দীর্ঘ ঠিকানা, দ্বিগুণ সমস্যা
একটি বিজ্ঞাপন শুরু হয় এমনভাবে—এক নারী তার স্বামীকে মনোরোগ চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেছেন। তিনি বলেন, “এতবার আমাদের ঠিকানা বলতে বলতেই উনি পাগল হয়ে গেছেন।” স্বামী কেবল বিড়বিড় করছেন: “এ-৪২ ভানুশালী অ্যাপার্টমেন্টস…”। বিজ্ঞাপনটি এমন একটি অ্যাপের প্রচার করে যা জটিল ও দীর্ঘ ঠিকানাকে সহজে ব্যবহারের উপযোগী বানানোর চেষ্টা করে। তবে চার বছর আর কোটি কোটি ইউটিউব ভিউ পার হলেও, ঠিকানাজনিত সমস্যা ভারতের শহরগুলোতে তেমন কমেনি।
অনলাইন কেনাকাটার প্রবৃদ্ধির কারণে বহু শহুরে ভারতীয় প্রতিদিন বারবার তাদের ঠিকানা জানাচ্ছেন—প্রায় প্রতিটি ডেলিভারিতে দু’বার বা তিনবার।
পশ্চিমা ঠিকানা বনাম ভারতীয় ঠিকানা
পশ্চিমা দেশগুলোতে ঠিকানার একটি পরিষ্কার, সুশৃঙ্খল কাঠামো থাকে: রাস্তার নাম ও নম্বর, জেলা, শহর, পোস্ট কোড। কিন্তু ভারতের ঠিকানাগুলোতে এর বাইরেও অনেক কিছু থাকে: “SBI এটিএমের পাশে”, “গণেশ মন্দিরের পেছনে”, “মিনার্ভা সিনেমার কাছে”—এইরকম অসংখ্য নির্ভরযোগ্য বা পরিবর্তনশীল চিহ্ন।
ডেলিভারি লজিস্টিকস কোম্পানি ডেলিভারির সাবেক প্রযুক্তি প্রধান শান্তনু ভট্টাচার্য বলছেন, ভারতে “পাশে” শব্দটির গড় মানে প্রায় ৮০ মিটার দূরে। এছাড়া, প্রায় ৩০ শতাংশ পোস্ট কোড ভুলভাবে লেখা হয়।
মানচিত্রে পৌঁছানোও কঠিন
ভারতের ডাক বিভাগ হিসাব করেছে, দেশে প্রায় ৭৫ কোটি ঘরবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য পৃথক অবস্থান রয়েছে। ২০২১ সালে বিভাগের এক গবেষণায় বলা হয়, প্রচলিত ঠিকানা বা ল্যান্ডমার্কের মাধ্যমে গন্তব্যে পৌঁছানো বেশ কষ্টসাধ্য।
গুগল ম্যাপের মতো অ্যাপ কার্যকর হলেও, তাও তখনই কাজ করে যখন ঠিকানা সঠিকভাবে লেখা হয়। আর কেউ একজন নিজের অবস্থানের পিন পাঠালে সেটি ব্যক্তিগতভাবে কার্যকর হলেও সার্বজনীনভাবে এটি বাস্তবায়নযোগ্য নয়। তার ওপর, ল্যান্ডমার্কগুলো হারিয়ে যেতেও পারে।
নামহীন রাস্তা ও রাজনৈতিক নামবদল
ভারতের অনেক ছোট শহরে রাস্তার নামই থাকে না। এক হিসাবে দেখা গেছে, ৬০ থেকে ৯০ শতাংশ রাস্তার কোনো নাম নেই। আর নাম থাকলেও, সাইনবোর্ড থাকে না। এমনকি সরকারিভাবে থাকা নাম আর সাধারণ ব্যবহারকারীদের ব্যবহৃত নামের মধ্যে বিস্তর ফারাক থাকে। তার ওপর রাজনীতিবিদরা প্রায়শই নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী রাস্তাঘাট বা শহরের নাম বদলে দেন।
এই সমস্যা নতুন নয়। উপনিবেশিক আমলের বোম্বে ও কলকাতায় (বর্তমানে মুম্বাই ও কলকাতা) “শুধু ভালো বাড়িগুলোতেই নম্বর থাকত… সম্ভবত কারণ ওগুলোতেই কর ধার্য হতো”—১৯০০ ও ১৯০১ সালের ডিরেক্টরি ও জনগণনার একটি গবেষণায় এ কথা বলা হয়। স্বাধীনতার ৭৮ বছর পরও এই সমস্যার সুরাহা হয়নি।
ভোগান্তি শুধু সাধারণ মানুষের নয়
গ্রাহকদের ধৈর্যচ্যুতি ছাড়াও ব্যবসায়িক খরচও বেড়েছে। লজিস্টিকস, ডেলিভারি, ই-কমার্সের খরচ ও উৎপাদনশীলতা কমছে। উবার চালকরা ঠিকানা খুঁজতে সময় ও জ্বালানি অপচয় করছেন।
গ্রামীণ অর্থনীতিতেও ঠিকানা বিশৃঙ্খলার প্রভাব পড়ছে। সেখানে জমির মালিকানা রেকর্ড এখনো উপনিবেশিক এবং উপ-উপনিবেশিক আমলের রাজস্ব ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে চলে। ভূমি জরিপকারী কর্মকর্তারা জমিকে চিহ্নিত করতে বিভিন্ন নম্বর ব্যবহার করেন—কখনো খাসরা, কখনো খতিয়ান, কখনো “৭/১২” নামের কাগজ।
জমি ভাগ হতে হতে অনেক জায়গায় প্রাথমিক নম্বরগুলোর সঙ্গে নতুন নম্বর যুক্ত হয়ে ঠিকানা আরও জটিল হয়ে পড়েছে।
একটি জমি বন্ধক রাখতে চাইলে ব্যাংককে দুটি বড় সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। প্রথমত, জমিটি সত্যিই আছে কি না, তা যাচাই করতে সময় ও খরচ বেশি হয়, প্রায়ই কাউকে সেখানে পাঠাতে হয়। দ্বিতীয়ত, প্রতারণার আশঙ্কা থাকে, কারণ জমির মালিক একই জমির ভিন্ন নথি দিয়ে একাধিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারেন। এর ফলে পুঁজি ব্যয়বহুল হয় ও ঋণ পুনরুদ্ধারে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হয়।
জিডিপির ক্ষতিও স্পষ্ট
এই সমস্যা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটি মিডিয়া ল্যাবে কাজ করা শান্তনু ভট্টাচার্য হিসাব করেছেন, ঠিকানা-সংক্রান্ত অদক্ষতা ভারতীয় জিডিপির প্রায় ০.৫ শতাংশ ক্ষতি করে।
সমাধান আছে, কিন্তু সহজ নয়
বেসরকারি কিছু কোম্পানি ও সরকার উভয়ই সমস্যাটি স্বীকার করে পদক্ষেপ নিচ্ছে। সরকার “ইউনিক ল্যান্ড পার্সেল আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার” নামে ১৪ ডিজিটের একটি নতুন নম্বর চালু করছে। কিছু শহরে “ইউনিক প্রপার্টি আইডেন্টিফিকেশন কোড” চালু হয়েছে। ডাক বিভাগ তৈরি করছে ১০ অক্ষরের “ডিজিপিন”।
এই সব পদ্ধতির সুবিধা আছে, কিন্তু আদর্শ একটি ঠিকানা পদ্ধতি হওয়া উচিত মনে রাখা সহজ এবং ব্যবহার-বান্ধব।
সবসময় হারিয়ে থাকার যে মূল্য, তা অর্থনীতিকে দুর্বল করে। এই সমস্যার সমাধান ভারতকে দ্রুত করতে হবে।