০২:২২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

সরকারি বক্তব্যের আড়ালে খেলাপি ঋণ ২ লাখ কোটি বেড়েছে  

সরকার কী বলছেবাস্তব চিত্র কী বলছে

মধ্যমেয়াদি বাজেট ঘোষণার সময় অর্থ মন্ত্রণালয় দাবি করেছে যে “ব্যাংক খাত স্থিতিশীল” এবং সামষ্টিক অর্থনীতি “সঠিক পথে” আছে। কিন্তু মাত্র এক বছরের ব্যবধানে শ্রেণিকৃত (খেলাপি) ঋণ দ্বিগুণ হয়ে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকায় পৌঁছেছে—যা বিতরণকৃত ঋণের প্রায় এক-চতুর্থাংশ (২৪.১৩ শতাংশ)। এর বাইরে ৬৪ হাজার কোটি টাকার অবলোপন ও পুনঃতফসিল-নির্ভর কৌশল বাস্তব চিত্রকে আড়াল করে রেখেছে।

নির্ধারিত সঞ্চিতির ভয়াবহ ঘাটতি

খেলাপি ঋণ বাড়ার সরাসরি অভিঘাত পড়েছে নিরাপত্তা সঞ্চিতিতে (প্রভিশন)। মার্চ শেষ পর্যন্ত প্রভিশনের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা—যা আমানতের সমপরিমাণ অংশকে ঝুঁকির মুখে ফেলেছে। মূলধন পর্যাপ্ততা ইতিমধ্যে বিধিবদ্ধ স্তরের অনেক নিচে নেমে গেছে, বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে।

বিশ্বব্যাংকের সতর্ক উচ্চারণ: আসল খেলাপি ৩০ শতাংশের বেশি

বিশ্বব্যাংকের সদ্য প্রকাশিত আর্থিক স্থিতি বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ডিসেম্বর ২০২৪-এ ঘোষিত ২০.২ শতাংশ খেলাপি অনুপাতে মূলধন ঘাটতি ক্রমবর্ধমান; বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব মুদ্রানীতি বিবৃতি জানুয়ারিতে স্বীকার করেছে যে ৯০ দিনের নতুন সংজ্ঞা কার্যকর হওয়ায় প্রকৃত হার ৩০ শতাংশেরও উপরে যেতে পারে । একই নথি জানায়, সিস্টেম-ওয়াইড ক্যাপিটাল টু রিস্ক-ওয়েটেড অ্যাসেট রেশিও (সিআরএআর) মাত্র ৬.৯ শতাংশে নেমে গেছে—যা বৈশ্বিক ন্যূনতমের অর্ধেক।

আইএমএফ: দুর্বল ব্যাংক বাঁচাতে দ্রুত পুনর্গঠনের রূপরেখা দরকার

মে ২০২৫–এর আইএমএফ মিশন-সমাপ্তি বিবৃতি ব্যাংক খাতকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ঝুঁকির অন্যতম প্রধান উৎস আখ্যা দিয়ে বলেছে, “দুর্বল ব্যাংকের জন্য সুস্পষ্ট রেজোলিউশন কৌশল ও সব ব্যাংকের সম্পদ-গুণমান পর্যালোচনা (AQR) জরুরি” । আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী, ব্যাংক খাতের দুর্বলতা ও স্বল্প মূলধন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও মুদ্রা স্থিতিশীলতার ঠিকুজি নষ্ট করতে পারে; তাই আইএমএফ দ্রুত আইনগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার চায়।

New Age | Moody's downgrades six banks in Bangladesh after sovereign rating cut

মুডিজ: ব্যাংকিং ব্যবস্থার পূর্বাভাস নেগেটিভএনপিএল আরও বাড়বে

মার্চ ২০২৫–এ প্রকাশিত মুডিজ রিপোর্ট বাংলাদেশ ব্যাংকিং সিস্টেমের আউটলুক ‘নেগেটিভ’ করেছে। তাদের পূর্বাভাস, ধীর অর্থনীতি, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি এবং দুর্বল করপোরেট স্বত্বব্যবস্থার ফলে শ্রেণিকৃত ঋণের অনুপাত ২০২৫ অর্থবছরে আরও বাড়বে, বিশেষ করে ৯০ দিনের নিয়ম কার্যকরের পর । রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর গড় সিআরএআর −২.৫ শতাংশ—অর্থাৎ ঋণের বিপরীতে মূলধনই নেই।

আমদানি ব্যয় ও তরলতার ডাবল হিট

খেলাপি ঋণ ও মূলধন ঘাটতির জোড়া চাপ ব্যাংকগুলোর বিদেশি ক্রেডিট লেটারের (এলসি) সীমা কমিয়েছে। এলসির নিশ্চয়তা ফি ২৫–৩০ বেসিস পয়েন্ট বেড়েছে বলে বাণিজ্যিক আমদানিকারকরা জানান। এর ফলে ভোজ্যতেল থেকে কাঁচা মাল—সব আমদানির খরচই বেড়ে মুদ্রাস্ফীতির ওপর দ্বিতীয় ধাক্কা সৃষ্টি করছে।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের আয় যতটা বেড়েছে, মুনাফা তত বাড়েনি | প্রথম আলো

বিশেষজ্ঞদের মূল্যায়ন

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান মনে করেন, ৩৫ শতাংশের পূর্বাভাসও সংরক্ষণকারী–বিধি লাঘবের ওপর দাঁড়িয়ে; আসল হার সম্ভবত আরও উঁচুতে যাবে। ‘অনিয়ম-দুর্নীতির ঋণগুলো পর্যায়ক্রমে বইয়ে উঠছে, এবার সেগুলো প্রভিশন করতে হবে,’—বলেছেন তিনি।

কী করলে পথ পাওয়া যেতে পারে

প্রস্তাব উদ্দেশ্য
পূর্ণাঙ্গ AQR এবং স্বচ্ছ প্রকাশ প্রকৃত খেলাপি ও মূলধন ঘাটতির মাত্রা নির্ধারণ
‘ব্যাংক রেজোল্যুশন অর্ডিন্যান্স’ দ্রুত কার্যকর দেউলিয়া ব্যাংক নির্বিঘ্নে পুনর্গঠন/দালিলিক অবসান
১০০ শতাংশ প্রভিশন রোডম্যাপ আমানতকারীর অর্থ সুরক্ষা ও মূলধন ফের মজবুত করা
ব্যক্তি পছন্দমুক্ত পরিচালনা পর্ষদ ঋণ বিতরণে স্বজনপ্রীতি রোধ
একক ঋণগ্রহীতা সীমা কঠোর প্রয়োগ গ্রুপ-ভিত্তিক ঋণসংকেন্দ্রতা কমানো

সরকারি বক্তব্যের আড়ালে খেলাপি ঋণ ২ লাখ কোটি বেড়েছে  

০৪:২১:০৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৬ জুন ২০২৫

সরকার কী বলছেবাস্তব চিত্র কী বলছে

মধ্যমেয়াদি বাজেট ঘোষণার সময় অর্থ মন্ত্রণালয় দাবি করেছে যে “ব্যাংক খাত স্থিতিশীল” এবং সামষ্টিক অর্থনীতি “সঠিক পথে” আছে। কিন্তু মাত্র এক বছরের ব্যবধানে শ্রেণিকৃত (খেলাপি) ঋণ দ্বিগুণ হয়ে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকায় পৌঁছেছে—যা বিতরণকৃত ঋণের প্রায় এক-চতুর্থাংশ (২৪.১৩ শতাংশ)। এর বাইরে ৬৪ হাজার কোটি টাকার অবলোপন ও পুনঃতফসিল-নির্ভর কৌশল বাস্তব চিত্রকে আড়াল করে রেখেছে।

নির্ধারিত সঞ্চিতির ভয়াবহ ঘাটতি

খেলাপি ঋণ বাড়ার সরাসরি অভিঘাত পড়েছে নিরাপত্তা সঞ্চিতিতে (প্রভিশন)। মার্চ শেষ পর্যন্ত প্রভিশনের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা—যা আমানতের সমপরিমাণ অংশকে ঝুঁকির মুখে ফেলেছে। মূলধন পর্যাপ্ততা ইতিমধ্যে বিধিবদ্ধ স্তরের অনেক নিচে নেমে গেছে, বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে।

বিশ্বব্যাংকের সতর্ক উচ্চারণ: আসল খেলাপি ৩০ শতাংশের বেশি

বিশ্বব্যাংকের সদ্য প্রকাশিত আর্থিক স্থিতি বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ডিসেম্বর ২০২৪-এ ঘোষিত ২০.২ শতাংশ খেলাপি অনুপাতে মূলধন ঘাটতি ক্রমবর্ধমান; বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব মুদ্রানীতি বিবৃতি জানুয়ারিতে স্বীকার করেছে যে ৯০ দিনের নতুন সংজ্ঞা কার্যকর হওয়ায় প্রকৃত হার ৩০ শতাংশেরও উপরে যেতে পারে । একই নথি জানায়, সিস্টেম-ওয়াইড ক্যাপিটাল টু রিস্ক-ওয়েটেড অ্যাসেট রেশিও (সিআরএআর) মাত্র ৬.৯ শতাংশে নেমে গেছে—যা বৈশ্বিক ন্যূনতমের অর্ধেক।

আইএমএফ: দুর্বল ব্যাংক বাঁচাতে দ্রুত পুনর্গঠনের রূপরেখা দরকার

মে ২০২৫–এর আইএমএফ মিশন-সমাপ্তি বিবৃতি ব্যাংক খাতকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ঝুঁকির অন্যতম প্রধান উৎস আখ্যা দিয়ে বলেছে, “দুর্বল ব্যাংকের জন্য সুস্পষ্ট রেজোলিউশন কৌশল ও সব ব্যাংকের সম্পদ-গুণমান পর্যালোচনা (AQR) জরুরি” । আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী, ব্যাংক খাতের দুর্বলতা ও স্বল্প মূলধন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও মুদ্রা স্থিতিশীলতার ঠিকুজি নষ্ট করতে পারে; তাই আইএমএফ দ্রুত আইনগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার চায়।

New Age | Moody's downgrades six banks in Bangladesh after sovereign rating cut

মুডিজ: ব্যাংকিং ব্যবস্থার পূর্বাভাস নেগেটিভএনপিএল আরও বাড়বে

মার্চ ২০২৫–এ প্রকাশিত মুডিজ রিপোর্ট বাংলাদেশ ব্যাংকিং সিস্টেমের আউটলুক ‘নেগেটিভ’ করেছে। তাদের পূর্বাভাস, ধীর অর্থনীতি, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি এবং দুর্বল করপোরেট স্বত্বব্যবস্থার ফলে শ্রেণিকৃত ঋণের অনুপাত ২০২৫ অর্থবছরে আরও বাড়বে, বিশেষ করে ৯০ দিনের নিয়ম কার্যকরের পর । রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর গড় সিআরএআর −২.৫ শতাংশ—অর্থাৎ ঋণের বিপরীতে মূলধনই নেই।

আমদানি ব্যয় ও তরলতার ডাবল হিট

খেলাপি ঋণ ও মূলধন ঘাটতির জোড়া চাপ ব্যাংকগুলোর বিদেশি ক্রেডিট লেটারের (এলসি) সীমা কমিয়েছে। এলসির নিশ্চয়তা ফি ২৫–৩০ বেসিস পয়েন্ট বেড়েছে বলে বাণিজ্যিক আমদানিকারকরা জানান। এর ফলে ভোজ্যতেল থেকে কাঁচা মাল—সব আমদানির খরচই বেড়ে মুদ্রাস্ফীতির ওপর দ্বিতীয় ধাক্কা সৃষ্টি করছে।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের আয় যতটা বেড়েছে, মুনাফা তত বাড়েনি | প্রথম আলো

বিশেষজ্ঞদের মূল্যায়ন

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান মনে করেন, ৩৫ শতাংশের পূর্বাভাসও সংরক্ষণকারী–বিধি লাঘবের ওপর দাঁড়িয়ে; আসল হার সম্ভবত আরও উঁচুতে যাবে। ‘অনিয়ম-দুর্নীতির ঋণগুলো পর্যায়ক্রমে বইয়ে উঠছে, এবার সেগুলো প্রভিশন করতে হবে,’—বলেছেন তিনি।

কী করলে পথ পাওয়া যেতে পারে

প্রস্তাব উদ্দেশ্য
পূর্ণাঙ্গ AQR এবং স্বচ্ছ প্রকাশ প্রকৃত খেলাপি ও মূলধন ঘাটতির মাত্রা নির্ধারণ
‘ব্যাংক রেজোল্যুশন অর্ডিন্যান্স’ দ্রুত কার্যকর দেউলিয়া ব্যাংক নির্বিঘ্নে পুনর্গঠন/দালিলিক অবসান
১০০ শতাংশ প্রভিশন রোডম্যাপ আমানতকারীর অর্থ সুরক্ষা ও মূলধন ফের মজবুত করা
ব্যক্তি পছন্দমুক্ত পরিচালনা পর্ষদ ঋণ বিতরণে স্বজনপ্রীতি রোধ
একক ঋণগ্রহীতা সীমা কঠোর প্রয়োগ গ্রুপ-ভিত্তিক ঋণসংকেন্দ্রতা কমানো