পরিবেশ সুরক্ষায় করণীয় নিয়ে সেমিনার
“নদী, হাওর, বন, কৃষিজমি ও পাহাড়: পরিবেশ সুরক্ষায় আমাদের করণীয়” শীর্ষক একটি সেমিনারে বক্তারা জানিয়েছেন, উন্নয়নের নামে যেসব প্রকল্প পরিবেশ ধ্বংস করছে, সেগুলোর তালিকা তৈরি করে তা জনসম্মুখে প্রকাশ করা এখন জরুরি।
এএলআরডি আয়োজিত এই সেমিনারে বক্তারা পরিবেশ সংরক্ষণে জনসচেতনতা, কার্যকর আইনি ব্যবস্থা এবং মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়ের গুরুত্ব তুলে ধরেন।
ট্যানারি স্থানান্তরেও দূষণ কমেনি
মূল প্রবন্ধে এএলআরডি’র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, সাভারের হেমায়েতপুরে ট্যানারি শিল্প সরিয়ে নেওয়ার পরও ধলেশ্বরী নদীর দূষণ রোধ হয়নি। সংসদীয় কমিটিতে একাধিকবার প্রস্তাব উঠলেও, পরিবেশ রক্ষা কার্যক্রম ফলপ্রসূ হয়নি।
হাওর অঞ্চলে স্থানীয়দের অংশগ্রহণ জরুরি
হাওরের প্রতিবেশ সংকট নিয়ে শামসুল হুদা বলেন, “এই সংকট নিরসনে স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো কার্যকর সমাধান সম্ভব নয়।”
কৃষিজমির দখল: খাদ্য নিরাপত্তার হুমকি
তিনি আরও বলেন, কৃষি বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তার মূল ভিত্তি হলেও কৃষিজমি অধিগ্রহণ করে ইপিজেড, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড) বা তথাকথিত উন্নয়ন প্রকল্প গড়ে তোলা হচ্ছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে পরিবেশ ও সামাজিক প্রভাব বিশ্লেষণ করা হয় না। প্রান্তিক জনগণ ও আদিবাসীদের কৃষিজমি দখল করে শিল্প প্রকল্প গ্রহণ অগ্রহণযোগ্য।
সুন্দরবন ঘিরে পরিবেশ ঝুঁকি
সুন্দরবনের আশেপাশে গড়ে উঠা বিদ্যুৎকেন্দ্র ও অন্যান্য প্রকল্প বনাঞ্চলের জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক বাফার জোন ধ্বংস করছে বলে শামসুল হুদা মন্তব্য করেন। তিনি এসব প্রকল্প বাতিল করে বন সংরক্ষণের জন্য একটি সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানান।
নদী ও পানি ব্যবস্থাপনায় কাঠামোগত সংস্কারের আহ্বান
রিভারাইন পিপল-এর মহাসচিব শেখ রোকন বলেন, “নদী, পাহাড়, বন ও হাওরের ধ্বংস যেন একটি দুষ্ট চক্রে পরিণত হয়েছে।” নদী কমিশন, আইন থাকা সত্ত্বেও বাস্তবায়নের ঘাটতি রয়েছে। তিনি নদী কমিশনের কাঠামোগত সংস্কার এবং ২০২৬ সালের গঙ্গা পানি চুক্তি নবায়নের উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান। পাশাপাশি তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়ন এবং ব্রহ্মপুত্র নদ রক্ষা, ড্যাম ও ব্যারাজগুলো পুনর্মূল্যায়নের কথাও উল্লেখ করেন।
ভয়াবহ প্লাস্টিক দূষণ ও ট্রান্সবাউন্ডারি চ্যালেঞ্জ
বিআইআইএসএস-এর গবেষক ড. সুফিয়া খানম বলেন, বাংলাদেশের নদীগুলো প্লাস্টিক ও রাসায়নিক বর্জ্যে বিপর্যস্ত। উজান থেকে আসা নদী প্লাস্টিক বহন করে বাংলাদেশের অববাহিকায় ফেলছে। বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত ১০ নদীর মধ্যে ৮টি এ উপমহাদেশে অবস্থিত।
তিনি আরও বলেন, ফ্লাই অ্যাশবাহী ভারতীয় জাহাজগুলো সুন্দরবনের পাশ দিয়ে চলাচল করছে, যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি। ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনায় সমন্বয়ের অভাব রয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ইকো সেন্সিটিভ উন্নয়ন কৌশলের আহ্বান
বারসিক-এর পরিচালক পাভেল পার্থ বলেন, পরিবেশ বনাম উন্নয়ন এই দ্বন্দ্ব থেকে রাষ্ট্রকে বেরিয়ে এসে পরিবেশবান্ধব ইকো সেন্সিটিভ উন্নয়ন কৌশল গ্রহণ করতে হবে।
চা বাগানে আগাছানাশকের ব্যবহার, ইকোপার্ক নির্মাণ, ভূগর্ভস্থ পানির বেসরকারি ব্যবহার—এসব প্রকল্প পরিবেশের জন্য হুমকি তৈরি করছে। তিনি আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন এবং বলেন, বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে জনগণের অনুমোদন ছাড়া ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করছে, যার জন্য একটি নির্দিষ্ট আইন থাকা প্রয়োজন।
পরিবেশ সূচকে বাংলাদেশের দুর্বল অবস্থান
বেলার প্রধান নির্বাহী তাসলিমা ইসলাম বলেন, “১৮০টি দেশের মধ্যে পরিবেশ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৭তম।” এটা শুধু লজ্জাজনক নয়, বরং একটি ভয়াবহ ভবিষ্যতের ইঙ্গিত। আইন ও প্রতিষ্ঠান থাকলেও বাস্তবায়নের অভাব পরিবেশ সুরক্ষার বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি পরিবেশ আদালত, নদী আইন ও কমিশনের কার্যকারিতা পর্যালোচনার আহ্বান জানান।
প্রকৃতির বিকল্প নেই: খুশী কবির
সভাপতির বক্তব্যে খুশী কবির বলেন, “উন্নয়নের নামে পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে মুনাফাভিত্তিক ও অপরিকল্পিত মানসিকতার কারণে। নদী, বন, পাহাড় বা কৃষিজমির কোনো বিকল্প নেই। এসবের সঙ্গে মানুষের জীবন, সংস্কৃতি, খাদ্য ও পানির অধিকার জড়িত। তাই সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে পরিবেশ রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে।”
জেলা প্রতিনিধিদের অভিজ্ঞতা
সেমিনারে রাজশাহী, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও সাতক্ষীরার প্রতিনিধিরা বক্তব্য রাখেন।
তাঁরা বিভিন্ন পরিবেশ সংকট তুলে ধরেন, যেমন:
- বরেন্দ্র অঞ্চলে কৃষিভিত্তিক শিল্পের সম্প্রসারণ
- টাঙ্গুয়ার হাওরে হাউসবোটের শব্দ দূষণ
- চলনবিলে নদীর উৎস বন্ধ হয়ে যাওয়া
- ইটভাটার দখলদারিত্ব
- প্লাস্টিক দূষণের প্রকোপ
এই সেমিনারে অংশগ্রহণকারী বক্তারা সম্মিলিতভাবে বলেন, বাংলাদেশের পরিবেশ এখন এক গভীর সংকটে। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য শুধু আইন নয়, প্রয়োজন কার্যকর বাস্তবায়ন, আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় এবং জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ। পরিবেশ রক্ষায় প্রকৃতির সঙ্গে মিতালী গড়তে না পারলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়বে।