০৬:১৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫
মঙ্গল অভিযানের প্রস্তুতি: মহাকাশে পাঠানো হলো গাঁজা গাছের বীজ ২০২৫ সালের সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ দেশ আইসল্যান্ড, শীর্ষ দশে সিঙ্গাপুর নৌকার বাংলাদেশ: জেলা-জেলা ঘিরে এক ইতিহাস ও সংস্কৃতি ইউরেনিয়াম এনরিচমেন্ট বা পরমাণু সমৃদ্ধকরণ কী? কীভাবে এটি করা হয়? নেতানিয়াহুর বিচার বন্ধের আহ্বান ট্রাম্পের ইরানে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলের হামলা শেষ হয়েছে- মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী শহরে টিসিবির সহায়তা, নিত্যপণ্যের সংকটে উপেক্ষিত গ্রাম আইনি সংস্কার ও দ্রুত বিচারের আহ্বান ব্লাস্টের এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের অভিনন্দন জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের যান্ত্রিক কৃষির যুগে বাংলাদেশ: মাঠে গরু নয়, চলছে মেশিন

মাঠের সংগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা — মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র

স্বাধীনতার চেতনার প্রতীক একটি ক্লাব

বাংলাদেশের ক্রীড়াক্ষেত্রে এমন কিছু প্রতিষ্ঠান আছে, যারা শুধুমাত্র খেলার জন্যই নয়, জাতীয় চেতনার ধারক-বাহক হিসেবেও নিজেদের পরিচয় তৈরি করেছে। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র (মুক্তিযোদ্ধা স্পোর্টস ক্লাব) এমনই এক অনন্য নাম, যা শুধু ফুটবল মাঠেই নয়, বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যেও এক অবিচ্ছেদ্য স্থান দখল করে আছে।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পরপরই গঠিত এই ক্লাবটি ছিল মূলত মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি স্পোর্টস সংস্থা, যার মাধ্যমে তারা জাতির সামনে নিজেদের অস্তিত্ব ধরে রাখার পাশাপাশি দেশপ্রেমের চেতনাকে তরুণদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন।

গঠনের পেছনের প্রেক্ষাপট

স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষে দেশের নানা প্রান্ত থেকে ফিরে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নতুন জীবনে খাপ খাওয়ানো একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। যুদ্ধের রণাঙ্গনে সাহসিকতার পরিচয় দিলেও শান্তিকালে সমাজে স্থান পাওয়া, স্বীকৃতি অর্জন এবং আত্মসম্মান রক্ষা করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এই প্রেক্ষাপটে মুক্তিযোদ্ধাদের একাংশ মনে করেন যে, একটি ক্রীড়া ক্লাব গঠন করলে তা মুক্তিযোদ্ধাদের ঐক্যবদ্ধ রাখবে, তাঁদের আত্মসম্মান পুনঃপ্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখবে এবং সমাজেও তাঁদের ভূমিকা দৃশ্যমান হবে।

১৯৭২ সালের দিকে এই ধারণা থেকে গঠিত হয় “মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র”। প্রাথমিকভাবে ক্লাবটি ঢাকা শহরে ছোট পরিসরে কার্যক্রম শুরু করে। তবে ১৯৮০ দশকে এসে এটি ঘরোয়া ফুটবলের একটি বড় শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

ঘরোয়া ফুটবলে উত্থান

বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলে ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়া চক্র একটি পরিচিত নাম হয়ে ওঠে। তখনকার ঢাকা লিগে মোহামেডান, আবাহনী ও ব্রাদার্স ইউনিয়নের মতো শক্ত ক্লাবগুলোর বিপক্ষে তারা সাহসী ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ফুটবল খেলতে শুরু করে।

১৯৮২ সালে মুক্তিযোদ্ধা ক্লাব প্রথমবারের মতো ঢাকা লিগে অংশ নেয়। তখন থেকেই ক্লাবটির প্রশংসনীয় পারফরম্যান্স ও শৃঙ্খলাবোধ ফুটবলপ্রেমীদের মনোযোগ কেড়ে নেয়। বিশেষ করে ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে ক্লাবটি ঘরোয়া লিগে বেশ কয়েকটি স্মরণীয় ম্যাচে বিজয় অর্জন করে।

১৯৯৭ সালে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র ‘ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ’-এ চ্যাম্পিয়ন হয়, যা ছিল তাদের ফুটবল ইতিহাসে একটি বড় সাফল্য। সেই বছর ক্লাবটির স্কোয়াডে ছিল বেশ কিছু জাতীয় দলের খেলোয়াড়, যেমন গোলরক্ষক বিপ্লব ভট্টাচার্য ও মিডফিল্ডার মুন্না। এই বিজয় মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদাকে আরও উচ্চতর করে তোলে।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অংশগ্রহণ

ঘরোয়া সাফল্যের পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র দেশের বাইরেও নিজেদের প্রতিনিধিত্ব করেছে। তারা বিভিন্ন সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে আমন্ত্রিত টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করেছে এবং বাংলাদেশ ফুটবলের প্রতিনিধিত্ব করেছে।

বিশেষত ভারতের কলকাতা, শিলিগুড়ি ও আসামে আয়োজিত কিছু ঐতিহ্যবাহী টুর্নামেন্টে তারা অংশ নিয়ে কেবল ফুটবল নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকেও বহন করেছে।

কাঠামোগত দুর্বলতা ও অর্থনৈতিক সংকট

১৯৯০-এর দশকের পর থেকে ঘরোয়া ফুটবলে বাণিজ্যিকীকরণ ও বড় স্পনসরদের আগমন ঘটলেও মুক্তিযোদ্ধা ক্লাব সে হারে আর্থিক সমর্থন পায়নি। ক্লাবটির সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ ও জাতীয় চেতনার আবেগ জড়িত থাকলেও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে খেলোয়াড় ধরে রাখা, প্রশিক্ষণের মান উন্নয়ন, কোচিং স্টাফ নিয়োগ— এ সব ক্ষেত্রে দুর্বলতা দেখা দিতে থাকে।

২০১০-এর দশকে এসে ক্লাবটি অনেকটাই পারফরম্যান্স সংকটে পড়ে। একাধিকবার তারা প্রিমিয়ার লিগ থেকে অবনমিত হয় এবং আবার ফিরে আসে। এই সময়ে ক্লাবের পুরাতন অবকাঠামো এবং আর্থিক দুর্বলতা নিয়ে গণমাধ্যমে আলোচনা শুরু হয়।

মুক্তিযোদ্ধাদের অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব

এই ক্লাবের অন্যতম বিশেষত্ব হচ্ছে—এর পরিচালনায় প্রাক্তন মুক্তিযোদ্ধারা সরাসরি জড়িত ছিলেন। শুরুতে ক্লাব পরিচালনায় ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা, বীর মুক্তিযোদ্ধা, এবং রাজনীতিবিদরা। এদের কেউ কেউ ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে দীর্ঘদিন যুক্ত ছিলেন, আবার কেউ ক্লাবটির অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে নিরলসভাবে কাজ করেছেন।

তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল একটি ক্লাবের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধকে ক্রীড়ার মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া। এখনও ক্লাবের কিছু সংগঠনিক সভায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন, জাতীয় সংগীত গাওয়া এবং ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বর বিশেষ কর্মসূচি আয়োজন একটি নিয়মিত অনুষঙ্গ।

যুব উন্নয়নে অবদান

মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র শুধু একটি পেশাদার ক্লাবই নয়, এটি অনেক তরুণ ফুটবলারের ক্যারিয়ার গঠনের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশের জাতীয় দলে খেলা বহু খেলোয়াড় তাদের ক্যারিয়ার শুরু করেছেন এই ক্লাব থেকে।

তরুণদের প্রশিক্ষণ, জেলা পর্যায়ে প্রতিভা অন্বেষণ, ও স্বল্প খরচে ট্রেনিংয়ের সুযোগ—এসবই ছিল ক্লাবের মৌলিক দিক। আজকের বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলে যারা খেলছেন, তাদের মধ্যে কেউ কেউ শৈশবে এই ক্লাবের মাঠে বল ঠেলেছেন।

বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র আবারও পুনর্গঠনের চেষ্টা চালাচ্ছে। ক্লাবটি ঢাকার বাইরে প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের খুঁজে আনছে, নতুন কোচিং স্টাফ নিয়োগ দিয়েছে এবং কিছু কর্পোরেট পৃষ্ঠপোষকতা সংগ্রহ করতে পেরেছে।

বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন এবং ক্রীড়া মন্ত্রণালয় থেকেও ক্লাবটির জন্য কিছু সহায়তার আশ্বাস এসেছে। তবে দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকতে হলে ক্লাবটিকে আধুনিক ব্যবস্থাপনায় নিয়ে যেতে হবে, যেমন—ডেটা অ্যানালিটিক্স, খেলোয়াড় স্কাউটিং প্রযুক্তি, ও ডিজিটাল মার্কেটিং ব্যবহারের মাধ্যমে ব্র্যান্ডিং জোরদার করা।

 একটি ক্লাব, একটি ইতিহাস

মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র শুধু একটি ফুটবল ক্লাব নয়, এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি জীবন্ত প্রতীক। খেলাধুলার মাঠে তারা যেমন লড়েছে, তেমনি জাতীয় ইতিহাসেও তাঁদের অবস্থান অবিস্মরণীয়। এই ক্লাব নতুন প্রজন্মকে শুধু খেলার জন্য নয়, দেশপ্রেম, শৃঙ্খলা ও আত্মত্যাগের মূল্যবোধ শেখাতে পারে।

দেশের ক্রীড়াঙ্গনে এমন ঐতিহাসিক ক্লাবের গুরুত্ব ও মর্যাদা সংরক্ষণের জন্য আমাদের সবারই সচেষ্ট হওয়া উচিত। কারণ একটি জাতির ক্রীড়া-ঐতিহ্য কেবল ট্রফির গর্বে নয়, তার পেছনের সংগ্রাম, আত্মত্যাগ ও প্রেরণার গল্পগুলোতে নিহিত থাকে।

মঙ্গল অভিযানের প্রস্তুতি: মহাকাশে পাঠানো হলো গাঁজা গাছের বীজ

মাঠের সংগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা — মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র

১০:০০:০৬ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫

স্বাধীনতার চেতনার প্রতীক একটি ক্লাব

বাংলাদেশের ক্রীড়াক্ষেত্রে এমন কিছু প্রতিষ্ঠান আছে, যারা শুধুমাত্র খেলার জন্যই নয়, জাতীয় চেতনার ধারক-বাহক হিসেবেও নিজেদের পরিচয় তৈরি করেছে। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র (মুক্তিযোদ্ধা স্পোর্টস ক্লাব) এমনই এক অনন্য নাম, যা শুধু ফুটবল মাঠেই নয়, বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যেও এক অবিচ্ছেদ্য স্থান দখল করে আছে।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পরপরই গঠিত এই ক্লাবটি ছিল মূলত মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি স্পোর্টস সংস্থা, যার মাধ্যমে তারা জাতির সামনে নিজেদের অস্তিত্ব ধরে রাখার পাশাপাশি দেশপ্রেমের চেতনাকে তরুণদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন।

গঠনের পেছনের প্রেক্ষাপট

স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষে দেশের নানা প্রান্ত থেকে ফিরে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নতুন জীবনে খাপ খাওয়ানো একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। যুদ্ধের রণাঙ্গনে সাহসিকতার পরিচয় দিলেও শান্তিকালে সমাজে স্থান পাওয়া, স্বীকৃতি অর্জন এবং আত্মসম্মান রক্ষা করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এই প্রেক্ষাপটে মুক্তিযোদ্ধাদের একাংশ মনে করেন যে, একটি ক্রীড়া ক্লাব গঠন করলে তা মুক্তিযোদ্ধাদের ঐক্যবদ্ধ রাখবে, তাঁদের আত্মসম্মান পুনঃপ্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখবে এবং সমাজেও তাঁদের ভূমিকা দৃশ্যমান হবে।

১৯৭২ সালের দিকে এই ধারণা থেকে গঠিত হয় “মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র”। প্রাথমিকভাবে ক্লাবটি ঢাকা শহরে ছোট পরিসরে কার্যক্রম শুরু করে। তবে ১৯৮০ দশকে এসে এটি ঘরোয়া ফুটবলের একটি বড় শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

ঘরোয়া ফুটবলে উত্থান

বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলে ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়া চক্র একটি পরিচিত নাম হয়ে ওঠে। তখনকার ঢাকা লিগে মোহামেডান, আবাহনী ও ব্রাদার্স ইউনিয়নের মতো শক্ত ক্লাবগুলোর বিপক্ষে তারা সাহসী ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ফুটবল খেলতে শুরু করে।

১৯৮২ সালে মুক্তিযোদ্ধা ক্লাব প্রথমবারের মতো ঢাকা লিগে অংশ নেয়। তখন থেকেই ক্লাবটির প্রশংসনীয় পারফরম্যান্স ও শৃঙ্খলাবোধ ফুটবলপ্রেমীদের মনোযোগ কেড়ে নেয়। বিশেষ করে ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে ক্লাবটি ঘরোয়া লিগে বেশ কয়েকটি স্মরণীয় ম্যাচে বিজয় অর্জন করে।

১৯৯৭ সালে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র ‘ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ’-এ চ্যাম্পিয়ন হয়, যা ছিল তাদের ফুটবল ইতিহাসে একটি বড় সাফল্য। সেই বছর ক্লাবটির স্কোয়াডে ছিল বেশ কিছু জাতীয় দলের খেলোয়াড়, যেমন গোলরক্ষক বিপ্লব ভট্টাচার্য ও মিডফিল্ডার মুন্না। এই বিজয় মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদাকে আরও উচ্চতর করে তোলে।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অংশগ্রহণ

ঘরোয়া সাফল্যের পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র দেশের বাইরেও নিজেদের প্রতিনিধিত্ব করেছে। তারা বিভিন্ন সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে আমন্ত্রিত টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করেছে এবং বাংলাদেশ ফুটবলের প্রতিনিধিত্ব করেছে।

বিশেষত ভারতের কলকাতা, শিলিগুড়ি ও আসামে আয়োজিত কিছু ঐতিহ্যবাহী টুর্নামেন্টে তারা অংশ নিয়ে কেবল ফুটবল নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকেও বহন করেছে।

কাঠামোগত দুর্বলতা ও অর্থনৈতিক সংকট

১৯৯০-এর দশকের পর থেকে ঘরোয়া ফুটবলে বাণিজ্যিকীকরণ ও বড় স্পনসরদের আগমন ঘটলেও মুক্তিযোদ্ধা ক্লাব সে হারে আর্থিক সমর্থন পায়নি। ক্লাবটির সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ ও জাতীয় চেতনার আবেগ জড়িত থাকলেও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে খেলোয়াড় ধরে রাখা, প্রশিক্ষণের মান উন্নয়ন, কোচিং স্টাফ নিয়োগ— এ সব ক্ষেত্রে দুর্বলতা দেখা দিতে থাকে।

২০১০-এর দশকে এসে ক্লাবটি অনেকটাই পারফরম্যান্স সংকটে পড়ে। একাধিকবার তারা প্রিমিয়ার লিগ থেকে অবনমিত হয় এবং আবার ফিরে আসে। এই সময়ে ক্লাবের পুরাতন অবকাঠামো এবং আর্থিক দুর্বলতা নিয়ে গণমাধ্যমে আলোচনা শুরু হয়।

মুক্তিযোদ্ধাদের অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব

এই ক্লাবের অন্যতম বিশেষত্ব হচ্ছে—এর পরিচালনায় প্রাক্তন মুক্তিযোদ্ধারা সরাসরি জড়িত ছিলেন। শুরুতে ক্লাব পরিচালনায় ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা, বীর মুক্তিযোদ্ধা, এবং রাজনীতিবিদরা। এদের কেউ কেউ ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে দীর্ঘদিন যুক্ত ছিলেন, আবার কেউ ক্লাবটির অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে নিরলসভাবে কাজ করেছেন।

তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল একটি ক্লাবের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধকে ক্রীড়ার মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া। এখনও ক্লাবের কিছু সংগঠনিক সভায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন, জাতীয় সংগীত গাওয়া এবং ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বর বিশেষ কর্মসূচি আয়োজন একটি নিয়মিত অনুষঙ্গ।

যুব উন্নয়নে অবদান

মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র শুধু একটি পেশাদার ক্লাবই নয়, এটি অনেক তরুণ ফুটবলারের ক্যারিয়ার গঠনের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশের জাতীয় দলে খেলা বহু খেলোয়াড় তাদের ক্যারিয়ার শুরু করেছেন এই ক্লাব থেকে।

তরুণদের প্রশিক্ষণ, জেলা পর্যায়ে প্রতিভা অন্বেষণ, ও স্বল্প খরচে ট্রেনিংয়ের সুযোগ—এসবই ছিল ক্লাবের মৌলিক দিক। আজকের বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলে যারা খেলছেন, তাদের মধ্যে কেউ কেউ শৈশবে এই ক্লাবের মাঠে বল ঠেলেছেন।

বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র আবারও পুনর্গঠনের চেষ্টা চালাচ্ছে। ক্লাবটি ঢাকার বাইরে প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের খুঁজে আনছে, নতুন কোচিং স্টাফ নিয়োগ দিয়েছে এবং কিছু কর্পোরেট পৃষ্ঠপোষকতা সংগ্রহ করতে পেরেছে।

বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন এবং ক্রীড়া মন্ত্রণালয় থেকেও ক্লাবটির জন্য কিছু সহায়তার আশ্বাস এসেছে। তবে দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকতে হলে ক্লাবটিকে আধুনিক ব্যবস্থাপনায় নিয়ে যেতে হবে, যেমন—ডেটা অ্যানালিটিক্স, খেলোয়াড় স্কাউটিং প্রযুক্তি, ও ডিজিটাল মার্কেটিং ব্যবহারের মাধ্যমে ব্র্যান্ডিং জোরদার করা।

 একটি ক্লাব, একটি ইতিহাস

মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র শুধু একটি ফুটবল ক্লাব নয়, এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি জীবন্ত প্রতীক। খেলাধুলার মাঠে তারা যেমন লড়েছে, তেমনি জাতীয় ইতিহাসেও তাঁদের অবস্থান অবিস্মরণীয়। এই ক্লাব নতুন প্রজন্মকে শুধু খেলার জন্য নয়, দেশপ্রেম, শৃঙ্খলা ও আত্মত্যাগের মূল্যবোধ শেখাতে পারে।

দেশের ক্রীড়াঙ্গনে এমন ঐতিহাসিক ক্লাবের গুরুত্ব ও মর্যাদা সংরক্ষণের জন্য আমাদের সবারই সচেষ্ট হওয়া উচিত। কারণ একটি জাতির ক্রীড়া-ঐতিহ্য কেবল ট্রফির গর্বে নয়, তার পেছনের সংগ্রাম, আত্মত্যাগ ও প্রেরণার গল্পগুলোতে নিহিত থাকে।