ক্রমাগত ঋণ ও কিস্তির ভারে নুয়ে পড়া জীবন
বাংলাদেশের গ্রামীণ ও শহরতলির বহু দরিদ্র মানুষ এখন এনজিওর ঋণনির্ভরশীলতায় দিন কাটাচ্ছেন। প্রথমে ক্ষুদ্র ব্যবসা বা ঘরের খরচ মেটাতে নেওয়া ঋণ একপর্যায়ে হয়ে উঠছে আরও এক নতুন ঋণ নেওয়ার কারণ। ফলে এক এনজিওর ঋণ শোধ করতে গিয়ে মানুষ আরেক এনজিওর কাছে আরও বড় ঋণ নিচ্ছেন। এতে তৈরি হচ্ছে ‘ঋণের ফাঁদ’, যেখান থেকে বের হওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছে নিম্নআয়ের মানুষের জন্য।
দারিদ্র্য বিমোচনের পরিবর্তে ঋণের পরিশোধই জীবনের মূল লক্ষ্য
দিনমজুর আয়েশা বেগম দুই সন্তান ও স্বামীকে নিয়ে এখন পাঁচটি এনজিওর কাছে কিস্তি পরিশোধে ব্যস্ত। দিন শেষে যা আয় হয়, তার সিংহভাগ চলে যায় কিস্তি পরিশোধে। আয়েশা বললেন, “প্রথমে ১০ হাজার টাকা নিয়েছিলাম ছাগল কিনতে। পরে ছাগল মরল। তারপর ছেলের চিকিৎসা করতে গিয়েও ঋণ নিতে হয়েছে। এখন প্রতি সপ্তাহে পাঁচটা কিস্তি দিতেই হিমশিম খেতে হয়।”
এ ধরনের অভিজ্ঞতা শুধু আয়েশার নয়। বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে, গ্রামীণ এলাকার অন্তত ৭০ শতাংশ দরিদ্র পরিবার একাধিক এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছে। অনেকেই মাসে আয় করেন ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা, অথচ প্রতি মাসে কিস্তির পেছনে খরচ হয় ৪ থেকে ৬ হাজার টাকা।
এনজিওর চাপ: ঋণ আদায়ে নরম আচরণ নয়
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর একটি বড় অংশ দারিদ্র্য দূরীকরণ ও নারী ক্ষমতায়নের নামে ঋণ দিয়ে থাকে। কিন্তু বাস্তবে তারা সময়মতো কিস্তি না দিতে পারলেই গ্রাহকদের হেনস্তা করে, সামাজিকভাবে লজ্জিত করে। বিশেষ করে নারীরা এসব মানসিক চাপে সবচেয়ে বেশি ভোগেন। চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে এমন এক নারী আত্মহত্যা করেছিলেন কিস্তি দিতে না পারার লজ্জায়।
বিশ্লেষকদের মত: দারিদ্র্য বিমোচনে নতুন চিন্তা দরকার
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এনজিওভিত্তিক ঋণপদ্ধতি যদি আয়বর্ধক প্রকল্পের সাথে না জড়ানো হয়, তবে তা শুধু দারিদ্র্য বাড়ায়। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষক ড. শামীম আহসান বলেন, “ঋণ দিয়ে দারিদ্র্য দূর করা যায় না, যদি না তার সাথে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়। বরং দীর্ঘমেয়াদে পরিবারগুলো ঋণের জালে পড়ে আরও দুর্বল হয়।”
সরকারের ভূমিকাও প্রশ্নের মুখে
সরকারি নীতিমালায় এনজিওর কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে নানা বিধান থাকলেও বাস্তবে মাঠপর্যায়ে তেমন নজরদারি নেই। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বা এনজিও ব্যুরো মাঝে মাঝে পরিদর্শন করলেও তা নিয়মিত নয়। ফলে সুদের হার ও আদায় প্রক্রিয়া সবই নির্ভর করছে এনজিওর নিজস্ব সিদ্ধান্তে।
প্রয়োজন নীতিগত সংস্কার ও বিকল্প ব্যবস্থা
বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষের জন্য প্রকৃত অর্থে দরকার আয়ভিত্তিক সহায়তা, দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মসংস্থানের সুযোগ। এনজিওর ঋণ যদি শুধু খরচ মেটানোর জন্য ব্যবহৃত হয়, তাহলে তা কখনোই দারিদ্র্য নিরসনের উপায় হতে পারে না। সরকার ও উন্নয়ন সহযোগীদের সমন্বয়ে একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছাড়া ঋণনির্ভর জীবন থেকে মানুষকে বের করে আনা সম্ভব নয়।