এলপিজি ও এলএনজির ওপর বাড়তে থাকা নির্ভরতা এখন বাংলাদেশের অর্থনীতি ও জীবনযাত্রার প্রতিটি স্তরে গভীর প্রভাব ফেলছে। আমদানি নির্ভরতা, দামের চাপ এবং সরবরাহ সংকট গড়ে তুলছে এক নতুন বাস্তবতা।
রান্নাঘরে ধোঁয়াবিহীন বিপ্লব, কিন্তু সবার নাগালে নয়
বাংলাদেশে রান্নায় এলপিজির ব্যবহার গত এক দশকে দ্রুত বেড়েছে। বর্তমানে প্রায় ৬০ লাখ পরিবার এলপিজি সিলিন্ডার ব্যবহার করছে, যা দেশের মোট গৃহস্থালির ২০ শতাংশ। তবে চড়া দাম সব শ্রেণির মানুষের জন্য এলপিজি ব্যবহার সহজ করে তুলছে না।
১২ কেজির একটি সিলিন্ডারের দাম বর্তমানে ১,১৫০ থেকে ১,২০০ টাকার মধ্যে ওঠানামা করছে। এই ব্যয় ভার বহন করা দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে নিম্নআয়ের মানুষের জন্য। অথচ ধোঁয়াবিহীন রান্নার কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি কমানোর বড় সুযোগ তৈরি হয় এলপিজি ব্যবহারে।
২০৩০ সালের মধ্যে দেশের বার্ষিক এলপিজি চাহিদা ১৫-১৬ মিলিয়ন টনে পৌঁছানোর আশঙ্কা করা হচ্ছে। অথচ বর্তমানে মাত্র ১.৫৮ শতাংশ দেশীয় উৎপাদন থেকে আসে, বাকি পুরোটা আমদানির ওপর নির্ভরশীল। দেশের বাজারে ৫৮টি লাইসেন্সপ্রাপ্ত কোম্পানির মধ্যে ২৮টি সক্রিয়ভাবে এলপিজি সরবরাহ করছে। তাদের মাধ্যমে ৩ হাজার ডিলার ও ৩৮ হাজার খুচরা বিক্রেতা সারা দেশে সিলিন্ডার পৌঁছে দিচ্ছে।
শিল্প কারখানায় উৎপাদন কমার ভয়াবহ চিত্র
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ইঞ্জিন হিসেবে পরিচিত শিল্প খাতে গ্যাস সরবরাহ সংকট এখন বড় মাথাব্যথা হয়ে উঠেছে। দেশের মোট প্রাকৃতিক গ্যাসের ৩৮ শতাংশ ব্যবহার হয় শিল্প ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে। কিন্তু সরবরাহ ঘাটতি শিল্পের উৎপাদন ব্যাহত করছে।
ইলেকট্রনিক্স, সিমেন্ট, সিরামিক, কাঁচ, স্টিল — এসব খাতে উৎপাদন কমেছে ২০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত। অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান বাধ্য হয়ে ডিজেলচালিত জেনারেটরে উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছে, যার ফলে উৎপাদন খরচ ৩ থেকে ৪ গুণ বেড়ে গেছে।
এদিকে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (BERC) শিল্পে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন শিল্পপ্রতি গ্যাসের ট্যারিফ প্রতি ঘনমিটার ৪০ থেকে ৪২ টাকা। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় দেশের শিল্প ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে।
কৃষি ও পরিবহনেও সংকটের ছায়া
গ্যাস সংকটের ধাক্কা এসে লেগেছে কৃষিখাতেও। কৃষকেরা আগে সেচপাম্প চালাতে গ্যাস ব্যবহার করলেও এখন ডিজেলের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হচ্ছেন। ডিজেলের উচ্চমূল্যের কারণে সেচ খরচ বেড়ে ফসল উৎপাদনের ব্যয়ও বাড়ছে। ফলে কৃষিপণ্যের বাজারমূল্যে এর প্রভাব পড়ছে সরাসরি।
অন্যদিকে সিএনজি সরবরাহ ঘাটতির ফলে পরিবহন খাতেও নেমে এসেছে বাড়তি চাপ। অনেক গাড়ি মালিক দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ানোর বিড়ম্বনা এড়িয়ে পেট্রোল-ডিজেলে ফিরছেন। এতে করে পরিবহন ব্যয় বেড়ে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ছে।
দেশীয় উৎপাদন হ্রাসে আমদানির ওপর নির্ভরতা আরও বাড়ছে
দেশে গ্যাস উৎপাদন ক্রমেই কমছে। ২০২৪ সালের জুনে দৈনিক গ্যাস উৎপাদন নেমে এসেছে ২১,০৭৫ মিলিয়ন ঘনফুটে। এর ফলে চাহিদা-সরবরাহের ব্যবধান দাঁড়িয়েছে ৬,৪৭৯ মিলিয়ন ঘনফুটে।
এই ঘাটতি মেটাতে এলএনজি আমদানির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ২০২০ সালে আমদানিকৃত এলএনজির অংশ ছিল ৭.৩ শতাংশ; যা ২০২৫ সালের শুরুতে বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৫ শতাংশে। তবে বাড়ছে আমদানির অর্থনৈতিক চাপও।
সরকার ইতোমধ্যে উপকূলীয় দুটি এলপিজি বটলিং প্ল্যান্ট নির্মাণ করছে। এগুলো চালু হলে বছরে অতিরিক্ত ১ লাখ টন এলপিজি বটলিং সম্ভব হবে।
স্থায়ী সমাধানে যা করতে হবে
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সংকট থেকে উত্তরণের জন্য এখনই দীর্ঘমেয়াদি ও স্থিতিশীল পদক্ষেপ গ্রহণ অপরিহার্য। তাদের পরামর্শ:
দেশীয় এলপিজি উৎপাদন ও বটলিং অবকাঠামো দ্রুত বাড়ানো।
আমদানি খরচ কমিয়ে খুচরা পর্যায়ে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা।
দরিদ্র ও গ্রামীণ জনগণের জন্য এলপিজি-তে ভর্তুকি বৃদ্ধি।
শিল্প ও কৃষিতে সৌরশক্তি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানো।
নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান ও সমুদ্রবক্ষে খনন কার্যক্রম জোরদার করা।
সংকটের ভিতরেই লুকিয়ে সম্ভাবনা
বাংলাদেশের তরল গ্যাস খাত আজ সংকটে পড়লেও সঠিক নীতিগত সিদ্ধান্ত নিলে এই সংকটই ভবিষ্যতের সম্ভাবনার দুয়ার খুলতে পারে। সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিলে শিল্প, কৃষি ও সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় আবারও স্বস্তি ফিরে আসতে পারে।