চেন্নাইয়ের শিক্ষক অর্জ্য পলের দুর্বিষহ দুশ্চিন্তা
মাত্র কয়েক মাস আগেও অর্জ্য পলের জীবন ছিল স্থিতিশীল। এক কৃষক পরিবারের সন্তান হিসেবে কঠোর পরিশ্রম করে তিনি পশ্চিমবঙ্গের একটি সরকারি স্কুলে শিক্ষকতার সুযোগ পান — যা বহু ভারতীয় তরুণ-তরুণীর আজীবন স্বপ্ন।
কিন্তু ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট তার চাকরি বাতিলের নির্দেশ দেয়। ২০১৬ সালের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় দুর্নীতির অভিযোগে প্রমাণিত হয় যে, কিছু প্রার্থী ঘুষ দিয়ে নিজেদের নম্বর বাড়িয়েছিল। এর ফলে অর্জ্য পালসহ প্রায় ২৬,০০০ শিক্ষককে নতুন করে পরীক্ষা দিয়ে চাকরি রক্ষার শর্ত দেওয়া হয়েছে।
বাড়ি নির্মাণ ও গাড়ি কেনার জন্য ঋণ নেওয়া পল এখন চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে। তিনি বলেন, “এই পরীক্ষা পাস না করলে কীভাবে সংসার চালাবো বুঝতে পারছি না। বেসরকারি স্কুলে আবেদন করতে পারি, কিন্তু সেখানে বেতন বর্তমান আয়ের অর্ধেকও হবে না।”
সরকারি চাকরির প্রতি ভারতের তরুণদের আকর্ষণ
এই ঘটনায় উঠে এসেছে ভারতের তরুণদের মধ্যে সরকারি চাকরির জন্য ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতার চিত্র। কারণ সরকারি চাকরি মানেই অনেকের কাছে আজীবন নিরাপত্তা ও সম্মানজনক জীবনযাপন। কর্পোরেট চাকরি অনেকাংশেই সীমিত ও দুর্লভ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকারের জন্য এটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে — বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশে কি পর্যাপ্ত পরিমাণে ভাল বেতনের চাকরি তৈরি করা সম্ভব?
বেকারত্বের প্রকৃত চিত্র
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরির জন্য ২২ কোটি আবেদন জমা পড়ে। এর মধ্যে চাকরির সুযোগ পান মাত্র ০.৫ শতাংশ। ২০২৪ সালে প্রায় ১০ লাখ মানুষ কঠিন সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার জন্য আবেদন করেন, যেখানে মাত্র ১,০০০ জন নির্বাচিত হন।
২০২৫ সালের এপ্রিলে ভারতের বেকারত্বের হার ছিল ৫.১%, যা জি-২০ ভুক্ত দেশগুলোর গড় ৪.৮% অপেক্ষা কিছুটা বেশি।
আত্মকর্মসংস্থান বাড়ছে, কিন্তু আয়ের গুণমান কমছে
ভারতে কর্মসংস্থানের সংখ্যা ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত পাঁচ বছরে ৩০% বেড়ে ৬৪ কোটি ৩০ লাখে পৌঁছেছে। কিন্তু নিয়মিত বেতনের চাকরি ২৪% থেকে কমে ২২%-এ নেমে এসেছে। বিপরীতে আত্মকর্মসংস্থান বেড়ে ৫২% থেকে ৫৮%-এ দাঁড়িয়েছে। তুলনায় আমেরিকা ও জাপানে আত্মকর্মসংস্থানের হার মাত্র ১০%।
আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক অমিত বসোলের মতে, “অনেকেই বাধ্য হয়ে ছোট দোকান, চায়ের স্টল, ক্যাব চালানো বা ডেলিভারি ম্যান হয়ে আত্মকর্মসংস্থানে জড়াচ্ছে। প্রকৃত উদ্যোক্তা খুব কমই।”
আত্মকর্মসংস্থানে গড় আয় মাসে ১৫৬ ডলার, যা বেতনের চাকরির তুলনায় প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কম। ফলে ব্যক্তিগত খরচ কমে যাচ্ছে যা ভারতের ভোক্তা নির্ভর অর্থনীতির জন্য বড় বিপদ।
সরকারি চাকরির সংখ্যা কমছে
২০১৫ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারীর সংখ্যা ৫% কমে দাঁড়ায় ৩০ লাখে। ২০২৪ সালে তা আবার ৩৩ লাখে ওঠে। কিন্তু সামগ্রিক শ্রমশক্তি যেখানে আগামী ১০ বছরে ১০০ কোটিতে পৌঁছাবে, সেখানে এই সংখ্যা অতি নগণ্য। একই সময়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে চাকরি কমেছে ৩৭%।
বেসরকারি খাতেও মেঘ
করোনার পর হালকা বৃদ্ধি পেলেও সাম্প্রতিক মন্দার ধাক্কায় বেসরকারি খাতে নিয়োগ কমে গেছে। ২০২৪ অর্থবছরে ভারতের শীর্ষ ৫০ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে স্থায়ী কর্মী কমেছে ০.৮%। এর আগে ২০২২ সালে এই বৃদ্ধির হার ছিল ২১.৬%। অর্থনীতিবিদ ধীরজ নিম বলেন, “২০২৫ বা ২০২৬ অর্থবছরেও পরিস্থিতি ভালো হবে বলে মনে হয় না। আয় ও রাজস্বের পূর্বাভাসও আশাব্যঞ্জক নয়।”
কঠিন বাস্তবতায় সিভিল সার্ভিসের আকর্ষণ বাড়ছে
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার মতে, ২০০০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ভারতের স্নাতকদের বেকারত্ব ২৫% থেকে বেড়ে ২৯%-এ পৌঁছেছে। ফলে বিভিন্ন বিষয়ের ছাত্ররা সরকারি চাকরির দিকে ঝুঁকছেন।
চেন্নাইয়ের আননা নগরে অবস্থিত অফিসার্স আইএএস একাডেমিতে এমন ১৩০ জন ছাত্রকে একসঙ্গে ক্লাস করতে দেখা যায়। একাডেমির পরিচালক ইসরায়েল জেবাসিংহ নিজেই ২০০৯ সালে প্রশাসনিক চাকরি ছেড়ে এই কোচিং সেন্টার চালু করেন।
তিনি বলেন, “সিলেবাস অনেক বড়, সবাইকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে।” প্রশাসনিক চাকরিতে প্রবেশের জন্য তিন ধাপের কঠিন পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় — দুটি লিখিত পরীক্ষা ও একটি সাক্ষাৎকার।
এক স্বপ্নের নাম প্রশাসনিক কর্মকর্তা
তরুণ প্রকৌশলী মাদেশ সোলোমন ছোটবেলা থেকে সিভিল সার্ভিসে যেতে চান। প্রিয় অভিনেতা অর্জুন স্বামীর ‘থলাপথি’ সিনেমার সরকারি কর্মকর্তা চরিত্র তাকে অনুপ্রাণিত করে। এছাড়া মুসৌরির লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ন্যাশনাল একাডেমির ক্যাম্পাস দেখে তিনি মুগ্ধ হন।
তিনি বলেন, “প্ল্যান বি নেই। আমাকে এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতেই হবে।”
কিন্তু যারা বারবার চেষ্টা করেও সফল হতে পারে না, তাদের সামনে ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। ছয়বার চেষ্টা করার সুযোগ থাকলেও বয়সসীমা ৩২ বছর। অনেকেই তখন বেসরকারি চাকরিতে ফিরতে গিয়ে দেখেন, সহপাঠীরা অনেক দূর এগিয়ে গেছে।
প্রাক্তন পরীক্ষার্থী তনু বলেন, “তিন বছর চেষ্টা করেছি, শেষে ক্লান্ত হয়ে আগের চাকরিতে ফিরে গেছি। কিন্তু ক্যারিয়ারের গুরুত্বপূর্ণ কয়েক বছর নষ্ট হয়ে গেছে।”
পশ্চিমবঙ্গে আবার নতুন পরীক্ষা নিয়ে আতঙ্কে অর্জ্য পাল
২০১৬ সালে যেখানে ২২ লাখ পরীক্ষার্থীর সঙ্গে লড়াই করেছিলেন অর্জ্য পাল, এবার সেই প্রতিযোগিতা আরও তীব্র হবে বলে মনে করছেন তিনি।
তিনি বলেন, “এবার শুধু আমাদের ব্যাচটি নয়, আরও অনেক নতুন পরীক্ষার্থীও আসবে। পাস করতে না পারলে অনেকে ভাববে আমিও দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। অথচ আমি বা আমার স্ত্রী কেউই কোনো ঘুষ দিইনি। এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। সম্মান রক্ষার একমাত্র উপায় এটিই।”