১২:৪৯ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

গণতন্ত্রের নতুন হুমকি

  • জন কিন
  • ০৭:১১:৫৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৫ জুন ২০২৫
  • 31

যাঁরা মনে করেন স্বৈরতন্ত্র’ মানেই নিছক দমন-পীড়নভয় আর অনাবৃত শক্তিতাঁরা অতি-প্রবল বিভ্রান্তিতে আছেন। স্বৈরশাসনের ক্ষমতা কেবল হাতুড়ি-পেরেকের উপমায় বোঝা যায় নাএকে বোঝাতে চৌম্বক ও লৌহখণ্ডের আকর্ষণশক্তির মতো ধারণার প্রয়োজন।

বিশ্ব জুড়ে সাম্রাজ্যবাদী প্রতিদ্বন্দ্বিতাদীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধসীমান্ত বন্ধবাণিজ্য ও শুল্ক বিরোধমহামারিগণহত্যাচরম আবহাওয়াব্যাংক ধস এবং নাগরিক অসন্তোষসব মিলিয়ে অস্থিরতা তীব্রতর হচ্ছে। সেই সঙ্গেই একধরনের নতুন স্বৈরতন্ত্রযা পুরোপুরি একবিংশ শতকের বৈশিষ্ট্যে ঠাসাদ্রুত বিস্তার লাভ করছে এবং ক্রমেই প্রাধান্য পেয়ে যাচ্ছে। স্বৈরতন্ত্র’ শব্দটি বিতর্কের জন্ম দেয়কারণ শব্দটির দীর্ঘ ও জটিল অতীত রয়েছেসাম্প্রতিককালে অটোক্রেসি’ বা স্বৈরকারিতা’ ও কথিত কর্তৃত্ববাদই ফ্যাশনেবল শব্দ। তবু শব্দটি পুনরায় ভেবেচিন্তে ব্যবহার করলে বোঝা যায়রাশিয়াইরানচীনসৌদি আরবতুরস্ককিউবাভিয়েতনামের মতো রাষ্ট্রের পাশাপাশি হাঙ্গেরিতে ভিক্টর ওরবানমেক্সিকোতে ক্লাউদিয়া শেইনবামইসরায়েলে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড জে ট্রাম্পের অনুগত গণতন্ত্র-বিরোধী আক্রমণসবই একই প্রবণতার অংশ।

এই বৈশ্বিক স্বৈরতান্ত্রিক উত্থান প্রত্যেক সচেতন মানুষকে ভাবিয়ে তোলা উচিত। রাজনীতির মহাকর্ষ’ অগ্রাহ্য করে চলছে এই শাসনরীতিএকটি প্রতারক গণতন্ত্রযেখানে শাসকেরা নাগরিকদের জীবন নিয়ন্ত্রণ-পরিচালনায় পারদর্শীতাদের সমর্থন আদায়ে দক্ষ এবং আনুগত্য নিশ্চিত করতে ওস্তাদ। স্বৈরতন্ত্র স্বেচ্ছায় দাসত্বকে পুঁজি করে। এ ক্ষমতা শুধু ভয় দেখিয়ে নয়লৌহখণ্ডের মতো নাগরিকদের নিজগুণে আকর্ষণ করেও টেকে।

বাস্তবে নতুন স্বৈরতন্ত্রের স্থপতিরা মোহছলনা ও বশ্যতার মাস্টার। তারা সহিংসতার মাত্রা মেপে-জেপে বাড়ায়-কমায়ভেজাল নির্বাচনসরকারি অনুদানখয়রাতিঅর্থের থলিআইনি ফাঁকফোকর ও জনগণ’-কে রক্ষার নিত্য অজুহাত দিয়ে শাসিতদের অনুগত করে তোলেমধ্যবিত্তশ্রমিক-কর্মচারী থেকে দরিদ্র পর্যন্ত সবাইকে। ফলাফলশীর্ষে সামরিক-আদলে পিরামিডসদৃশ শক্তিসমষ্টিযার ঘরোয়া সমর্থকই কেবল নয়সীমান্ত পেরিয়ে অন্য দেশেও অজস্র অনুকরণকারী রয়েছে।

আরও বিপজ্জনক হলস্বৈরশাসনের মানসিকতা সংক্রামক। তারা ঝাঁক বেঁধে শিকার করেতাদের অন্যায়-সম্প্রীতি’ সীমাহীন। উদাহরণ হিসেবে ২০২৫-এর মে মাসে ডোনাল্ড জে ট্রাম্পের পশ্চিম এশিয়া সফরে দেখা গিয়েছেসৌদি আরবসংযুক্ত আরব আমিরাতকাতারে তাঁকে লাল গালিচাউড়ন্ত যুদ্ধবিমানউট-অশ্বারোহী অভ্যর্থনাছড়ছড়ে স্ফটিক ঝাড়বাতিসোনা-মণির পদকআধমাইল উঁচু অট্টালিকায় আমেরিকান পতাকা’-র আলোকছটায় সম্বর্ধনা। আর বিনিময়ে ট্রিলিয়ন ডলারের প্রতিরক্ষা-বাণিজ্য চুক্তিযৌথ পারমাণবিক শক্তি কর্মসূচিউন্নত এআই চিপ আমদানির চুক্তিউপঢৌকন হিসেবে বিলাসবহুল জেটস্পষ্ট বার্তাবিপদসংকুল সময়ে স্বৈরশাসকেরা মিলেমিশে উড়েনিরাপদে থাকে।

সাংবাদিকবুদ্ধিজীবী ও নাগরিকদের মধ্যে বাড়তে থাকা সচেতনতা জানায়এ-ধরনের স্বৈরতান্ত্রিক আড়ম্বর গণতন্ত্রের মুক্ত বাতাসকে বিষিয়ে তুলছে। প্রশ্ন জাগেগণতন্ত্র দরকার কেনসংক্ষিপ্ত উত্তর: গণতন্ত্র কেবল অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমেই জনগণের স্ব-শাসন নয়বরং এটি যে-কোনো অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতার ক্ষতিকর প্রভাব ঠেকানোর উপায়। গণতন্ত্র মানুষ ও তাদের জীবমণ্ডলকে অজবাবদিহি শক্তির দূষণ থেকে রক্ষার অভিযানে সদা রূপান্তরিত এক পদ্ধতি। এর মৌলিক শক্তিকেউই স্থায়ী ভাবে ভরসাযোগ্য নয়ক্ষমতা যত বড়ই হোকদমন-দুর্দশা সৃষ্টির আগেই নাগরিকেরা আশঙ্কা প্রকাশ ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। ১৯৭৫-৭৭-এর জরুরি অবস্থায় ইন্দিরা গান্ধীর শাসনের বিরুদ্ধে যাঁরা রুখে দাঁড়িয়েছিলেনতাঁদের প্রেরণাও ছিল এই বোধগণতন্ত্র অনিশ্চিত বিপর্যয়ের আগাম সতর্কবার্তা।

জার্মান দার্শনিক ফ্রিডরিখ নীটশে অভিযোগ করেছিলেনগণতন্ত্র মানে অভিজাত শাসনের প্রতি অবিশ্বাস। ঠিকইভালো কারণেই গণতন্ত্র সবকিছু ভূতলে টেনে আনেশক্তিমান স্বৈরতান্ত্রিক ও তাদের জনগণ’-সমর্থিত বেপরোয়া ক্ষমতার বাস্তবতা যাচাই করে। এখন পর্যন্ত এ-ই সর্বোত্তম উপায়যাতে ক্ষমতাবানেরা পাগলের রাজ্যতে পা না বাড়ায়মিথ্যানীরবতা ও অস্ত্রসজ্জিত ফাঁকিবাজি’ দিয়ে বিপর্যয় ঢেকে রাখতে না পারে।

লেখক: সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক। তাঁর সদ্য প্রকাশিত গ্রন্থ: টার্বুলেন্ট টাইমসে গণতন্ত্র নিয়ে ভাবনা: সোরবোন বক্তৃতা (২০২৫)।

গণতন্ত্রের নতুন হুমকি

০৭:১১:৫৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৫ জুন ২০২৫

যাঁরা মনে করেন স্বৈরতন্ত্র’ মানেই নিছক দমন-পীড়নভয় আর অনাবৃত শক্তিতাঁরা অতি-প্রবল বিভ্রান্তিতে আছেন। স্বৈরশাসনের ক্ষমতা কেবল হাতুড়ি-পেরেকের উপমায় বোঝা যায় নাএকে বোঝাতে চৌম্বক ও লৌহখণ্ডের আকর্ষণশক্তির মতো ধারণার প্রয়োজন।

বিশ্ব জুড়ে সাম্রাজ্যবাদী প্রতিদ্বন্দ্বিতাদীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধসীমান্ত বন্ধবাণিজ্য ও শুল্ক বিরোধমহামারিগণহত্যাচরম আবহাওয়াব্যাংক ধস এবং নাগরিক অসন্তোষসব মিলিয়ে অস্থিরতা তীব্রতর হচ্ছে। সেই সঙ্গেই একধরনের নতুন স্বৈরতন্ত্রযা পুরোপুরি একবিংশ শতকের বৈশিষ্ট্যে ঠাসাদ্রুত বিস্তার লাভ করছে এবং ক্রমেই প্রাধান্য পেয়ে যাচ্ছে। স্বৈরতন্ত্র’ শব্দটি বিতর্কের জন্ম দেয়কারণ শব্দটির দীর্ঘ ও জটিল অতীত রয়েছেসাম্প্রতিককালে অটোক্রেসি’ বা স্বৈরকারিতা’ ও কথিত কর্তৃত্ববাদই ফ্যাশনেবল শব্দ। তবু শব্দটি পুনরায় ভেবেচিন্তে ব্যবহার করলে বোঝা যায়রাশিয়াইরানচীনসৌদি আরবতুরস্ককিউবাভিয়েতনামের মতো রাষ্ট্রের পাশাপাশি হাঙ্গেরিতে ভিক্টর ওরবানমেক্সিকোতে ক্লাউদিয়া শেইনবামইসরায়েলে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড জে ট্রাম্পের অনুগত গণতন্ত্র-বিরোধী আক্রমণসবই একই প্রবণতার অংশ।

এই বৈশ্বিক স্বৈরতান্ত্রিক উত্থান প্রত্যেক সচেতন মানুষকে ভাবিয়ে তোলা উচিত। রাজনীতির মহাকর্ষ’ অগ্রাহ্য করে চলছে এই শাসনরীতিএকটি প্রতারক গণতন্ত্রযেখানে শাসকেরা নাগরিকদের জীবন নিয়ন্ত্রণ-পরিচালনায় পারদর্শীতাদের সমর্থন আদায়ে দক্ষ এবং আনুগত্য নিশ্চিত করতে ওস্তাদ। স্বৈরতন্ত্র স্বেচ্ছায় দাসত্বকে পুঁজি করে। এ ক্ষমতা শুধু ভয় দেখিয়ে নয়লৌহখণ্ডের মতো নাগরিকদের নিজগুণে আকর্ষণ করেও টেকে।

বাস্তবে নতুন স্বৈরতন্ত্রের স্থপতিরা মোহছলনা ও বশ্যতার মাস্টার। তারা সহিংসতার মাত্রা মেপে-জেপে বাড়ায়-কমায়ভেজাল নির্বাচনসরকারি অনুদানখয়রাতিঅর্থের থলিআইনি ফাঁকফোকর ও জনগণ’-কে রক্ষার নিত্য অজুহাত দিয়ে শাসিতদের অনুগত করে তোলেমধ্যবিত্তশ্রমিক-কর্মচারী থেকে দরিদ্র পর্যন্ত সবাইকে। ফলাফলশীর্ষে সামরিক-আদলে পিরামিডসদৃশ শক্তিসমষ্টিযার ঘরোয়া সমর্থকই কেবল নয়সীমান্ত পেরিয়ে অন্য দেশেও অজস্র অনুকরণকারী রয়েছে।

আরও বিপজ্জনক হলস্বৈরশাসনের মানসিকতা সংক্রামক। তারা ঝাঁক বেঁধে শিকার করেতাদের অন্যায়-সম্প্রীতি’ সীমাহীন। উদাহরণ হিসেবে ২০২৫-এর মে মাসে ডোনাল্ড জে ট্রাম্পের পশ্চিম এশিয়া সফরে দেখা গিয়েছেসৌদি আরবসংযুক্ত আরব আমিরাতকাতারে তাঁকে লাল গালিচাউড়ন্ত যুদ্ধবিমানউট-অশ্বারোহী অভ্যর্থনাছড়ছড়ে স্ফটিক ঝাড়বাতিসোনা-মণির পদকআধমাইল উঁচু অট্টালিকায় আমেরিকান পতাকা’-র আলোকছটায় সম্বর্ধনা। আর বিনিময়ে ট্রিলিয়ন ডলারের প্রতিরক্ষা-বাণিজ্য চুক্তিযৌথ পারমাণবিক শক্তি কর্মসূচিউন্নত এআই চিপ আমদানির চুক্তিউপঢৌকন হিসেবে বিলাসবহুল জেটস্পষ্ট বার্তাবিপদসংকুল সময়ে স্বৈরশাসকেরা মিলেমিশে উড়েনিরাপদে থাকে।

সাংবাদিকবুদ্ধিজীবী ও নাগরিকদের মধ্যে বাড়তে থাকা সচেতনতা জানায়এ-ধরনের স্বৈরতান্ত্রিক আড়ম্বর গণতন্ত্রের মুক্ত বাতাসকে বিষিয়ে তুলছে। প্রশ্ন জাগেগণতন্ত্র দরকার কেনসংক্ষিপ্ত উত্তর: গণতন্ত্র কেবল অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমেই জনগণের স্ব-শাসন নয়বরং এটি যে-কোনো অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতার ক্ষতিকর প্রভাব ঠেকানোর উপায়। গণতন্ত্র মানুষ ও তাদের জীবমণ্ডলকে অজবাবদিহি শক্তির দূষণ থেকে রক্ষার অভিযানে সদা রূপান্তরিত এক পদ্ধতি। এর মৌলিক শক্তিকেউই স্থায়ী ভাবে ভরসাযোগ্য নয়ক্ষমতা যত বড়ই হোকদমন-দুর্দশা সৃষ্টির আগেই নাগরিকেরা আশঙ্কা প্রকাশ ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। ১৯৭৫-৭৭-এর জরুরি অবস্থায় ইন্দিরা গান্ধীর শাসনের বিরুদ্ধে যাঁরা রুখে দাঁড়িয়েছিলেনতাঁদের প্রেরণাও ছিল এই বোধগণতন্ত্র অনিশ্চিত বিপর্যয়ের আগাম সতর্কবার্তা।

জার্মান দার্শনিক ফ্রিডরিখ নীটশে অভিযোগ করেছিলেনগণতন্ত্র মানে অভিজাত শাসনের প্রতি অবিশ্বাস। ঠিকইভালো কারণেই গণতন্ত্র সবকিছু ভূতলে টেনে আনেশক্তিমান স্বৈরতান্ত্রিক ও তাদের জনগণ’-সমর্থিত বেপরোয়া ক্ষমতার বাস্তবতা যাচাই করে। এখন পর্যন্ত এ-ই সর্বোত্তম উপায়যাতে ক্ষমতাবানেরা পাগলের রাজ্যতে পা না বাড়ায়মিথ্যানীরবতা ও অস্ত্রসজ্জিত ফাঁকিবাজি’ দিয়ে বিপর্যয় ঢেকে রাখতে না পারে।

লেখক: সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক। তাঁর সদ্য প্রকাশিত গ্রন্থ: টার্বুলেন্ট টাইমসে গণতন্ত্র নিয়ে ভাবনা: সোরবোন বক্তৃতা (২০২৫)।