শুরুটা ব্রিটিশ ভারতে: মুসলিম পরিচয়ের প্রতীক
১৮৯১ সালে ভারতের কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। এটি শুধু একটি ক্রীড়া সংগঠন নয়, বরং উপনিবেশিক ব্রিটিশ ভারতে মুসলমানদের আত্মপরিচয়, মর্যাদা এবং সামাজিক অবস্থান পুনঃপ্রতিষ্ঠার একটি প্রতীকী প্রচেষ্টা। তৎকালীন ব্রিটিশ ও হিন্দু আধিপত্যের কলকাতায় মুসলমান তরুণদের জন্য কোনো উল্লেখযোগ্য ক্রীড়া পরিসর ছিল না। সেই প্রেক্ষাপটে গঠিত হয় এই ক্লাব, যা অল্প সময়েই মুসলিম সমাজের গৌরবের প্রতীকে পরিণত হয়।
প্রথমদিকে এটি ছিল একটি সামাজিক সংগঠন। পরে এটি ফুটবল ক্লাব হিসেবে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করে তোলে। কলকাতা ময়দানে ইস্ট বেঙ্গল ও মোহনবাগানের মতো প্রতিপক্ষের বিপক্ষে মাঠে নামার মধ্য দিয়ে মোহামেডান হয়ে ওঠে মুসলমানদের হৃদয়ের ক্লাব।
ঐতিহাসিক জয়: কলকাতা ফুটবল লীগে বিপ্লব
১৯৩৪ সাল থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব টানা পাঁচবার কলকাতা ফুটবল লীগ চ্যাম্পিয়ন হয়ে ইতিহাস গড়ে। এই ধারাবাহিক সাফল্যের ফলে ক্লাবটি শুধু মুসলিম সমাজেই নয়, সারা ভারতীয় উপমহাদেশে পরিচিতি লাভ করে। এই সময়কার অনেক খেলোয়াড়ই পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশ) ছিলেন।
তৎকালীন ব্রিটিশ পত্রিকাগুলো ক্লাবটির জয়গাথাকে অভূতপূর্ব হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। মোহামেডানের ফুটবল শৈলী, দলগত সংহতি ও উদ্যম উপমহাদেশীয় ফুটবলে একটি নতুন মানদণ্ড স্থাপন করে।
ঢাকায় যাত্রা: পূর্ব বাংলার মোহামেডান
দেশভাগের পর, ১৯৪৮ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, যা কলকাতার ঐতিহ্যের উত্তরসূরি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। সেই সময় ঢাকায় মুসলিম ছাত্র, চাকরিজীবী ও খেলোয়াড়দের উদ্যোগে গঠিত হয় পূর্ব বাংলার একটি শক্তিশালী মুসলিম ক্রীড়া ক্লাব।
প্রথমদিকে এটি ছিল একটি অনাড়ম্বর ক্লাব, যার মাঠ, অবকাঠামো বা পৃষ্ঠপোষকতা সীমিত ছিল। কিন্তু একদল উদ্যমী তরুণ ও ক্রীড়া সংগঠকদের যৌথ প্রচেষ্টায় ক্লাবটি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
১৯৫০-৭০-এর দশকে গৌরব
এই সময়েই ঢাকার মোহামেডান পরিণত হয় একটি পূর্ণাঙ্গ ক্রীড়া সংগঠনে। শুধু ফুটবল নয়, ক্রিকেট, হকি, দাবা, টেবিল টেনিস ইত্যাদি খেলায় ক্লাবটির অংশগ্রহণ ও সাফল্য শুরু হয়। ১৯৫৭ সালে মোহামেডান ফুটবল দল প্রথমবারের মতো ঢাকা লীগ চ্যাম্পিয়ন হয়। এরপর এক দশকের মধ্যেই তারা ঢাকার মাঠের আধিপতি হয়ে ওঠে।
ক্লাবটির সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায় আসে ১৯৭০-এর দশকে, যখন তারা পরপর তিনবার লীগ চ্যাম্পিয়ন হয়। এ সময় ক্লাবের তারকা খেলোয়াড়দের মধ্যে ছিলেন কাইউম, সালাম মুর্শেদী, আনোয়ার পারভেজ, আবদুল গাফফার প্রমুখ।
স্বাধীনতা পরবর্তী মোহামেডান: জাতীয় পরিচয়ের অংশ
স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের পর মোহামেডান কেবল একটি ক্লাব নয়, বরং জাতীয় ঐতিহ্যের অংশে পরিণত হয়। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন গঠনের পর থেকে ক্লাবটি ঘরোয়া লীগ, ফেডারেশন কাপ এবং স্বাধীনতা কাপসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে এবং সাফল্য ধরে রাখে।
১৯৮০ ও ৯০-এর দশক ছিল ক্লাবটির স্বর্ণযুগ। এই সময়ে মোহামেডান প্রায় ১৫টি বড় শিরোপা জেতে। ক্লাবের সমর্থকদের সংখ্যা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। ফুটবলের পাশাপাশি ক্লাবটির ক্রিকেট দলও ঘরোয়া লীগে শীর্ষ স্থানে পৌঁছে যায়।
চিরপ্রতিদ্বন্দ্বিতা: আবাহনীর সঙ্গে দ্বন্দ্ব
মোহামেডান ও আবাহনীর দ্বৈরথ বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে একটি সাংস্কৃতিক পরিণতিতে পৌঁছায়। এই দুই ক্লাবের দ্বন্দ্ব শুধুমাত্র মাঠের প্রতিযোগিতা নয়; বরং এটি শ্রেণিচেতনা, জীবনধারা ও রাজনৈতিক দর্শনের প্রতিফলন।
আবাহনী ছিল অপেক্ষাকৃত আধুনিক, উচ্চমধ্যবিত্ত ঘরানার সমর্থনে গঠিত ক্লাব। বিপরীতে মোহামেডান ছিল শ্রমজীবী, পুরনো ঢাকাবাসীর আবেগভিত্তিক ক্লাব। দুই ক্লাবের প্রতিটি ম্যাচ মানেই ছিল পূর্ণ স্টেডিয়াম, তীব্র আবেগ এবং সংবাদমাধ্যমের সর্বোচ্চ মনোযোগ।
আর্থিক সঙ্কট ও পতনের সময়
২০০০ সালের পর মোহামেডানের সাফল্য কিছুটা ম্লান হয়ে যায়। বিদেশি খেলোয়াড়দের আধিপত্য, প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতার ঘাটতি এবং অভ্যন্তরীণ অব্যবস্থাপনার কারণে ক্লাবটি ধীরে ধীরে দুর্দিনের মুখে পড়ে।
এক সময়ের কিংবদন্তি ক্লাব লীগ টেবিলের নিচের দিকে নেমে আসে। চ্যাম্পিয়নশিপ কিংবা এএফসি কাপে প্রতিনিধিত্ব বন্ধ হয়ে যায়। ক্রিকেট দলও বিপিএল ও প্রিমিয়ার লীগে পিছিয়ে পড়ে।
পুনরুত্থানের চেষ্টা: নতুন পরিকল্পনা ও নেতৃত্ব
২০১০ সালের পর মোহামেডান নতুন ব্যবস্থাপনায় প্রবেশ করে। ক্লাব পরিচালনায় যুক্ত হন পেশাদার ম্যানেজার ও ক্রীড়া সংগঠকরা। তারা খেলোয়াড়দের নিয়মিত বেতন, আধুনিক প্রশিক্ষণ ও যুব দল গঠনে মনোযোগ দেন।
ফুটবলে দেশি ও বিদেশি প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের যুক্ত করে লীগে আবার কিছুটা সাফল্য ফিরে আসে। ২০২১ সালে বহু বছর পর ক্লাবটি ফেডারেশন কাপে চ্যাম্পিয়ন হয়। পাশাপাশি নারী দল ও বয়সভিত্তিক বিভাগগুলোকেও সক্রিয় করা হয়।
মোহামেডান মানেই আবেগ
আজও ঢাকার অলিগলি, চায়ের দোকান ও ক্রীড়াপ্রেমীদের আড্ডায় মোহামেডান একটি আবেগের নাম। এটি শুধুমাত্র ট্রফি বা জয় দিয়ে পরিমাপযোগ্য নয়; বরং এটি একটি পরিচয়, একটি ঐতিহ্য, এক সংগ্রামের দলিল।
বয়োজ্যেষ্ঠ সমর্থকরা আজও মাঠে বসে বলেন, “আমরা মোহামেডান, আমরা হারলেও গর্ব করি।” এই গর্বের ভিত্তি শতাব্দীপ্রাচীন—কলকাতার সেই প্রথম মুসলিম ফুটবল ক্লাব গঠনের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল।
উত্তরাধিকার ও আগামী দিনের স্বপ্ন
মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের ইতিহাস শুধু ক্রীড়াঙ্গনের নয়, এটি উপমহাদেশীয় মুসলিম সমাজের আত্মপ্রতিষ্ঠার ইতিহাসও। এই ক্লাব দেখিয়েছে, একটি ক্রীড়া দল কিভাবে একটি জাতিগোষ্ঠীর আত্মপরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠতে পারে।
ভবিষ্যতের মোহামেডান হবে হয়তো আরও আধুনিক, আরও পেশাদার। কিন্তু ক্লাবটির মূল শক্তি থাকবে তার গৌরবময় ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং হাজারো সমর্থকের হৃদয়ে লালিত কালো-সাদা পতাকায়।