লালদীঘির পাড় থেকে দেশি ফুটবলের সূর্যোদয়
ঢাকার ইতিহাসে ক্রীড়া মানে শুধু খেলাধুলা নয়, এক ধরনের সাংস্কৃতিক স্মারকও। ১৮৯৮ সালে গড়ে ওঠা ওয়ারী ক্লাব সেই স্মারকেরই পুরোনো ও স্থিতধী স্তম্ভ। ব্রিটিশ শাসনের শেষভাগে যখন বাঙালিরা জাতীয়তাবাদী চেতনার খোঁজে ফুটবলকে হাতিয়ার করে তুলছিল, ঠিক তখনই ঢাকার ছোট্ট ওয়ারী এলাকায় জন্ম নিল এ ক্লাব, যার লক্ষ্য ছিল ‘এক হৃদয়, এক মন’ (One Heart One Mind) স্লোগানে ঐক্য গড়া। এর সূচনা শুধু একটি ফুটবল দল নয়, পুরো ঢাকার ক্রীড়া-সংস্কৃতির উপাখ্যানের সূচনা।
উইলিংটন ক্লাব থেকে ওয়ারী ক্লাব
উইলিংটন ক্লাব ভেঙে যাওয়ার পর কয়েকজন উৎসাহী ক্রীড়াবিদ জমিদার রায় বহাদুর সুরেন্দ্রনাথ রায়ের সহায়তায় ১৮৯৮-এ ওয়ারী ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। ওই সময় ঢাকায় সংগঠিত ফুটবল লিগ বা নিয়মিত টুর্নামেন্ট ছিল না, তবু ক্লাবটি দ্রুতই স্থানীয় যুবকদের জন্য অনুপ্রেরণায় পরিণত হয়। প্রতিষ্ঠার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ওয়ারী ক্লাব নিজস্ব মাঠ গড়ে তোলে পুরোনো শহরের প্রাণকেন্দ্র পল্টন ময়দানে—যা পরবর্তীতে ঢাকার ফুটবল সংস্কৃতির তীর্থস্থান হয়ে ওঠে।
রাজকীয় দলকে হারিয়ে জাতীয় গৌরব
ক্লাবের প্রথম বড় সাফল্য ১৯১০ সালে। কুচবিহারের এক আমন্ত্রণমূলক টুর্নামেন্টে ব্রিটিশ কিংস্ হাউস (অনেকে ‘রয়্যাল প্যালেস টিম’ও বলেন), তাকে হারিয়ে হইচই ফেলে দেয় তারা। সেই জয়ের রেশ কাটতে না কাটতেই ১৯১৭-এ কলকাতার বিখ্যাত লিংকন ক্লাব—তৎকালীন আইএফএ শিল্ডের বর্তমান চ্যাম্পিয়ন—কে পরাজিত করে জাতীয় পর্যায়ে আলোচনায় উঠে আসে ওয়ারী। এই দুই জয় বাঙালির ফুটবল-জাতীয়তাবাদের তীব্র আবেগকে ঢাকায় এনে পৌঁছে দেয়।
পল্টন মাঠ ও ঢাকা ফুটবল লিগের বিস্তার
১৯৩০-এ পল্টন মাঠকেই ওয়ারীর আনুষ্ঠানিক ঘাঁটি ঘোষণা করা হয়। এখান থেকেই ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে নিয়মিত ঢাকা ফুটবল লিগের চর্চা—যা পরে স্বাধীন বাংলাদেশের ঘরোয়া লিগ ব্যবস্থার বীজ হিসেবে কাজ করে। পল্টনের সেই মাঠে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী স্লোগানের মাঝেই কৃতি ফুটবলাররা জন্ম নেন, যারা ঢাকা একাদশ ও পরে জাতীয় দলে জায়গা করে নেন।
আইএফএ শিল্ডে অংশগ্রহণ ও পূর্ববঙ্গের পরিচিতি
কলকাতা-কেন্দ্রিক আইএফএ শিল্ডে ১৯৪৫ পর্যন্ত নিয়মিত অংশ নেওয়া ওয়ারীর মাধ্যমে পূর্ববঙ্গের একটি স্বতন্ত্র পরিচয় তৈরি হয় বৃহত্তর ভারতীয় ফুটবল মানচিত্রে। স্বল্প বাজেট আর সীমিত প্রশিক্ষণসুবিধা সত্ত্বেও তারা একের পর এক শক্তিশালী ব্রিটিশ ও ভারতীয় দলকে চাপে ফেলেছিল, যা সমগ্র পূর্ববঙ্গে ফুটবলের জনপ্রিয়তা বাড়াতে বড় ভূমিকা রাখে।
বহুমুখী ক্রীড়াবিভাগ: হকি, ক্রিকেট, ভলিবল, টেবিল টেনিস
ফুটবলের সীমানা ছাড়িয়ে ওয়ারী ক্লাব ১৯৫০-এর দশকেই হকি, ক্রিকেট, ভলিবল ও টেবিল টেনিস বিভাগ চালু করে। ১৯৫৩-তে ঢাকা হকি লিগে রানার্স-আপ ও ১৯৬৪-তে চ্যাম্পিয়ন হয় তাদের হকি দল। টেবিল টেনিসে ১৯৭৬ ও ১৯৭৭-এ জিতে নেয় আখতার মেমোরিয়াল টুর্নামেন্ট, আর ভলিবল দলে ৭০-এর দশক থেকে ৮০-এর দশক পর্যন্ত দাপট ছিল ঈর্ষণীয়। এসব সাফল্য ক্লাবটিকে ঢাকার সর্ববৃহৎ সমন্বিত বহুমুখী ক্রীড়াপ্রতিষ্ঠানে রূপ দেয়।
১৯৭৮-এর চমক: আবাহনীকে হারিয়ে নতুন যুগ
স্বাধীনতার পর ঢাকার ফুটবল মানে তখন আবাহনী-মোহামেডানের দাপট। ঠিক সেই সময় ১৯৭৮-এ প্রথম বিভাগ লিগে আবাহনী ক্রীড়াচক্রকে হারিয়ে পুনরায় শিরোনামে আসে ওয়ারী ক্লাব। এ জয় প্রমাণ করে, শতবর্ষ ছুঁইছুঁই ক্লাবটির এখনও প্রতিদ্বন্দ্বিতার শক্তি রয়ে গেছে।
প্রশাসনিক রীতি: ঢাকার ডিসি ক্লাব সভাপতি
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই একটি রীতি অটুট—ঢাকা জেলার ডিসি (জেলা প্রশাসক) বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ক্লাবের সভাপতি হন। এই প্রচলন ওয়ারী ক্লাবকে সামগ্রিকভাবে প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ ও সমন্বয়ে সুবিধা দিলেও কখনও কখনও আমলাতান্ত্রিক ধীরগতির কারণে উন্নয়ন প্রকল্প থমকে গেছে বলে সমালোচনা রয়েছে।
নতুন সহস্রাব্দে লড়াই: ফিটনেস, অর্থসংকট ও জুয়াচক্রের কালো ছায়া
একদিকে ঐতিহ্য, অন্যদিকে অর্থাভাবে জর্জরিত পরিকাঠামো—এই দ্বান্দ্বিক বাস্তবতায় ওয়ারী ক্লাব ২০০০-এর দশক থেকে টিকে থাকার সংগ্রামে নেমেছে। খেলোয়াড় ধরে রাখার মতো বেতন, আধুনিক জিম কিংবা ফিজিও-সাপোর্ট সেভাবে না থাকায় কখনও কখনও জুয়াচক্রের মতো অশুভ তৎপরতাও ক্লাবের নামকে কলুষিত করেছে—এমন অভিযোগ সংবাদমাধ্যমে উঠেছে। তবুও যৎসামান্য স্পনসর আর স্বেচ্ছাসেবী সদস্যদের সমন্বয়ে ক্লাব এখনও লাল-সবুজের মানচিত্রে নিজের জায়গা আঁকড়ে ধরেছে।
বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে বর্তমান যাত্রা
এখন ওয়ারী ক্লাব অংশ নিচ্ছে বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্তরের পেশাদার লিগ—বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে (BCL)। নবীন ও সুলভ পারিশ্রমিকের খেলোয়াড় দলে নিয়ে প্রশিক্ষণ-কেন্দ্রিক ক্লাব হিসেবেই নিজেকে উপস্থাপন করছে তারা। লক্ষ্য একটাই—পাঁচ বছরের মধ্যে প্রিমিয়ার লিগ টিকিট নিশ্চিত করা। ক্লাব কর্তৃপক্ষ আধুনিক অ্যাকাডেমি স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়েছে, যাতে আগামী প্রজন্মের বালক-বালিকা ফুটবলারদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়।
সমাজসেবা ও সংস্কৃতিতে অবদান
ওয়ারী ক্লাব কেবল মাঠের সীমানায় সীমাবদ্ধ নয়। পুরোনো ঢাকার পাড়ায় তাদের করোনা-কালীন ত্রাণ বিতরণ, রক্তদান কর্মসূচি, পথশিশুদের শিক্ষা সহায়তা প্রকল্পে বহু ক্রীড়াপ্রেমিক স্বেচ্ছাশ্রমে যোগ দিয়েছেন। এর পাশাপাশি, বাংলা নববর্ষ ও ঈদ উপলক্ষে আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ফুটবল মাঠ রঙিন হয়ে ওঠে গান, নাটক ও ঘুড়ি উৎসবের মেলবন্ধনে। এভাবেই ক্লাব নিজেকে শুধু একটি ক্রীড়া প্রতিষ্ঠানের চেয়ে অনেক বড়—একটি সামাজিক আন্দোলনের অংশ হিসাবে তুলে ধরছে।
ভবিষ্যতের রূপরেখা: ঐতিহ্য রক্ষার দায়
ঢাকার দ্রুত নগরায়ণ, মাঠসংকট ও স্পনসরশিপের বৈষম্য—এই তিন চ্যালেঞ্জ ওয়ারীর সামনে সবচেয়ে বড়। ক্লাব কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে পুরোনো পল্টন মাঠে আধুনিক ড্রেনেজ ও ফ্লাডলাইট স্থাপন, ডিজিটাল টিকিটিং ও সদস্যতা কার্ড চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। পাশাপাশি পুরোনো ক্রীড়াবিভাগগুলোকেও ঢেলে সাজিয়ে পুনরায় হকি ও ভলিবলে শীর্ষে ফেরার স্বপ্ন দেখছে। ফুটবলের বাইরে ই-স্পোর্টস ও নারী ফুটবল দল গড়ার পরিকল্পনাও রয়েছে, যা ঐতিহ্যকে আধুনিকতার সঙ্গে মিলিয়ে ক্লাবকে নতুন শতাব্দীর উপযোগী করতে পারে।
নতুন মশালের আশা
ওয়ারী ক্লাবের ১২৭ বছরের ইতিহাস মূলত পুরোনো ঢাকার ক্রীড়া, সংস্কৃতি ও সমাজের সমান্তরাল এক চলমান মহাকাব্য। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের চাপা ক্ষোভ থেকে মুক্তিযুদ্ধোত্তর জাতীয় উল্লাস—সব সময়েই ক্লাবটি আপন আলোয় আলোকিত থেকেছে, কখনও বুকভরা স্বপ্ন, কখনও সীমাহীন সংগ্রামের কাহিনি বয়ে বেড়েছে। ভবিষ্যৎ এখনও অনিশ্চিত, তবুও ওয়ারী ক্লাবের অতীত জানিয়ে দেয়—যে ক্লাব একসময় ব্রিটিশ রাজের দলকে হারাতে পেরেছিল, তার পক্ষে নতুন শতাব্দীর লড়াইটাও জিততে অসম্ভব নয়। ঐতিহ্যের মশাল বয়ে তারা হয়তো আবারও এ দেশের ফুটবলে সোনালি দিন ফেরাতে পারে—যদি থাকে ‘এক হৃদয়, এক মন’।