‘অরেঞ্জ বাহিনী’-এর পরিচয়
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার গলি–ঘুঁজির ভিতর দিয়ে যখন গোপীবাগের দিকে ঢুকে পড়ে, চোখে পড়ে একটি পুরোনো অথচ প্রাণবন্ত ক্লাবঘর। কমলা-নীল রঙের লোগো, চারপাশে ফুটবল-ক্রিকেট-ভলিবলের স্মৃতিচারণ—এটাই ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাব। ১৯৪৯ সালে জন্ম নেওয়া এই প্রতিষ্ঠান শুধু ক্রীড়া সংগঠন নয়; বাংলাদেশের ফুটবল ও সামগ্রিক ক্রীড়াক্ষেত্রে ঘরে ঘরে স্বপ্ন বোনা এক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নাম। ক্লাব-সমর্থকেরা গর্ব করে যাদের ‘অরেঞ্জ বাহিনী’ বলেন, সেই বাহিনীই জাতীয় ফুটবলে দিয়েছে দক্ষ খেলোয়াড়, ক্রিকেটে দিয়েছে ঐতিহ্য আর গোপীবাগের গলি-মাঠে সঞ্চার করেছে অবিনশ্বর প্রাণ।
জন্ম ও সাংস্কৃতিক শিকড়
ব্রিটিশ রাজের শেষ ছায়া পেরিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকা তখন সাংস্কৃতিক জাগরণের শহর। ব্যবসায়ী কে. জি. আহমেদের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৪৯-এ ‘ব্রাদার্স ইউনিয়ন’ গড়ে ওঠে প্রথমে একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী জহিরউদ্দিন, আর সম্পাদক কিংবদন্তি সাংবাদিক এ. বি. এম. মূসা—দু’জনেই বিশ্বাস করতেন যে সাহিত্যে-সংগীতে সমাজবদলের শক্তি আছে। খেলাধুলার সূচনা ঘটে পরে; কিন্তু সেই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ছাপ আজও ক্লাবঘরের দেয়াল-দরজায় সযত্নে টাঙানো পোস্টার-ফেস্টুনে অনুভূত হয়।
স্বাধীনতার পর পুনর্জাগরণ—গফুর বালোচের হাত ধরে
মুক্তিযুদ্ধের সময় সব কার্যক্রম বন্ধ ছিল। যুদ্ধশেষে কয়েক মাস পরই প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সাইফুদ্দিন আহমদ মানিক তাঁর ভাই শহীদুদ্দিন সেলিমের মাধ্যমে আব্দুল গফুর বালোচকে ক্লাবে আনেন। ১৯৭৩-এ তৃতীয় বিভাগ, ১৯৭৪-এ দ্বিতীয় বিভাগ—টানা দু’বছর অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়ে ১৯৭৫-এ প্রথম বিভাগে পদার্পণ; আর শুরুতেই আবাহনীকে ১-০ গোলে হারিয়ে ঢাকার ফুটবল-আঙিনায় সৃষ্টি হয় চাঞ্চল্য। ১৯৭০-এর দশকের শেষ দিকে মোহাম্মদ মহসিন-হাসানুজ্জামান বাবলুর তরুণ জুটি শুধু গোল-উৎসবে মাতেনি, দর্শকদেরও দেখিয়েছে নৈপুণ্যের নতুন সংজ্ঞা।
‘আগা খান’-এর রূপকথা
১৯৮১-৮২ মৌসুমে ঢাকায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক আগা খান গোল্ড কাপে ব্রাদার্স ইউনিয়ন যৌথ চ্যাম্পিয়ন হয়ে প্রথমবার স্বাধীন বাংলাদেশের কোনো ক্লাবকে এশীয় ট্রফি ছোঁয়ার গৌরব এনে দেয়। ওমান ও ব্যাংকক ব্যাংকের মতো পরাশক্তিদের বিপক্ষে সেই জয়ের গল্প আজও গোপীবাগ পাড়ার টং-দোকানে কিংবদন্তি হয়ে ফেরে।
নব যুগের শিরোপা—২০০৩-০৫
পেশাদারি ফুটবলের প্রস্তুতি চলছিল দেশে, আর ঠিক তখনই ২০০৩-০৪ ও ২০০৫-এর টানা দু’ মৌসুমে ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন লিগ শিরোপা এনে দেয় ‘অরেঞ্জ বাহিনী’। নায়েমউদ্দিন-আলফাজ-আরমান মিয়ার আক্রমণভাগ, বিপ্লব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে গোলবার—মিলে যেন সুপ্ত আগুনের পুনর্জাগরণ। একই সময় জাতীয় লিগও (২০০৪) জেতে তারা; ২০০৫-এ ফেডারেশন কাপ, প্রিমিয়ার শিরোপা ও এএফসি কাপের গ্রুপপর্বে খেলার গৌরবও যোগ হয়।
পেশাদার যুগ ও আর্থিক লড়াই
২০০৭-এ বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) যখন প্রথমবার মাঠে গড়ায়, ব্রাদার্স ইউনিয়ন ছিল প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। কিন্তু স্পনসরের সংকট, ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা আর খেলোয়াড় ধরে রাখার কঠিনতায় ধীরে ধীরে পারফরম্যান্স নড়বড়ে হয়ে পড়ে। ২০২১-২২ মৌসুমের শেষে অবনমন বড় ধাক্কা; পরের বছর চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে অংশ না নেওয়া নিয়ে সমালোচনারও মুখে পড়ে তারা।
অবনমন পাশ কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানো
যেমনটা বহুবার হয়েছে, সংকটই ক্লাবকে নতুন উদ্যমে জাগায়। ২০২২-২৩ চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে ব্রাদার্স ইউনিয়ন ফের মাঠে নামে; ২০ ম্যাচে ১৬ জয় নিয়ে শিরোপা জিতে পুনরায় প্রিমিয়ারে উন্নীত হয়। সদ্যসমাপ্ত ২০২৪-২৫ আসরে ১০ দলের লিগে পঞ্চম স্থানে থেকে জানিয়ে দিয়েছে—অরেঞ্জ বাহিনী এখনও হার মানেনি।
ক্রিকেটেও ‘ব্রাদার্স’ ব্র্যান্ড
ফুটবলের বাইরে ব্রাদার্স ইউনিয়ন লিস্ট-এ ক্রিকেট খেলছে ১৯৭৩-এর ঢাকা মেট্রোপলিস নক-আউট টুর্নামেন্ট থেকে। ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগে দলটি নিয়মিত অংশ নেয়, আর অবনমন এড়াতে শেষ ম্যাচে নাটকীয় জয়ের গল্প আজও রেকর্ডবই-সমৃদ্ধ—২০১৮-১৯-এর শেষ দিনে বিকেএসপিকে হারানো, কিংবা ২০২৪-২৫-এ পারটেক্স স্পোর্টিংকে ১১৩ রানে উড়িয়ে দেওয়া। টাইগার শিবিরে নজমুস সাদাত, ফজলে মাহমুদের মতো পারফরমাররা ব্রাদার্স ক্যাম্পেই গড়ে তুলেছেন নিজেদের।
যুব উন্নয়ন—জাতীয় দলের আঁতুড়
গফুর বালোচের পরিচালিত স্কুল-কেন্দ্রিক যুব দলে যেমন মোহসিন-বাবলু তৈরি হয়েছিলেন, পরেও সেই ধারা অব্যাহত থাকে। মনেম মুন্না, বদরুল হাসান কিরণ থেকে আরমান, আলফাজ—জাতীয় দলের মাঝমাঠ-আক্রমণে বারবার উঠে এসেছে ব্রাদার্সের নাম। মাঠে খেলা শেখানোর পাশাপাশি ক্লাব-হোস্টেলে থাকা-খাওয়া নিশ্চিত করে তাদের শিক্ষা-জীবন এগিয়ে নিতে সহায়তা করে ‘ব্রাদার্স’।
ভলিবল-হকি ও বহুমাত্রিকতা
ফুটবল-ক্রিকেটের বাইরেও ১৯৮০-র দশকে ব্রাদার্স ইউনিয়ন ভলিবল লিগে শীর্ষ পর্যায়ে লড়েছে, জাতীয় দলে খেলেছে এমন ক্রীড়াবিদও তুলে দিয়েছে। হকিতেও দল গঠন করেছিল, যদিও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ধারাবাহিকতা রাখা যায়নি। তবু ‘মাল্টি-স্পোর্টস’ মানসিকতা গড়ে তোলার সূচনায় ব্রাদার্সের অবদান স্মরণীয়।
গোপীবাগ পাড়া ও সমর্থক সংস্কৃতি
ঢাকার ফুটবল মানেই আবাহনী-মোহামেডান দ্বৈরথ—এই স্টেরিওটাইপ ভেঙে আশির দশকে ‘অরেঞ্জ বাহিনী’ আলাদা সমর্থক সংস্কৃতি গড়ে তোলে। গোপীবাগ-বংশাল-টিকাটুলির তরুণেরা ক্লাবের পতাকায় ঘর সাজায়, ম্যাচ-দিনে কমলা জার্সিতে গ্যালারি কাঁপায়। সামাজিক উৎসব, ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্প, রক্তদান—সব জায়গায় ব্রাদার্স ইউনিয়নের নাম মিশে আছে গোপীবাগবাসীর পরিচয়ে।
সামাজিক দায়িত্ব ও মানবিক কর্মসূচি
স্বাধীনতা-পরবর্তী দুর্ভিক্ষে ক্লাব প্রাঙ্গণে ফ্রি রান্নাঘর, ১৯৮৮-র বন্যায় ত্রাণবাহী ট্রাকের বহর, ২০২০-এর কোভিড-১৯ মহামারিতে ‘কমলা কেয়ার ফান্ড’—ব্রাদার্সের ইতিহাসে মানবিক উদ্যোগ আলাদা পরিচয় তৈরি করেছে। খেলোয়াড়দের বৃত্তি থেকে স্থানীয় স্কুলমাঠ সংস্কার—এসব কারণেই অনেকের কাছে ‘ব্রাদার্স’ শুধু ক্লাব নয়, নির্ভরতার আরেক নাম।
বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে স্থায়ী অবদান
১) নতুন প্রতিভা গড়ে জাতীয় দলে সরবরাহ লাইনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা।
২) ১৯৮১-৮২ আগা খান গোল্ড কাপে আন্তর্জাতিক সাফল্য এনে বাংলাদেশের ক্লাব ফুটবলকে মানচিত্রে এক নতুন ঠিকানা।
৩) পেশাদার লিগের সূচনায় সংগঠন-ব্যবস্থাপনার মডেল হয়ে ওঠা।
৪) ক্রিকেটে লিস্ট-এ কাঠামোয় দীর্ঘকালীন স্থায়িত্ব।
৫) গোপীবাগ-কেন্দ্রিক সামাজিক-সাংস্কৃতিক রেনেসাঁ—সব মিলিয়ে ব্রাদার্স ইউনিয়ন ছাড়া বাংলাদেশের ক্রীড়া ইতিহাস অসম্পূর্ণ।
অনিঃশেষ অরেঞ্জ কাব্য
সময়ের সঙ্গে বড় ক্লাবগুলোর উত্থান-পতন স্বাভাবিক; কিন্তু ব্রাদার্স ইউনিয়ন প্রমাণ করেছে, শিকড় মজবুত হলে মলিন পাতা ঝরলেও নতুন কুঁড়ি ফোটে। আজ যখন ৭৬ পেরিয়ে ৮০-র পথে হাঁটছে ক্লাব, গোপীবাগের কমলা-নীল পতাকায় লেখা আছে—“খেলাধুলা মানে শুধু প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, ভ্রাতৃত্ব।” এই ভ্রাতৃত্বই ব্রাদার্স ইউনিয়নের নামের মর্ম এবং বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে তার অমর অবদান।