০২:৩১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

গুজরাটিরা কেন গুরুত্বপূর্ণ

উনবিংশ ও বিংশ শতকের ভারত-পাকিস্তান ইতিহাসকে বদলে-দেওয়া মহাত্মা গান্ধী, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও সরদার বল্লভভাই প্যাটেল—তিনজনই গুজরাটি। আজকের ভারতেও শীর্ষস্রোতে আছেন চার জন প্রভাবশালী গুজরাটি: প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিজেপির প্রধান কৌশলী অমিত শাহ, আর্থিক সাম্রাজ্যের কর্ণধার মুকেশ অম্বানি ও গৌতম আদানি। ২০১৪-তে দিল্লি জয়ের সময় মোদি আদানির ব্যক্তিগত জেটেই উড়েছিলেন—ঘনিষ্ঠতার ইঙ্গিত স্পষ্ট।

ব্যবসা-কেন্দ্রিক পরিচিতি

ঐতিহাসিকভাবে গুজরাটিদের পরিচয় ব্যবসায়ী-সমাজ হিসেবে—মুম্বাইয়ের শেয়ারবাজার থেকে পূর্ব আফ্রিকার কনগ্লোমারেট, ইউরোপ-আমেরিকার হীরার ব্যবসা পর্যন্ত ছড়ানো তাদের দখল। বিদেশে গুজরাটি দোকানপাটের আধিক্য নিয়ে ব্রিটেনে তো রসিকতা চলে—‘শপকিপারদের জাতি’ বলে।

সংস্কৃতিখাদ্যাভ্যাস ও সাম্প্রদায়িক স্মৃতি

গুজরাটিকে অনেকে মনে করেন নিরামিষভোজী ও মদবিরোধী; ২০০২-এর গোধরা-পরবর্তী দাঙ্গায় প্রায় এক হাজার—অধিকাংশই মুসলিম—নিহত হওয়ার ঘটনাও মনে পড়ে। আসলে দাঙ্গার ইতিহাস ঊনবিংশ শতকের শেষ দিক থেকে চলছে, আর সরকারিভাবে মদ নিষিদ্ধ হলেও অবৈধভাবে বিক্রি ও ভোজন উভয়ই চলে। সাম্প্রদায়িক বৈরিতা ও কঠোর খাদ্যনীতি আজ শহরগুলোর পাড়া-মহল্লায়ও প্রভাব ফেলছে।

দ্য গুজরাটিস’: সালিল ত্রিপাঠীর বিস্তৃত পর্যালোচনা

নিউইয়র্কপ্রবাসী লেখক সালিল ত্রিপাঠী নতুন বই ‘দ্য গুজরাটিস’-এ ভাষা-ভিত্তিক পরিচয়ের ওপর জোর দিয়েছেন—গুজরাটি ভাষা মানেই নিছক নিরামিষ কিংবা হিন্দু ধর্ম নয়; এর ভেতরেই জৈন, পারসি, দলিত, আদিবাসী আর নানা মুসলিম উপ-মান্যতা রয়েছে। হিন্দি, উর্দু, ইংরেজি, ফার্সি ও আরবি—প্রাচীন বাণিজ্য-সংযোগ থেকে ভাষায় ঢুকে পড়া ধারক বা ‘লোান ওয়ার্ড’ গুজরাটের কসমোপলিটান অতীতের প্রমাণ।

বাণিজ্যের উদারতা থেকে আঞ্চলিক বদ্ধতায়

অপ্রযুক্ত জমি ও খরাপ্রবণ আবহাওয়া শাসকদের বাণিজ্যকে উৎসাহিত করেছিল, ফলে সবাইকে নিয়ে ‘কারবার’ করার প্রবণতা গড়ে ওঠে। কিন্তু সাম্প্রতিক দশকে সেই উদারতা কমেছে—আহমেদাবাদ এখন ভারতের সবচেয়ে ধর্মভিত্তিক বিভাজিত শহর; নিরামিষ রেস্তোরাঁ মালিকরা গোশতের ডেলিভারি বন্ধ করতে ডেলিভারি-বয়ের পিছু নেন; ১৯৮৯-এর পর থেকে ১০ শতাংশ মুসলিম জনসংখ্যা সত্ত্বেও পার্লামেন্টে কোনো মুসলিম গুজরাটি নেই।

মোদির গুজরাট মডেল’: সাফল্য ও সীমাবদ্ধতা

২০১৪-র নির্বাচনী প্রচারে মোদি স্লোগান দিয়েছিলেন—“সারা ভারতকে গুজরাট বানাব”। প্রায় ১৩ বছর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় তিনি দ্রুত অবকাঠামোগত অগ্রগতি, ব্যবসায় সহজতা ও উচ্চ প্রবৃদ্ধির ব্র্যান্ড তৈরি করেন। দিল্লিতেও তিনি রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ ও ডিজিটাল পরিসেবায় উন্নয়ন ঘটিয়েছেন; তবে ব্যবসা শুরু করা এখনো কঠিন, শাসনব্যবস্থার সংস্কার পিছিয়েছে। সমালোচকেরা বলছেন—ভারত গুজরাটের মতোই ধর্মীয় বিভাজন, সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও খাদ্যপ্রীতির ‘দখলদারি’তে এখন বেশি মিল খুঁজে পায়।

প্রতিশ্রুতির পূরণকিন্তু কোন পথে?

নরেন্দ্র মোদি যতটা না অর্থনৈতিক উদারতার গল্প শোনান, বাস্তবচিত্র সেখানে সাম্প্রদায়িক দূরত্ব আর সাংস্কতিক সংকীর্ণতার বিস্তার। সাহসী বাণিজ্যমনস্ক অতীত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গুজরাট যেমন ‘একপক্ষীয়’ হয়ে উঠছে, তেমনি ভারতও উল্টো পথে হাঁটছে—নান্দনিক বৈচিত্র্যের বদলে রাজনৈতিক হতে থাকা একরঙা সংস্কৃতির দিকে। মোদির প্রতিশ্রুতি তাই আংশিক পূরণ—গুজরাটি দাপট অব্যাহত, কিন্তু মূল্য দিতে হচ্ছে দেশের বহুত্ববাদী চেতনাকে।

 

গুজরাটিরা কেন গুরুত্বপূর্ণ

১০:০০:৫০ অপরাহ্ন, বুধবার, ১১ জুন ২০২৫

উনবিংশ ও বিংশ শতকের ভারত-পাকিস্তান ইতিহাসকে বদলে-দেওয়া মহাত্মা গান্ধী, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও সরদার বল্লভভাই প্যাটেল—তিনজনই গুজরাটি। আজকের ভারতেও শীর্ষস্রোতে আছেন চার জন প্রভাবশালী গুজরাটি: প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিজেপির প্রধান কৌশলী অমিত শাহ, আর্থিক সাম্রাজ্যের কর্ণধার মুকেশ অম্বানি ও গৌতম আদানি। ২০১৪-তে দিল্লি জয়ের সময় মোদি আদানির ব্যক্তিগত জেটেই উড়েছিলেন—ঘনিষ্ঠতার ইঙ্গিত স্পষ্ট।

ব্যবসা-কেন্দ্রিক পরিচিতি

ঐতিহাসিকভাবে গুজরাটিদের পরিচয় ব্যবসায়ী-সমাজ হিসেবে—মুম্বাইয়ের শেয়ারবাজার থেকে পূর্ব আফ্রিকার কনগ্লোমারেট, ইউরোপ-আমেরিকার হীরার ব্যবসা পর্যন্ত ছড়ানো তাদের দখল। বিদেশে গুজরাটি দোকানপাটের আধিক্য নিয়ে ব্রিটেনে তো রসিকতা চলে—‘শপকিপারদের জাতি’ বলে।

সংস্কৃতিখাদ্যাভ্যাস ও সাম্প্রদায়িক স্মৃতি

গুজরাটিকে অনেকে মনে করেন নিরামিষভোজী ও মদবিরোধী; ২০০২-এর গোধরা-পরবর্তী দাঙ্গায় প্রায় এক হাজার—অধিকাংশই মুসলিম—নিহত হওয়ার ঘটনাও মনে পড়ে। আসলে দাঙ্গার ইতিহাস ঊনবিংশ শতকের শেষ দিক থেকে চলছে, আর সরকারিভাবে মদ নিষিদ্ধ হলেও অবৈধভাবে বিক্রি ও ভোজন উভয়ই চলে। সাম্প্রদায়িক বৈরিতা ও কঠোর খাদ্যনীতি আজ শহরগুলোর পাড়া-মহল্লায়ও প্রভাব ফেলছে।

দ্য গুজরাটিস’: সালিল ত্রিপাঠীর বিস্তৃত পর্যালোচনা

নিউইয়র্কপ্রবাসী লেখক সালিল ত্রিপাঠী নতুন বই ‘দ্য গুজরাটিস’-এ ভাষা-ভিত্তিক পরিচয়ের ওপর জোর দিয়েছেন—গুজরাটি ভাষা মানেই নিছক নিরামিষ কিংবা হিন্দু ধর্ম নয়; এর ভেতরেই জৈন, পারসি, দলিত, আদিবাসী আর নানা মুসলিম উপ-মান্যতা রয়েছে। হিন্দি, উর্দু, ইংরেজি, ফার্সি ও আরবি—প্রাচীন বাণিজ্য-সংযোগ থেকে ভাষায় ঢুকে পড়া ধারক বা ‘লোান ওয়ার্ড’ গুজরাটের কসমোপলিটান অতীতের প্রমাণ।

বাণিজ্যের উদারতা থেকে আঞ্চলিক বদ্ধতায়

অপ্রযুক্ত জমি ও খরাপ্রবণ আবহাওয়া শাসকদের বাণিজ্যকে উৎসাহিত করেছিল, ফলে সবাইকে নিয়ে ‘কারবার’ করার প্রবণতা গড়ে ওঠে। কিন্তু সাম্প্রতিক দশকে সেই উদারতা কমেছে—আহমেদাবাদ এখন ভারতের সবচেয়ে ধর্মভিত্তিক বিভাজিত শহর; নিরামিষ রেস্তোরাঁ মালিকরা গোশতের ডেলিভারি বন্ধ করতে ডেলিভারি-বয়ের পিছু নেন; ১৯৮৯-এর পর থেকে ১০ শতাংশ মুসলিম জনসংখ্যা সত্ত্বেও পার্লামেন্টে কোনো মুসলিম গুজরাটি নেই।

মোদির গুজরাট মডেল’: সাফল্য ও সীমাবদ্ধতা

২০১৪-র নির্বাচনী প্রচারে মোদি স্লোগান দিয়েছিলেন—“সারা ভারতকে গুজরাট বানাব”। প্রায় ১৩ বছর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় তিনি দ্রুত অবকাঠামোগত অগ্রগতি, ব্যবসায় সহজতা ও উচ্চ প্রবৃদ্ধির ব্র্যান্ড তৈরি করেন। দিল্লিতেও তিনি রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ ও ডিজিটাল পরিসেবায় উন্নয়ন ঘটিয়েছেন; তবে ব্যবসা শুরু করা এখনো কঠিন, শাসনব্যবস্থার সংস্কার পিছিয়েছে। সমালোচকেরা বলছেন—ভারত গুজরাটের মতোই ধর্মীয় বিভাজন, সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও খাদ্যপ্রীতির ‘দখলদারি’তে এখন বেশি মিল খুঁজে পায়।

প্রতিশ্রুতির পূরণকিন্তু কোন পথে?

নরেন্দ্র মোদি যতটা না অর্থনৈতিক উদারতার গল্প শোনান, বাস্তবচিত্র সেখানে সাম্প্রদায়িক দূরত্ব আর সাংস্কতিক সংকীর্ণতার বিস্তার। সাহসী বাণিজ্যমনস্ক অতীত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গুজরাট যেমন ‘একপক্ষীয়’ হয়ে উঠছে, তেমনি ভারতও উল্টো পথে হাঁটছে—নান্দনিক বৈচিত্র্যের বদলে রাজনৈতিক হতে থাকা একরঙা সংস্কৃতির দিকে। মোদির প্রতিশ্রুতি তাই আংশিক পূরণ—গুজরাটি দাপট অব্যাহত, কিন্তু মূল্য দিতে হচ্ছে দেশের বহুত্ববাদী চেতনাকে।