বাংলাদেশের চালের বাজারে ফের অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। বোরো মৌসুমের ধান বাজারে আসা সত্ত্বেও নওগাঁর মতো প্রধান উৎপাদন এলাকায় কেজিতে চালের দাম বেড়েছে ১ থেকে ৩ টাকা পর্যন্ত। একই সময় আন্তর্জাতিক বাজারেও চালের সরবরাহ ও দাম নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। ফলে সরকারি পর্যায়ে আমদানির পরিকল্পনা থাকলেও ভারত থেকে চাল আনার পথ রাজনৈতিক ও প্রক্রিয়াগত কারণে বন্ধ। বেসরকারি পর্যায়েও সীমান্ত জটিলতা ও রপ্তানিকারক দেশের নীতিগত পরিবর্তনের কারণে চাল আমদানি কঠিন হয়ে পড়েছে।
ভেতরের বাজারে চাপ, ধানের দামই মূল চালক
নওগাঁ জেলা মিল মালিক ও পাইকারদের মতে, গত এক সপ্তাহে মিলগেটে জিরাশাইল ও মিনিকেট চাল বিক্রি হয়েছে ৭৩–৭৫ টাকা কেজিতে। কাটারিভোগ চাল উঠেছে ৬৫–৭০ টাকায়। ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রতি মণ ধানের দাম ১৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যাওয়ায় সরাসরি চালের দামও বেড়েছে। ধান মিলিংয়ের খরচ, পরিবহন ব্যয় ও মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাবও দাম বৃদ্ধির পেছনে অন্যতম কারণ।
নওগাঁ জেলা চালকল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার বলেন, “জিরাশাইল ও কাটারিভোগের ধান এই অঞ্চলের মূল ধান। হঠাৎ করে ধানের দাম বেড়ে যাওয়ায় মিল মালিকরা সংকটে পড়েছেন। এতে বাজারে দামের চাপ আরও বাড়ছে।”
ভারতের দিক থেকে কোনো ভরসা নেই
চালের বাজার স্থিতিশীল করতে সরকার ভারতের সঙ্গে আমদানির বিষয়টি বিবেচনায় আনলেও বর্তমানে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে কোনো সরকারি পর্যায়ের (G2G) আমদানি চুক্তি নেই। ভারতের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আপাতত স্থির থাকলেও রপ্তানি নিয়ে কঠোর মনোভাব ও অভ্যন্তরীণ খাদ্য নিরাপত্তার অজুহাতে বাংলাদেশকে চাল সরবরাহে অনাগ্রহ দেখাচ্ছে দেশটি।
বেসরকারি আমদানিকারকদের ক্ষেত্রেও সীমান্তে কাস্টমস জট, রপ্তানি অনুমোদন বিলম্ব এবং মূল্য বেশি হওয়ার কারণে আমদানিতে আগ্রহ নেই।
আন্তর্জাতিক বাজারেও চাপ
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) জুনের বাজার বিশ্লেষণে জানিয়েছে, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডে রপ্তানিযোগ্য চালের দাম গত তিন মাসে ৭–১০ শতাংশ বেড়েছে।
FAO-এর চাল মূল্যসূচক অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মে মাসে আন্তর্জাতিক চালের গড় মূল্য ছিল গত বছরের তুলনায় ২২.৬ শতাংশ কম। কিন্তু এই মূল্যহ্রাস বাংলাদেশের বাজারে কোনো প্রভাব ফেলছে না, কারণ আমদানিতে নানা প্রতিবন্ধকতা আছে।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (WFP) এক সতর্কবার্তায় বলেছে, “বাংলাদেশে স্থানীয় বাজারের মূল্যবৃদ্ধি আন্তর্জাতিক বাজার দিয়ে সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। সরবরাহ চেইনে যে বাধা ও শুল্কনীতি রয়েছে, তা না কাটালে চাল সংকট আরও তীব্র হবে।”
ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও অন্যান্য বিকল্প
চালের সম্ভাব্য বিকল্প বাজার হিসেবে থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও মায়ানমারের কথা শোনা গেলেও কার্যত প্রতিটি দেশের রপ্তানিতে নিরুৎসাহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। থাইল্যান্ডে বর্তমানে নিজস্ব রিজার্ভ সংকটে রয়েছে এবং দামও তুলনামূলকভাবে বেশি (প্রতি টন ৬২০–৬৫০ মার্কিন ডলার)। ভিয়েতনামের চাল মানে কিছুটা কম হলেও রপ্তানিযোগ্য স্টক ও কোটা সীমিত। আর ইন্দোনেশিয়া নিজেই খাদ্য ঘাটতির মুখে।
সরকারি পরিকল্পনার সীমাবদ্ধতা ও আন্তর্জাতিক মতামত
মার্কিন কৃষি বিভাগের (USDA/FAS) প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশ ২০২৫/২৬ অর্থবছরে প্রায় ৬ লাখ টন চাল আমদানি করতে পারে, যা আগের বছরের তুলনায় কম। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “স্থানীয় উৎপাদন কিছুটা ভালো হলেও অভ্যন্তরীণ বাজারে সরবরাহ সমস্যা এবং আমদানির নীতিগত জটিলতা মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।”
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (WFP) বলছে, “বাংলাদেশ যদি আমদানি প্রক্রিয়া দ্রুত ও স্বচ্ছ করতে না পারে, তাহলে আগামী দুই মাসের মধ্যে বাজারে চালের দাম আরও ৮ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে।”
সমাধান কোন পথে?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চালের বাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ জরুরি:
- বিকল্প উৎসে সরকারি চুক্তির মাধ্যমে দ্রুত চাল আমদানির উদ্যোগ
- বেসরকারি আমদানিতে সীমান্ত ও ব্যাংকিং জটিলতা দূর করা
- খাদ্য অধিদপ্তরের গুদাম থেকে জরুরি ভিত্তিতে ন্যায্যমূল্যে চাল সরবরাহ
- অসাধু মজুতদারদের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান এবং বাজার নজরদারি জোরদার
বাংলাদেশে চালের ভবিষ্যৎ বাজার এখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। অভ্যন্তরীণ উৎপাদন থাকলেও বাজারে তার প্রভাব নেই, কারণ সরবরাহচক্রে অসংখ্য প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। ভারতের দ্বার বন্ধ, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজার অনুকূল নয়। এই প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর হুঁশিয়ারি স্পষ্ট—পরিকল্পনা না বদলালে বাজারে খাদ্য সংকটের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।