পোকামাকড় ও রোগ-জীবাণুর বহুমুখী চাপ
বাংলাদেশের খাদ্য-স্বয়ংসম্পূর্ণতা ও জনস্বাস্থ্য—দুটিই ক্রমবর্ধমানভাবে পোকামাকড় ও বাহক-মশার হুমকিতে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO)-র সমীক্ষায় দেখা যায়, ২০০৮-১৮ সময়কালে বিশ্বব্যাপী ফসল ও পশু উৎপাদনের প্রায় ৯ শতাংশ নষ্ট হয়েছে নানা জীববৈচিত্র্য-জনিত আক্রমণে; দক্ষিণ এশিয়ায় হারটি আরও বেশি। একই সঙ্গে ২০২৪ সালে ডেঙ্গুতে ১ লাখের বেশি আক্রান্ত ও ৫৭৫টি মৃত্যু বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার ‘হটস্পট’ হিসেবে স্পষ্ট করেছে। এ বছর ডেঙ্গু ব্যাপক আকারে ছড়াচ্ছে দেশের প্রত্যন্ত এলাকায়। এই দুই বাস্তবতা কীটনাশক সরবরাহকে কেবল কৃষকেরই নয়, শহর-গ্রামের প্রতিটি পরিবারের অপরিহার্য চাহিদায় পরিণত করেছে।
বাজেট ২০২৫-২৬: শুল্ক ২৫ থেকে ৫ শতাংশে নামিয়ে কার লাভ?
গত বছরের সংশোধিত শুল্ক কাঠামোয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (NBR) কীটনাশক আমদানির শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নামিয়ে নিয়েছে—পেঁয়াজ ও আলুর বিপরীতে একই ছাড়ের তালিকায় এর উল্লেখ আছে। সদ্য প্রকাশিত কাস্টমস ট্যারিফ বুকেও ৫ শতাংশ ‘বেসিক ডিউটি’ বহাল রয়েছে। নীতিপ্রণেতাদের যুক্তি, দাম কমলে কৃষকের উৎপাদন খরচ কমবে। কিন্তু বাস্তবে শুল্ক-ছাড়ে সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী হয়েছেন আমদানিকারক ও তাঁদের বিদেশি সরবরাহকারী; দেশীয় উৎপাদকদের প্রতিযোগিতা কঠিন হয়েছে।
বাজারের চিত্র: ৩৬০ মিলিয়ন ডলারের ক্রমবর্ধমান চাহিদা
২০২৪ সালে বাংলাদেশি কীটনাশক বাজার ১৩ শতাংশ বেড়ে ৩৬০ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। গবেষণা সংস্থা 6Wresearch-এর পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫-৩১ সময়কালে বার্ষিক চাহিদা বেশি থাকবে। অথচ বাজারের প্রায় তিন-চতুর্থাংশই এখনো আমদানিনির্ভর—যার বেশির ভাগ আসে চীন ও ভারত থেকে; ফলে বৈদেশিক মুদ্রার চাপ বাড়ছে।
দেশে যেসব কারখানা এগিয়ে: সুযোগ ও সীমাবদ্ধতা
দেশে অনেকগুলো কোম্পানি প্রযুক্তিসমৃদ্ধ প্ল্যান্ট গড়ে তুলেছে। একটি বড় কোম্পানির বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে—দেশীয় বাজারের পাশাপাশি শীর্ষস্থানীয় কোম্পানিগুলো আফ্রিকা-মধ্যপ্রাচ্যেও বাজার খুঁজছে। কিন্তু উৎপাদন প্রচলিত ‘টোল-ম্যানুফ্যাকচারিং’-এ সীমিত; কাঁচামাল আমদানিতে উচ্চ জটিলতার পাশাপাশি ‘মাঠ-টেস্ট’ বাধ্যতামূলক হওয়ায় পণ্যে দ্রুত বৈচিত্র্য আনা কঠিন।
খাদ্য নিরাপত্তা ও উৎপাদন বাড়ানোর উপায়
সার ও বালাইনাশক ব্যবহার ছাড়া উচ্চ ফলন ভাবাই যায় না। ২০১০-এর পর বাংলাদেশ ধান-গমের পাশাপাশি ফল, শাক-সবজি ও মসলার বিস্তৃত উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে; তবে কীট-পতঙ্গমুক্তকরণ নিশ্চিত না হলে ফলন থেকে ভোক্তা—দুই পর্যায়েই অপচয় বাড়ে। FAO-র জরিপ দেখায়, এশিয়ায় অনিয়ন্ত্রিত পোকামাকড়ে ফসলহানি গড়ে ২০ শতাংশের কাছাকাছি। স্বাস্থ্যকর, অবশিষ্টাংশ-নিয়ন্ত্রিত (MRL) কীটনাশক দেশেই উৎপাদন করলে মান নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়; রপ্তানি ক্ষেত্রেও ‘ফুড সেফটি সনদ’ পেতে সহায়ক।
জনস্বাস্থ্য ও নগর জীবনে রোধ-ব্যবস্থা
ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়ার মতো রোগ-বাহক মশা নির্মূলে অতিদ্রুত ও কার্যকর লার্ভিসাইড-এয়ারোসলের প্রয়োজন বাড়ছে। ২০২৩-২৪-এর রেকর্ড ডেঙ্গু-মৃত্যুর পর বিশেষজ্ঞরা ‘সারা বছর নজরদারি’র ওপর জোর দিচ্ছেন। নির্ভরযোগ্য উৎপাদক কম থাকায় সিটি করপোরেশনগুলোর সময়মতো সরবরাহ নিশ্চিত হয় না; অনেক ক্ষেত্রেই নিম্নমানের আমদানি-কীটনাশকে মশা মরে না—ফলে জনস্বাস্থ্যে দ্বিগুণ খরচ পড়ে।
আন্তর্জাতিক তুলনা: ভারতীয় ‘মেক-ইন-ইন্ডিয়া’ মডেল
ভারত ২০২৪-২৫ বাজেটে কীটনাশক ফর্মুলেশনের আমদানি শুল্ক ১০ থেকে ১৫ শতাংশে তুলেছে। রপ্তানি-মুখী কৃষি-রসায়ন শিল্প গড়তে সরকার জিএসটি ছাড়, দ্রুত লাইসেন্স ও গবেষণাভর্তুকি দিয়েছে। বাংলাদেশে উল্টো চিত্র—৫ শতাংশ শুল্ক, কঠোর মান-টেস্ট না থাকায় কমদামী পণ্য বাজার প্লাবিত করে; স্থানীয় প্রতিষ্ঠান মূলধন বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হয়।
অর্থনৈতিক সুফল বনাম সম্ভাব্য ক্ষতি
- বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়: প্রয়োজনীয়তার ৫০ শতাংশ দেশেই উৎপাদিত হলে বছরে অন্তত ১৫০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় রক্ষা সম্ভব।
•কর্মসংস্থান: গড়ে প্রতি ১ কোটি টাকার মূলধনে ২৫-৩০টি সরাসরি ও ৫০টি পরোক্ষ কর্মসংস্থান তৈরি হয়—রিয়েল-এস্টেট ফিটিংস শিল্পের মতো সম্ভাবনা নষ্ট না করার সতর্কবার্তা প্রযোজ্য।
• রপ্তানি সম্ভাবনা: ওষুধ খাতে ১১৩টি দেশে পণ্য পাঠানোর অভিজ্ঞতা দেখায়, সঠিক নীতি হলে কীটনাশকও দক্ষিণ-এশিয়া-আফ্রিকায় রপ্তানিযোগ্য।
• স্বাস্থ্য-সামাজিক ঝুঁকি: অবাধ আমদানিতে মানহীন রাসায়নিক ঢুকলে খাদ্য-শৃঙ্খলে অবশিষ্টাংশ, পরিবেশ-দূষণ ও অ্যান্টি-ডাম্পিং ঝুঁকি বাড়ে। নিয়ন্ত্রিত স্থানীয় উৎপাদনে ‘গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস’ (GMP) কার্যকর করা সহজ।
নীতিগত সুপারিশ
- ধীরে ধীরে শুল্ক সমন্বয়: অবিলম্বে ১৫ শতাংশ ‘বেসিক ডিউটি’ ও ৫ শতাংশ রেগুলেটরি কর আরোপ করে স্থানীয় কারখানাকে শ্বাসফেলার সময় দিতে হবে।
- কাঁচামাল উৎস উন্মুক্ত: ওষুধ খাতের মতো বন্দরে নয়—কারখানায় দ্রুত ল্যাব-টেস্ট চালু করে ডেমারেজ কমাতে হবে।
- বায়োপেস্টিসাইড গবেষণা ভর্তুকি: বিশ্ব বাজারে জৈব-কীটনাশকের প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশের বেশি; বাংলাদেশি বিশ্ববিদ্যালয়-কারখানা যৌথ প্রকল্পে উদ্ভাবন ত্বরান্বিত করা দরকার।
- মাঠ-টেস্ট পুনর্বিবেচনা: একই অ্যাগ্রো-ক্লিম্যাটিক জোনে একাধিকবার টেস্ট বাধ্যতামূলক না করে WHO-AQIS-সিদ্ধ ফলাফল গ্রহণযোগ্য করলে পণ্য বাজারে আনতে সময় কমবে।
- বহুমাত্রিক নজরদারি: ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মতো একটি ‘কীটনাশক নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ’ গঠন করে আমদানির প্রতিটি চালানকে MRL ও পরিবেশ-প্রভাব পরীক্ষার আওতায় আনা উচিত।
বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় ও মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধ—এই তিন ক্ষেত্রেই কীটনাশক শিল্পের স্থানীয় বিকাশ অপরিহার্য। কিন্তু চলতি বাজেটে ৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক দেশীয় উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগের পরিবেশ নষ্ট করে আমদানিকারকদের জন্য ‘কমফোর্ট জোন’ তৈরি করেছে। ভারতীয় অভিজ্ঞতা দেখায়, উচ্চ শুল্ক ও ঘরোয়া উদ্ভাবনে অর্থনীতি, শিল্প ও জনস্বাস্থ্যে একযোগে ইতিবাচক ফল মেলে। ওষুধনীতির সাফল্য আমাদের পথ দেখিয়েছে; এবার সময় সমন্বিত ‘কীটনাশক শিল্পনীতি’ প্রণয়নের—যাতে ২০৩০-এর মধ্যেই প্রয়োজনীয় রাসায়নিকের ৯৭ শতাংশ দেশেই উৎপাদিত হয়ে কৃষক, ভোক্তা ও রাষ্ট্র—সকলেই লাভবান হতে পারে।