০২:২৮ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

সরকারের ব্যাংক ঋণঃ ঝুঁকির মুখে বেসরকারি খাত

বাংলাদেশে সরকারের ব্যাংক ঋণ গ্রহণের প্রবণতা নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। ২০২২ সালের জুন থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মাত্র আড়াই বছরে সরকারের ব্যাংক ঋণ বেড়েছে প্রায় ২ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, বর্তমানে সরকারের মোট ঋণের পরিমাণ ১৯ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এই বিপুল ঋণের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে নেওয়া হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের ভাষায়, এটি বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য দ্বিমুখী চাপের জন্ম দিচ্ছে। একদিকে বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার বিপুল ঋণ নিচ্ছে; অন্যদিকে ব্যাংকগুলো বেসরকারি খাতের ঋণ সরবরাহ কমিয়ে দিয়ে ঝুঁকিমুক্ত উচ্চ রিটার্নের সরকারি সিকিউরিটিতে বিনিয়োগ করছে।

সরকারকে বাজার নিয়ন্ত্রণে মাঠে দেখছি না | প্রথম আলো

বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ স্থবির

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরী বলেছেন,
বর্তমানে বেসরকারি খাত নতুন বিনিয়োগ করতে পারছে না। ব্যাংকগুলোর তহবিল সরকারের কাছে চলে যাচ্ছে। অর্থনীতিতে স্থবির অবস্থা তৈরি হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির গতি হোঁচট খাবে।”

বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, ব্যাংক থেকে স্বল্প সুদের কর্মসূচির ঋণ এখন প্রায় অনুপলব্ধ। ফলে নতুন কারখানা, শিল্প, উদ্যোক্তা উদ্যোগ, স্টার্টআপ — সবকিছুতেই ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টির পথ সংকুচিত হচ্ছে।

উচ্চ সুদের ফাঁদে সরকারের খরচ বেড়ে চলেছে

সরকার যেভাবে ক্রমাগত ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে, তার সরাসরি প্রতিফলন পড়ছে সুদের হারে। বর্তমানে দুই বছর থেকে ২০ বছর মেয়াদি সরকারি ট্রেজারি বন্ডের সুদের হার ১২-১৩ শতাংশে পৌঁছেছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে সরকার কেবল স্থানীয় ঋণের সুদ পরিশোধেই ৮১ হাজার ৫৩১ কোটি টাকা ব্যয় করেছে।

১৩ থেকে ২০তম গ্রেডে জনবল নিচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়

বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন,
এই ঋণ যদি উৎপাদনশীল খাতে ব্যবহৃত হতো তাহলে বড় সমস্যা হতো না। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে এগুলো বেশিরভাগই যাচ্ছে পরিচালন ব্যয়ে।”

ঋণের অর্থ কোথায় ব্যয় হচ্ছে?

সরকারের ঋণ ব্যবহারের বড় অংশই বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি), বেতন-ভাতা, ভর্তুকি ও ঋণের সুদ পরিশোধে যাচ্ছে। কিন্তু এই অর্থের বিনিময়ে দেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অবকাঠামো কিংবা মানবসম্পদ উন্নয়নে প্রত্যাশিত অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম এই প্রসঙ্গে বলেন,
অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পশ্বেতহস্তীর প্রকল্প ও রাজনৈতিক জনপ্রিয়তা ধরে রাখার চিন্তায় সরকার বিপুল ঋণ নিয়ে গেছে। এর দায় বাংলাদেশের অর্থনীতি আগামী দশকজুড়ে বহন করবে।”

বেসরকারি খাতে ক্রাউডিং আউট‘ সংকট

বিশ্বব্যাপী অর্থনীতিতে এই পরিস্থিতিকে বলা হয় Crowding Out Effect। অর্থাৎ, সরকারের বেশি ঋণ গ্রহণের ফলে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের অর্থায়নের সুযোগ সংকুচিত হয়।

IMF, World Bank must support developing countries' recovery | The Financial Express

লন্ডনের Capital Economics সম্প্রতি সতর্ক করে বলেছে —
বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরের ৬০% এর বেশি যখন সরকারি খাতে চলে যায়তখন শিল্প-বিনিয়োগপ্রযুক্তি উদ্ভাবনরপ্তানি ও কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি ধ্বংস হতে শুরু করে।”

আন্তর্জাতিক চাপ ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা সংকট

বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি এবং আন্তর্জাতিক রেটিং এজেন্সিগুলো ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের ঋণ ব্যবস্থাপনা নিয়ে সতর্কতা প্রকাশ করেছে। আইএমএফ-এর ঢাকা অফিসের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,
সরকার যদি দ্রুত ব্যয় সংকোচনকর রাজস্ব বৃদ্ধি ও পুঁজিবাজার বিকাশের দিকে না যায়তাহলে অর্থনৈতিক বিপর্যয় এড়ানো কঠিন হবে।”

বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগকারীরাও বাংলাদেশের এই ঋণ প্রবণতা দেখে বিনিয়োগে পিছিয়ে যাচ্ছে, ফলে বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগও (FDI) কমতির দিকে।

সামনে কী আশঙ্কা?

  • ব্যাংকিং খাতের তারল্য সংকট বাড়বে
  • ঋণের সুদবৃদ্ধির ফলে ব্যাংকের মূলধন সংকটে পড়বে
  • ব্যাংক-বহির্ভূত অর্থনৈতিক অপরাধ বাড়তে পারে
  • ডিফল্ট ঋণের পরিমাণ বাড়বে
  • প্রবৃদ্ধি থমকে যাবে, কর্মসংস্থান সংকুচিত হবে

বাজেট ঘাটতি ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা

কীভাবে বেরিয়ে আসা সম্ভব?

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এখনই সরকারকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে:

বাজেট ঘাটতি দ্রুত হ্রাস করা

শ্বেতহস্তী প্রকল্প স্থগিত করা

পুঁজিবাজারকে শক্তিশালী করা

করজাল সম্প্রসারণ করা

ব্যাংক-বহির্ভূত অর্থায়নের উৎস তৈরি করা

বিদেশি উন্নয়ন সহায়তা সঠিকভাবে ব্যবহার করা

বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে এক ভয়ংকর ঋণ-নির্ভর ফাঁদে আটকে পড়েছে। সরকারের ক্রমাগত ব্যাংক ঋণ গ্রহণ বেসরকারি খাতের স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং উদ্যোক্তা সংস্কৃতিকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে হলে জরুরি ভিত্তিতে বাস্তবমুখী অর্থনৈতিক সংস্কার ও পরিকল্পিত ঋণ ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন।

সরকারের ব্যাংক ঋণঃ ঝুঁকির মুখে বেসরকারি খাত

০৩:৪৪:১১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৭ জুন ২০২৫

বাংলাদেশে সরকারের ব্যাংক ঋণ গ্রহণের প্রবণতা নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। ২০২২ সালের জুন থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মাত্র আড়াই বছরে সরকারের ব্যাংক ঋণ বেড়েছে প্রায় ২ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, বর্তমানে সরকারের মোট ঋণের পরিমাণ ১৯ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এই বিপুল ঋণের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে নেওয়া হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের ভাষায়, এটি বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য দ্বিমুখী চাপের জন্ম দিচ্ছে। একদিকে বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার বিপুল ঋণ নিচ্ছে; অন্যদিকে ব্যাংকগুলো বেসরকারি খাতের ঋণ সরবরাহ কমিয়ে দিয়ে ঝুঁকিমুক্ত উচ্চ রিটার্নের সরকারি সিকিউরিটিতে বিনিয়োগ করছে।

সরকারকে বাজার নিয়ন্ত্রণে মাঠে দেখছি না | প্রথম আলো

বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ স্থবির

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরী বলেছেন,
বর্তমানে বেসরকারি খাত নতুন বিনিয়োগ করতে পারছে না। ব্যাংকগুলোর তহবিল সরকারের কাছে চলে যাচ্ছে। অর্থনীতিতে স্থবির অবস্থা তৈরি হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির গতি হোঁচট খাবে।”

বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, ব্যাংক থেকে স্বল্প সুদের কর্মসূচির ঋণ এখন প্রায় অনুপলব্ধ। ফলে নতুন কারখানা, শিল্প, উদ্যোক্তা উদ্যোগ, স্টার্টআপ — সবকিছুতেই ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টির পথ সংকুচিত হচ্ছে।

উচ্চ সুদের ফাঁদে সরকারের খরচ বেড়ে চলেছে

সরকার যেভাবে ক্রমাগত ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে, তার সরাসরি প্রতিফলন পড়ছে সুদের হারে। বর্তমানে দুই বছর থেকে ২০ বছর মেয়াদি সরকারি ট্রেজারি বন্ডের সুদের হার ১২-১৩ শতাংশে পৌঁছেছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে সরকার কেবল স্থানীয় ঋণের সুদ পরিশোধেই ৮১ হাজার ৫৩১ কোটি টাকা ব্যয় করেছে।

১৩ থেকে ২০তম গ্রেডে জনবল নিচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়

বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন,
এই ঋণ যদি উৎপাদনশীল খাতে ব্যবহৃত হতো তাহলে বড় সমস্যা হতো না। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে এগুলো বেশিরভাগই যাচ্ছে পরিচালন ব্যয়ে।”

ঋণের অর্থ কোথায় ব্যয় হচ্ছে?

সরকারের ঋণ ব্যবহারের বড় অংশই বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি), বেতন-ভাতা, ভর্তুকি ও ঋণের সুদ পরিশোধে যাচ্ছে। কিন্তু এই অর্থের বিনিময়ে দেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অবকাঠামো কিংবা মানবসম্পদ উন্নয়নে প্রত্যাশিত অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম এই প্রসঙ্গে বলেন,
অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পশ্বেতহস্তীর প্রকল্প ও রাজনৈতিক জনপ্রিয়তা ধরে রাখার চিন্তায় সরকার বিপুল ঋণ নিয়ে গেছে। এর দায় বাংলাদেশের অর্থনীতি আগামী দশকজুড়ে বহন করবে।”

বেসরকারি খাতে ক্রাউডিং আউট‘ সংকট

বিশ্বব্যাপী অর্থনীতিতে এই পরিস্থিতিকে বলা হয় Crowding Out Effect। অর্থাৎ, সরকারের বেশি ঋণ গ্রহণের ফলে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের অর্থায়নের সুযোগ সংকুচিত হয়।

IMF, World Bank must support developing countries' recovery | The Financial Express

লন্ডনের Capital Economics সম্প্রতি সতর্ক করে বলেছে —
বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরের ৬০% এর বেশি যখন সরকারি খাতে চলে যায়তখন শিল্প-বিনিয়োগপ্রযুক্তি উদ্ভাবনরপ্তানি ও কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি ধ্বংস হতে শুরু করে।”

আন্তর্জাতিক চাপ ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা সংকট

বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি এবং আন্তর্জাতিক রেটিং এজেন্সিগুলো ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের ঋণ ব্যবস্থাপনা নিয়ে সতর্কতা প্রকাশ করেছে। আইএমএফ-এর ঢাকা অফিসের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,
সরকার যদি দ্রুত ব্যয় সংকোচনকর রাজস্ব বৃদ্ধি ও পুঁজিবাজার বিকাশের দিকে না যায়তাহলে অর্থনৈতিক বিপর্যয় এড়ানো কঠিন হবে।”

বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগকারীরাও বাংলাদেশের এই ঋণ প্রবণতা দেখে বিনিয়োগে পিছিয়ে যাচ্ছে, ফলে বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগও (FDI) কমতির দিকে।

সামনে কী আশঙ্কা?

  • ব্যাংকিং খাতের তারল্য সংকট বাড়বে
  • ঋণের সুদবৃদ্ধির ফলে ব্যাংকের মূলধন সংকটে পড়বে
  • ব্যাংক-বহির্ভূত অর্থনৈতিক অপরাধ বাড়তে পারে
  • ডিফল্ট ঋণের পরিমাণ বাড়বে
  • প্রবৃদ্ধি থমকে যাবে, কর্মসংস্থান সংকুচিত হবে

বাজেট ঘাটতি ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা

কীভাবে বেরিয়ে আসা সম্ভব?

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এখনই সরকারকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে:

বাজেট ঘাটতি দ্রুত হ্রাস করা

শ্বেতহস্তী প্রকল্প স্থগিত করা

পুঁজিবাজারকে শক্তিশালী করা

করজাল সম্প্রসারণ করা

ব্যাংক-বহির্ভূত অর্থায়নের উৎস তৈরি করা

বিদেশি উন্নয়ন সহায়তা সঠিকভাবে ব্যবহার করা

বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে এক ভয়ংকর ঋণ-নির্ভর ফাঁদে আটকে পড়েছে। সরকারের ক্রমাগত ব্যাংক ঋণ গ্রহণ বেসরকারি খাতের স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং উদ্যোক্তা সংস্কৃতিকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে হলে জরুরি ভিত্তিতে বাস্তবমুখী অর্থনৈতিক সংস্কার ও পরিকল্পিত ঋণ ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন।