস্থাকে নিয়মবদ্ধ করতে উদ্যোগ নিয়েছে, যাতে অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আসে এবং জনগণ আস্থা ফিরে পায়।

জনপ্রিয় সংবাদ

জাপানে বাড়ছে ভাল্লুক আতঙ্ক: নিরাপত্তা জোরদারে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ

আগে টাকা, পরে পণ্য: চীনে ব্যক্তিগত ঋণের ব্যতিক্রমী সংস্কৃতি

০২:২০:৩৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ১১ জুন ২০২৫

ভোক্তা খরচে উৎসাহ দিতে চীনের নতুন কৌশল

চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য যুদ্ধের অভিঘাত সামাল দিতে চীনা সরকার এখন দেশীয় অর্থনীতিকে সচল রাখার লক্ষ্যে সাধারণ ভোক্তাদের আরও বেশি খরচে উৎসাহ দিচ্ছে। এর অংশ হিসেবে সরকার গ্রাহক ঋণে ভর্তুকি দেওয়ার পরিকল্পনা করছে, আর ব্যাংকগুলোকে ভালো গ্রাহকদের ঋণসীমা বাড়ানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু চীনের ক্রেডিট সংস্কৃতি পশ্চিমা দুনিয়ার তুলনায় একেবারেই আলাদা। যেখানে পশ্চিমে দোকানদার বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের ঋণ দেয়, সেখানে চীনে অনেক ক্ষেত্রেই গ্রাহকই ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে আগে টাকা দিয়ে রাখে।

চীনের আগে টাকাপরে পণ্য” পদ্ধতি

চীনের রেস্টুরেন্ট বা বিউটি সেলুনে গেলে অনেক সময় ক্রেতাদের একাধিক সেবার জন্য আগেভাগেই টাকা জমা রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ, কেউ হয়তো একসঙ্গে দশবার চুল কাটার টাকা দিয়ে রাখে, অথবা ১,০০০ ইউয়ান (প্রায় ১৪০ মার্কিন ডলার) একটি প্রিপেইড কার্ডে জমা রাখে—যার বদলে অতিরিক্ত কিছু মূল্যছাড় পাওয়া যায়।

এই প্রক্রিয়াটি অনেকটা পশ্চিমা দেশগুলোর “Buy now, pay later” বা “এখন কিনুন, পরে পরিশোধ করুন” সংস্কৃতির বিপরীত। চীনে মূলত “Pay now, buy later” বা “আগে টাকা দিন, পরে পণ্য নিন” সংস্কৃতি চালু আছে।

প্রিপেইড কার্ডের বিস্তার

২০২৩ সালে চীনে প্রায় ১৫০ কোটিরও বেশি প্রিপেইড কার্ড ইস্যু করা হয়েছে, যেগুলোর আর্থিক মূল্য ছিল প্রায় ৭৪০ বিলিয়ন ইউয়ান। এসব কার্ড থেকে অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের আয়ের ১০ শতাংশেরও বেশি পায়। এতে প্রতিষ্ঠানগুলো আগাম বিক্রির নিশ্চয়তা পায় এবং নগদ অর্থও জোগাড় করতে পারে।

এই প্রিপেইড ব্যবস্থায় যত বেশি অগ্রিম অর্থ জমা রাখা হয়, তত বেশি প্রণোদনা পাওয়া যায়। কেউ যদি ১০,০০০ ইউয়ান জমা রাখে, তাহলে সে অতিরিক্ত ২,০০০ ইউয়ান ব্যবহার করতে পারে—যা এক অর্থে বার্ষিক ২০ শতাংশ সুদের সমতুল্য, যদিও তা নগদ নয়, বরং পণ্যের মাধ্যমে প্রদান করা হয়।

ভ্যাংশ এবং ঝুঁকি

বিশ্বের অন্যান্য দেশেও লয়্যালটি স্কিম জনপ্রিয়। উদাহরণস্বরূপ, নয়টি কফির কাপ কিনলে দশমটি বিনামূল্যে পাওয়া যায়। জিম বা যোগ ক্লাসেও প্রিপেইড প্যাকেজ প্রচলিত, তবে সেখানে নির্দিষ্ট সময়সূচির ভিত্তিতে ব্যবহার করতে হয়। চীনের প্রিপেইড কার্ডগুলো অনেকটা গিফট কার্ডের মতো হলেও এগুলোর মেয়াদ থাকে না—ফলে অনেকেই দীর্ঘ সময় পরও এগুলো ব্যবহার করতে পারেন।

তবে বড় ঝুঁকিটা হল—যদি কোনো প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে গ্রাহকের টাকাও হারিয়ে যেতে পারে। ২০২১ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, ৮০ শতাংশ মানুষ প্রিপেইড স্কিমে অংশ নিয়েছেন, আর তাদের মধ্যে ৪৫ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায়। শুধু দেউলিয়া নয়, কিছু প্রতারক প্রতিষ্ঠানও এই ব্যবস্থাকে প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ আদায়ে ব্যবহার করছে।

আইনি সুরক্ষা ও নতুন নীতিমালা

প্রিপেইড ব্যবস্থা নিয়ে জনঅসন্তোষ সৃষ্টি হওয়ায় বিষয়টি চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নজরে এসেছে। ২০২৫ সালের মার্চে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট নতুন নির্দেশনা দিয়েছে, যার ভিত্তিতে ১ মে থেকে কার্যকর হওয়া আইনের মাধ্যমে কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নাম বা মালিকানা বদলে গ্রাহকের দায় এড়াতে পারবে না।

এছাড়াও শপিং মলের মালিকদের ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, যাতে তারা ভাড়াটিয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর গ্রহণযোগ্যতা যাচাই করে। যদি কোনো প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের অর্থ আত্মসাত্ করে চলে যায়, তাহলে মলের মালিককেও দায় নিতে হবে।

সরকারি পত্রিকা ‘লিগ্যাল ডেইলিতে’ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—এই সুরক্ষা নীতিমালার মাধ্যমে জনগণ “নির্ভয়ে খরচ করতে পারবে”, যা অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি গতি আনবে।

আরও লোভনীয় অফার

বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়াতে কিছু প্রতিষ্ঠান আরও আকর্ষণীয় অফার দিচ্ছে। ১ মে বেইজিংয়ের একটি রিফ্লেক্সোলজি স্পা ঘোষণা দিয়েছে—যদি কেউ ১০,০০০ ইউয়ান জমা রাখে, তবে সে অতিরিক্ত ৭,২০০ ইউয়ানের মানসিক চাপ কমানোর থেরাপি নিতে পারবে।

এই প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘদিনের সুনাম রয়েছে। এমন অফারের পর প্রতিবেদক স্বয়ং একবার ভাবছিলেন, “ভোক্তা হওয়া যায় কি না”।

চীনে “আগে টাকা, পরে সেবা” সংস্কৃতি বৈশ্বিক ঋণ ব্যবস্থার একটি ব্যতিক্রমী দিক। এই ব্যবস্থায় ব্যবসা যেমন আগাম অর্থ পায়, তেমনি গ্রাহকেরাও লাভবান হয়—তবে দেউলিয়া হওয়ার ঝুঁকিও থেকেই যায়। সরকার এখন এই ব্যবস্থাকে নিয়মবদ্ধ করতে উদ্যোগ নিয়েছে, যাতে অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আসে এবং জনগণ আস্থা ফিরে পায়।