ঢাকা, ১১ জুন ২০২৫—বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ ও ‘ম্যাক্রো–পভার্টি আউটলুক’–এর পূর্বাভাস জানাচ্ছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছর শেষ হলে বাংলাদেশের প্রকৃত জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩.৩ শতাংশে থেমে যাবে। দুই দশকের মধ্যে এটিই হবে সর্বনিম্ন হার, কারণ ২০২৩-২৪-এ প্রবৃদ্ধি ইতিমধ্যে ৪.২ শতাংশে নেমে গিয়েছিল, আর তার আগের বছর অর্থনীতির দৌড় ছিল পাঁচের বেশিই।
প্রবৃদ্ধির গতি কমল কেন?
বিশ্বব্যাংকের বিশ্লেষণ বলছে, মূলত বেসরকারি ও সরকারি—দু’ধরনের বিনিয়োগই একসঙ্গে স্তিমিত হয়ে গেছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও ঋণ সুদের উচ্চহার উদ্যোক্তাদের ঝুঁকি নেওয়ার সাহস কমিয়ে দিয়েছে; একই সঙ্গে ডলার সঙ্কটে আমদানি ব্যয় বেড়ে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকার রাজস্ব ঘাটতি পুষিয়ে নিতে অবকাঠামোর মতো বড় প্রকল্পে কাটছাঁট করেছে, ফলে নির্মাণ–সম্পৃক্ত শিল্পগুলোও ঝিমিয়ে পড়েছে। এসবের মিলিত প্রভাব রপ্তানি খাতে পড়েছে সবচেয়ে বেশি: বৈশ্বিক চাহিদা কমে যাওয়ার পাশাপাশি কাঁচামালের দামে টানাপোড়েনে তৈরি পোশাক রপ্তানি প্রত্যাশিত আয়ের ধারে–কাছেও যেতে পারেনি।
অর্থনৈতিক সামগ্রিক চিত্র
মূল প্রবৃদ্ধি শ্লথ হওয়া ছাড়াও যে সমস্যা আরও ভয়াবহ হয়ে উঠছে, সেটি হলো মূল্যস্ফীতি। বিশ্বব্যাংকের হিসাব, বারো-মাসের গড় মূল্যস্ফীতি চলতি অর্থবছর জোড়াতালির ১০ শতাংশ ছুঁতে পারে—যা নিম্ন আয়ের মানুষকে সবচেয়ে বেশি আঘাত করে। মুদ্রাস্ফীতির টান বাংলাদেশ ব্যাংককে রিজার্ভ ধরে রাখতে বাধ্য করছে, আবার রিজার্ভের চাপ সামলাতে ডলারের বাজার আরো কৃপণ হয়ে উঠছে। এই ‘দুষ্টচক্র’ বিনিয়োগ ও ভোক্তা ব্যয় দুটোকেই ঠান্ডা করে রাখছে।
পাশাপাশি, বিশ্বব্যাংকের ‘ম্যাক্রো–পভার্টি আউটলুক’ সতর্ক বার্তা দিয়েছে যে চরম দারিদ্র্যের হার ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৯.৩ শতাংশে পৌঁছাতে পারে, যেখানে গেল অর্থবছরে সেটি ছিল ৭.৭ শতাংশ। অর্থাৎ এক লাফে আরও প্রায় ৩০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাওয়ার ঝুঁকিতে।
সংস্কার–পরামর্শ ও সম্ভাব্য উল্লম্ফন
বিশ্বব্যাংকের শীর্ষ সুপারিশের কেন্দ্রে আছে রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানো, যা বর্তমানে জিডিপির আট শতাংশের নিচে—দক্ষিণ এশিয়ার সর্বনিম্ন। সংস্থাটি ভ্যাট-সংস্কার, ডিজিটাল কর-রিটার্ন ও কর-জালের বিস্তার উল্লেখ করে বলেছে, দুই বছরের মধ্যে এই অনুপাত দ্বিগুণ করা গেলে স্থায়ীভাবে বিনিয়োগে আস্থা ফিরবে। একই সঙ্গে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ কমাতে স্বচ্ছ প্রবিধান আর কড়া তদারকি জরুরি বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
রপ্তানি বহুমুখীকরণকে ভবিষ্যৎ টেকসই প্রবৃদ্ধির শর্ত হিসেবে দেখছে বিশ্বব্যাংক। আইসিটি-সেবা, ওষুধশিল্প ও কৃষি-প্রক্রিয়াজাত পণ্যকে অগ্রাধিকার দিতে নগদ প্রণোদনা ও দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যাপ্তি বাড়ানোর উপদেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ মাত্র ৩৮ শতাংশ থেকে ৪৮ শতাংশে তুলতে পারলে জিডিপি প্রতিবছর প্রায় এক শতাংশ পয়েন্ট বাড়তে পারে বলে সংস্থাটির অভ্যন্তরীণ গণনা।
মাঝারি মেয়াদের আশাবাদ
চাপের মধ্যে স্বস্তির খবরও আছে। গত এপ্রিলেই বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাংকের মধ্যে ৮৫০ মিলিয়ন ডলারের দুটি চুক্তি হয়েছে—চট্টগ্রামে বে-টার্মিনাল উন্নয়ন ও সামাজিক সুরক্ষা জোরদারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বন্দর-সম্পৃক্ত এই প্রকল্প চালু হলে দেশের কন্টেইনার পরিবহনের ৩৬ শতাংশ আধুনিক চ্যানেলে যাবে, ফলে রপ্তানি-আমদানি খরচ ও সময় উভয়ই কমবে, যা মধ্য-মেয়াদে প্রবৃদ্ধিকে বাড়তি গতি দিতে পারে।
বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, কাঠামোগত সংস্কার দ্রুত বাস্তবায়িত হলে ২০২৫-২৬ অর্থবছর থেকেই প্রবৃদ্ধি পাঁচ শতাংশের ঘরে ফিরতে পারে। তবে সংস্থাটি স্পষ্ট করেছে, রপ্তানির একমুখী নির্ভরতা ভাঙা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও বিনিয়োগ পরিবেশের আস্থা ফেরানো—এই তিন স্তম্ভ একসঙ্গে মজবুত না হলে উচ্চ প্রবৃদ্ধি আবার ঝুলে পড়তে পারে।
অর্থনীতির চাকা ৩.৩ শতাংশে গড়িয়ে যাওয়ার অর্থ শুধু একটি পরিসংখ্যানগত পতন নয়; এটি ইঙ্গিত দেয় দীর্ঘদিনের বিনিয়োগ ঝিমুনি, রপ্তানি-সংকট ও মূল্যস্ফীতির অদম্য চাপের সমষ্টিকে। বিশ্বব্যাংকের ভাষ্য স্পষ্ট—রাজস্ব আদায় ও ব্যাংক খাত সংস্কার, রপ্তানি বহুমুখীকরণ এবং নারীর কর্মসংস্থান বাড়াতে না পারলে প্রবৃদ্ধির নিম্নগতি দীর্ঘায়িত হবে। উদ্যোক্তা-বান্ধব নীতি, স্বচ্ছ আর্থিক তদারকি ও সামাজিক সুরক্ষার বিস্তার—এই ত্রিভুজ ভিত্তি গড়ে তুলতে পারলেই বাংলাদেশ আবার দ্রুততার পথে ফিরতে পারবে, নাহলে ৩.৩-এর এই সতর্ক সংকেতই ভবিষ্যতের দীর্ঘ ছায়া হয়ে দেখা দিতে পারে।