ঢাকার কানায় কানায় পূর্ণ জাতীয় স্টেডিয়ামে হাজারো ফুটবল সমর্থকের সামনে এএফসি এশিয়ান কাপ ২০২৭ বাছাই পর্বের দ্বিতীয় ম্যাচে বাংলাদেশ ১-২ গোলে হেরে যায় সিঙ্গাপুরের কাছে। স্বাগতিক দলের এই পরাজয় শুধু পয়েন্ট তালিকায় ধাক্কা নয়, বরং জাতীয় দলের কৌশলগত দুর্বলতা ও মাঠে বাস্তবায়নের ঘাটতি তুলে ধরেছে।
এই পরাজয়ের পেছনে কয়েকটি নির্দিষ্ট কারণ স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। নিচে তা বিশ্লেষণ করা হলো:
রক্ষণভাগে ভুল এবং সমন্বয়ের অভাব
বাংলাদেশ প্রথমার্ধের শেষ মিনিটে এবং দ্বিতীয়ার্ধের মাঝামাঝি সময়ে দুটি গোল হজম করেছে, যা প্রতিপক্ষের ফাঁকা জায়গা কাজে লাগানোরই ফল। সিঙ্গাপুরের মিডফিল্ডার সং ইউ ইয়ং এবং ফরোয়ার্ড খসান ফান্দির গোল দুটি ছিল মূলত বাংলাদেশ ডিফেন্সের অগোছালো চাপ মোকাবেলার ব্যর্থতার উদাহরণ।
বিশেষ করে, গোল দুটি রক্ষণভাগের সমন্বয়হীনতা ও চূড়ান্ত জোনে চাপ সামলাতে না পারার ফল। সেন্টার ব্যাক ও ফুল ব্যাকদের মাঝে ভুল বোঝাবুঝি এবং বল ক্লিয়ার করতে না পারার অভ্যাসে বারবার ঝুঁকিতে পড়ে বাংলাদেশ।
প্রতিপক্ষের আক্রমণাত্মক পাসিং গেম ও গতি সামলাতে না পারা
সিঙ্গাপুর অনেকটা ইউরোপীয় ঘরানার মতো শর্ট পাসিং ও লো-ক্রস নির্ভর খেলায় বাংলাদেশকে চাপে ফেলে। সং ইউ ইয়ং ও খসান ফান্দি বেশ কয়েকবার বাংলাদেশ মিডফিল্ডকে বিভ্রান্ত করে বল ওপরে তুলতে পেরেছেন।
বাংলাদেশের মিডফিল্ড এই চাপ ভাঙতে না পারায় সিঙ্গাপুরের খেলা ছিল আরও ধারালো। এতে বাংলাদেশ মাঝমাঠ থেকে আক্রমণ গড়ে তুলতেও ব্যর্থ হয়। বেশিরভাগ সময় তারা ডিফেন্সে ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টাতেই ব্যস্ত ছিল।
অপেক্ষাকৃত নতুন খেলোয়াড়দের বাস্তবায়ন ঘাটতি
বাংলাদেশ এই ম্যাচে পাঁচজন বিদেশে বড় হওয়া বা খেলা ফুটবলারকে শুরুর একাদশে রেখেছিল। যদিও এরা প্রত্যেকে ব্যক্তিগতভাবে প্রতিভাবান, তবে দলগতভাবে তাদের মাঝে বোঝাপড়ার অভাব ছিল স্পষ্ট।
হামজা চৌধুরী, শমিত সোম ও তারিক কাজি বেশ কিছু ভালো মুভমেন্ট তৈরি করলেও নিজেদের পজিশনিং বা ট্যাকটিক্যাল শৃঙ্খলায় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না। আক্রমণ ও রক্ষণ উভয় ক্ষেত্রেই তারা অনেক সময় বিচ্ছিন্নভাবে খেলেছেন।
কোচিং কৌশলে রক্ষণাত্মক ঝুঁকি
স্প্যানিশ কোচ জাভিয়ের কাব্রেরা দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে কোনো আক্রমণাত্মক বদল না এনে রক্ষণ ধরে রাখার কৌশলে স্থির ছিলেন। এতে ০-১ ব্যবধানে পিছিয়ে পড়ার পরও সিঙ্গাপুরের আক্রমণ প্রবণতা নিয়ন্ত্রণে না আসায় দ্বিতীয় গোল হজম করে বসে দলটি।
আক্রমণে পরিবর্তনের সিদ্ধান্তও আসে দেরিতে, যা ম্যাচে গতি আনতে পারেনি। বিপরীতে, সিঙ্গাপুর সঠিক সময়ে খেলোয়াড় বদলে মধ্যমাঠে নিয়ন্ত্রণ টিকিয়ে রাখে।
গোলের সুযোগ নষ্ট এবং সমাপ্তিতে দুর্বলতা
বাংলাদেশ পুরো ম্যাচে অন্তত তিনটি সম্ভাবনাময় সুযোগ পেয়েছিল। এর মধ্যে ২৮ মিনিটে রাকিব হোসেনের লক্ষ্যভ্রষ্ট শট এবং শেষ মুহূর্তে তারিক কাজির দুর্ভাগ্যজনক হেড ক্রসবারে লেগে বাইরে চলে যাওয়া—দুটি বড় সুযোগ ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারত।
বাংলাদেশ বারবার বক্সের ভেতর ঢুকতে পারলেও শেষ শটে লক্ষ্যভেদ করতে পারেনি। ফিনিশিং দক্ষতার ঘাটতি আবারও চোখে পড়েছে, যা এই পর্যায়ের আন্তর্জাতিক ম্যাচে ক্ষমার অযোগ্য।
আত্মবিশ্বাস ছিল, বাস্তবায়ন ছিল না
ভুটানের বিপক্ষে জয় দিয়ে আত্মবিশ্বাসী হয়ে মাঠে নেমেছিল বাংলাদেশ। দর্শকদের উন্মাদনা, স্টেডিয়ামের পরিবেশ—সবই ছিল অনুকূলে। কিন্তু ম্যাচের কৌশলগত ভুল, নতুন খেলোয়াড়দের মাঝে বোঝাপড়ার ঘাটতি এবং কোচিংয়ের রক্ষণাত্মক মনোভাব মিলিয়ে দলটি পরাজয়ের পথেই ছিল শুরু থেকেই।
৯ অক্টোবর হংকংয়ের বিপক্ষে ম্যাচের আগে এই ভুলগুলো বিশ্লেষণ করে দ্রুত প্রতিকারের ব্যবস্থা না নিলে বাছাইপর্ব থেকে ছিটকে পড়ার ঝুঁকি বাড়ছে বাংলাদেশের জন্য।