এক প্রাচীন ফুটবল ঐতিহ্যের নাম ‘ওয়ান্ডারার্স’
বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের সূচনা পর্বে যে কয়েকটি ক্লাব অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে, তাদের মধ্যে অন্যতম হলো ওয়ান্ডারার্স ক্লাব। ঢাকার উপনিবেশিক যুগে গড়ে ওঠা এই ক্লাবটি কেবলমাত্র খেলাধুলার ক্ষেত্রেই নয়, বরং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গতিপথে বিশিষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছে। ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত এই ক্লাবটি ঢাকায় আধুনিক ফুটবলের বীজ বপনের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং তা পরবর্তী সময়ে মোহামেডান ও আবাহনীর মতো বড় ক্লাবগুলোর উত্থানের মঞ্চ প্রস্তুত করে।
প্রতিষ্ঠা ও শুরুর দিনগুলো
ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের সূচনা হয় বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে, আনুমানিক ১৯৩৭ সালে, ব্রিটিশ ভারতের ঢাকায়। সে সময় ঢাকার ক্রীড়াঙ্গনে আধিপত্য ছিল ইংরেজ ও ইউরোপীয়দের। স্থানীয় মুসলিম ও হিন্দু যুবসমাজ ফুটবলকে জনপ্রিয় খেলায় পরিণত করার চেষ্টা করলেও তাদের সংগঠিত পরিসরে খেলার সুযোগ ছিল সীমিত। এমন প্রেক্ষাপটে স্থানীয় মুসলমান যুবকদের দ্বারা গঠিত হয় ওয়ান্ডারার্স ক্লাব।
তৎকালীন নবীন মুসলিম তরুণদের মধ্যে ফুটবলপ্রেম ও সাংগঠনিক চেতনার জোয়ারে ওয়ান্ডারার্স হয়ে ওঠে একটি সাহসী প্রচেষ্টা। তারা চেয়েছিল একটি সংগঠিত, পেশাদার ঘরানার ফুটবল দল তৈরি করতে, যারা ইউরোপীয় ও হিন্দুপ্রধান ক্লাবগুলোর বিরুদ্ধে সম্মানজনক প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলতে পারবে।
খেলোয়াড় ও ঐতিহাসিক সাফল্য
ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের ইতিহাস জুড়ে বহু গুণী ফুটবলারের পদচারণা রয়েছে। বিশ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত এই ক্লাবটি ঢাকা লীগে নিয়মিত অংশগ্রহণ করত এবং বিভিন্ন সময় শিরোপা বা রানার্স-আপ হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতার এক নতুন মাত্রা যোগ করত।
১৯৪০ ও ৫০-এর দশকে ওয়ান্ডারার্স ক্লাব ঢাকা ফুটবল লীগের অন্যতম শক্তিশালী দল হিসেবে বিবেচিত হতো। মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে ওয়ান্ডারার্স ছিল মুসলিম তরুণদের মূল ক্রীড়া আশ্রয়স্থল। ফুটবলের পাশাপাশি, এই ক্লাবের ক্রিকেট ও কাবাডি দলও একসময় শহরে সুপরিচিত ছিল।
বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব সময়ে ওয়ান্ডারার্স ছিল সেই ক্লাব, যেখান থেকে অনেক সম্ভাবনাময় খেলোয়াড় উঠে আসে। কিছু খেলোয়াড় পরে মোহামেডান বা আবাহনীর মতো বড় ক্লাবে যোগ দেন, কিন্তু তাদের শেকড় ছিল ওয়ান্ডারার্সেই।
ওয়ান্ডারার্স বনাম মোহামেডান: এক সময়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতা
ওয়ান্ডারার্স ক্লাব ও মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের মধ্যে ১৯৪০ ও ৫০-এর দশকে এক চমকপ্রদ প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে ওঠে। মোহামেডান ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হলে তারা মূলত ওয়ান্ডারার্সের অনেক প্রতিভাবান খেলোয়াড়কে নিজেদের দলে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। ফলে ওয়ান্ডারার্সের শক্তি কিছুটা দুর্বল হলেও ঐতিহ্য ও পরিচয়ের প্রশ্নে তারা বরাবরই নিজেদের আলাদা রেখেছে।
এ সময়কার কিছু স্মরণীয় ম্যাচে দু’দলের লড়াই ছিল উত্তেজনাপূর্ণ। হাজার হাজার দর্শক খেলার মাঠে ভিড় করত এই দ্বৈরথ দেখতে। ফুটবল ছিল তখন ঢাকাবাসীর আবেগ, এবং ওয়ান্ডারার্স ছিল সেই আবেগের এক পুরাতন নাম।
এক ঐতিহাসিক পরিচিতি: ‘মুসলিম ক্লাব’ থেকে শহুরে ফুটবল কেন্দ্র
ওয়ান্ডারার্স ক্লাব কখনোই শুধু একটি ফুটবল দল হিসেবে সীমাবদ্ধ ছিল না। এটি ছিল ঢাকার মুসলিম সম্প্রদায়ের ক্রীড়া চেতনার একটি প্রকাশভঙ্গি। এই ক্লাবটি সেই সময়ে ধর্মনিরপেক্ষ ক্রীড়া মঞ্চে মুসলিমদের উপস্থিতি প্রতিষ্ঠা করে, যেখানে আগে ইংরেজ ও হিন্দু অভিজাতদের প্রাধান্য ছিল।
বিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে ওয়ান্ডারার্স ক্লাব ছিল ঢাকার ক্রীড়া কেন্দ্রগুলোর একটি, যেখানে কেবল খেলা নয়—শৃঙ্খলা, নেতৃত্ব, সমাজবোধ এবং ঐক্যচেতনা চর্চা হতো। এই ক্লাবের প্রশিক্ষণ পদ্ধতি, যুবসম্প্রদায়কে খেলায় উৎসাহিত করা এবং খেলোয়াড়দের চরিত্র গঠনে গুরুত্ব দেওয়া ছিল প্রশংসনীয়।
স্বাধীনতার পর: অস্তিত্ব সংকট ও পুনরায় সংগঠনের চেষ্টা
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে নাটকীয় পরিবর্তন আসে। রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কারণে অনেক পুরনো ক্লাব তাদের কার্যক্রম হ্রাস করে অথবা প্রায় বিলুপ্তির পথে চলে যায়। ওয়ান্ডারার্স ক্লাবও সেই ধাক্কা থেকে রেহাই পায়নি।
১৯৭০ এবং ৮০-এর দশকে ক্লাবটির কার্যক্রম অনেকটাই সীমিত হয়ে পড়ে। ফুটবলে আর তারা ঢাকা লিগের শীর্ষ সারির দল হিসেবে পরিচিত ছিল না। তবে কিছু নিবেদিতপ্রাণ সংগঠক ক্লাবটিকে টিকিয়ে রাখতে সচেষ্ট ছিলেন। বিচ্ছিন্ন হলেও তারা বিভিন্ন সময় ছোট টুর্নামেন্টে অংশ নেয় এবং স্থানীয় খেলোয়াড়দের প্রশিক্ষণের সুযোগ দেন।
আধুনিক যুগে ফিরে দেখা ও ভবিষ্যতের স্বপ্ন
বর্তমানে ওয়ান্ডারার্স ক্লাব আর আগের মতো উচ্চ পর্যায়ের দল হিসেবে পরিচিত নয়, তবে ঐতিহাসিক গুরুত্বে এটি বাংলাদেশের ক্রীড়া ইতিহাসে একটি মূল্যবান নাম। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্লাবটির সাবেক সদস্য ও সমর্থকরা পুনরায় এই ক্লাবকে সংগঠিত করার চেষ্টা করছেন। তারা চান ওয়ান্ডারার্স আবার শহরের ফুটবল মানচিত্রে ফিরে আসুক।
নতুন নেতৃত্ব ও পৃষ্ঠপোষকতার সাহায্যে ক্লাবটি যুব ফুটবলে মনোযোগ দিচ্ছে। প্রশিক্ষণ ক্যাম্প, স্থানীয় প্রতিযোগিতা ও স্কুলভিত্তিক ফুটবল কার্যক্রমে অংশ নেওয়ার মাধ্যমে তারা নতুন প্রজন্মের ফুটবল প্রতিভা খুঁজে বের করার উদ্যোগ নিয়েছে।
ক্লাবের সাংগঠনিক কাঠামো ও সামাজিক প্রভাব
ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো এর সংগঠনের স্বচ্ছতা ও সামাজিক ভূমিকা। তৎকালীন সময়েই তারা একটি গণতান্ত্রিক পরিচালনা পর্ষদের মাধ্যমে ক্লাব চালানোর নজির স্থাপন করে। আজও তাদের চেষ্টার মধ্যে রয়েছে স্থানীয় যুবকদের খেলার প্রতি উৎসাহী করা, মাদকবিরোধী সচেতনতা ছড়ানো এবং স্বাস্থ্যকর জীবনচর্চার প্রসারে ভূমিকা রাখা।
ইতিহাস সংরক্ষণ ও ভবিষ্যতের পথে হাঁটা
ওয়ান্ডারার্স ক্লাব শুধুই একটি পুরনো ফুটবল দলের নাম নয়—এটি এক ঐতিহ্যের ধারক। এই ক্লাবের মধ্য দিয়ে ঢাকা শহরের ফুটবল সংস্কৃতির উন্মেষ ঘটেছিল, যা পরবর্তীতে বৃহত্তর জাতীয় ফুটবল আন্দোলনের ভিত্তি তৈরি করে। বর্তমান সময়ে এই ক্লাবের কার্যক্রম সীমিত হলেও, ইতিহাসে তাদের অবদান অপরিসীম।
আজ যখন আধুনিক ফুটবল ক্লাবগুলো পৃষ্ঠপোষকতা, অর্থ ও গ্ল্যামারের প্রতীক হয়ে উঠছে, তখন ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের মতো সংগঠনের ইতিহাসকে সংরক্ষণ করা ও পুনর্জীবিত করা একান্ত প্রয়োজন। কারণ, শেকড় ভুলে গেলে বৃক্ষ দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারে না—আর ওয়ান্ডারার্স সেই শেকড়েরই অংশ, যা আমাদের ক্রীড়াচেতনার প্রাথমিক সোপান তৈরি করেছিল।