নদীমাতৃক ভূখণ্ডের জীবনরেখা
বাংলাদেশের পরিচয়ই নদীমাতৃক দেশ হিসেবে। পদ্মা-মেঘনা-যমুনার শতধারার দেশে নৌকা শুধু পরিবহনের উপকরণ নয়, একখণ্ড সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও জীবন্ত ইতিহাস। আদিকাল থেকে আজ অবধি নানা রূপে, নানা নামে, নানা কাজে নৌকা বদলে বদলে মানুষের জীবন, বাজার ও উৎসবকে রাঙিয়ে রেখেছে।
বরিশালের ডিঙ্গি থেকে চাঁদপুরের সারডুবি: নৌকার বহু রূপ
বরিশাল ও পিরোজপুর
দক্ষিণাঞ্চলের বিস্তীর্ণ জলভূমিতে ডিঙ্গি ও গঙ্গাডিঙ্গি নৌকা যুগের পর যুগ কৃষক-মাঝির সঙ্গী। ডিঙ্গির কাঠামো হালকা, চলন দ্রুত; ধানের বোঝা থেকে শুরু করে মাছ ধরা—সবখানে এর ব্যবহার। পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় ডিঙ্গি তৈরি হয় কড়ই ও গামার কাঠে; ১০-১২ হাত দৈর্ঘ্যের এসব নৌকা আবহাওয়া খারাপেও ভাসতে পারে সহজে।
চাঁদপুর ও লক্ষ্মীপুর
মেঘনা বক্ষের উত্তাল ঢেউ সামাল দিতে এই অঞ্চলে দেখা মেলে সারডুবি বা সারিকেলি নামের শক্তপোক্ত পাটাতন নৌকা। চাঁদপুরের কুড়িয়ারচরে কারিগররা কেওড়া-গর্জন কাঠে সুরকি-তিলের মিশ্রণ লাগিয়ে জলনিরোধক গায়ে খোলস জুড়ে দেন। লক্ষ্মীপুরের রামগতিতে একই নৌকা জেলেদের গভীর সাগর-সীমা পেরোতে সাহস যোগায়।
খুলনা ও বাগেরহাট
সুন্দরবনের খাঁচাভাঙা খালপথ পাড়ি দিতে খুলনার সাম্পান-নৌকা বিখ্যাত। পিছনের অংশ উঁচু, সামনের দিক চেপে বাঁকানো—এ ঢেউ কাটতে সহায়। বাগেরহাটের দড়াটানা বাজারে এখনও সাম্পানের কাঠ কিনতে লোক ভিড় করেন, যদিও প্লাস্টিক-ফাইবারের ছোঁয়ায় ঐতিহ্য হারাচ্ছে অল্প অল্প করে।
পাহাড়ি স্রোতে সিলেট-সুনামগঞ্জের কাষারি ও কোড়া
খাসিয়া-জৈন্তিয়া পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসা পিয়াইন আর সুরমায় কাষারি-নৌকা অনন্য। ৮-৯ হাত লম্বা, খোল উঁচু—রাবার-কোজা দিয়ে ভিতর মসৃণ করে পাহাড়ি ঢালে বালি, পাথর ও বাঁশ নামানো সহজ। সুনামগঞ্জে টাঙ্গুয়ার হাওর-কেন্দ্রিক কোড়া-নৌকা দেখতে গোল-গম্বুজের মতো, মাঝখানে পাটাতন ছাউনি; বানের পানি আসবে, বাউলাইয়া ভাটিয়ালি তুলবে—এই নৌকাই ভাসমান বাড়ির মতো।
নৌকা-বাইচ: রংপুর থেকে মাদারিপুরে গতি-উৎসব
গতি, সৌন্দর্য ও সমবায়—এই ত্রিনীয়োগে নৌকা-বাইচ বাংলার লোকঐতিহ্যের প্রাণ।
রংপুরের তিস্তা-ইসামতি
কাঠামো সরু-লম্বা ‘রকেবি’ বাইচ-নৌকা ৫০-৬০ জন মাঝি টেনে নেন। পোড়াবাড়ির চমচম-মিষ্টির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাইচ-শরীর চড়ে হাসি-আড্ডা জমে ওঠে।
মাদারিপুরের পদ্মা-অন্তঃশাখা
‘গয়লা’ ও ‘মরিচা’ প্রকারের বাইচ এখানে বিখ্যাত। বর্ষা-শেষে ইশ্বরচন্দ্রপুর-কাঠালবাড়ি সীমানায় বাইচ দেখার জন্য হাজারো মানুষ নৌকায় কিংবা তীরে জমায়েত হন। বিজয়ী দলকে গ্রামের সমাজপতিরা গরু-ছাগল-রূপা উপহার দেন—শতবর্ষ ধরে চলা এ ঐতিহ্য এখনও অক্ষুণ্ন।
মৃৎশিল্প-ভাটিয়ালি ও নৌকা: সংস্কৃতির অদ্ভুত সখ্য
লোকগান
ভাটিয়ালি মূলত মাঝিদের দেহাতি সংগীত; ‘এই পদ্মা এই মেঘনা, এই যমুনা সারি সারি’—প্রতিটি সুরের পেছনে একেকটি নৌকার কাহিনি। নিয়ারায় ভাটিয়ালি, সুরের আনাঘোনা, পালতোলা নৌকার ঘুঙুর।
সাহিত্য ও চলচ্চিত্র
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’-তে কুড়ি-পঁচিশ হাতের কোষা-নৌকা; জসীমউদ্দীনের ‘নকশী কাঁথার মাঠ’-এ মেঘনা-ডিঙ্গির ডাক। আধুনিক সিনেমায় ‘সারেঙ্গ বউ’-এর একটিমাত্র সাদা পালতোলা নৌকা প্রেমের প্রতীক হয়েও নদীর দখলদারির গল্প বলে।
মৃৎশিল্প
বগুড়া ও নওগাঁর গ্রামে গয়না-নৌকার ক্ষুদ্র মৃৎমূর্তি বানানো হয়—বিয়ের সময় কনে-দেনায় সৌভাগ্য প্রতীক। এ মিনি নৌকা চলে দেশের নানা হস্তশিল্প মেলায়।
নৌকা-নির্মাণশিল্প: কাঠ, কারিগর ও অর্থনীতি
চাঁদপুর-হাজীগঞ্জ বাদামতলী ও খুলনা-দাকোপ
এই দুই অঞ্চলে যোগাড়ি (কারিগর) পরিবার প্রজন্ম ধরে নৌকা গড়ছেন। কাঠের দাম, সয়াবিন-টার তেলের লাকড়া আবরণ, তেল-কাপড় মজুরি—সব মিলিয়ে একটি মাঝারি সাইজ নৌকা বানাতে এখন গড়ে ২-৪ লক্ষ টাকা। আগের তুলনায় তিন গুণ বেশি খরচ হওয়ায় জেলেরা ভাগা-বন্দোবস্তে যৌথ মালিকানায় নৌকা কিনছেন।
প্লাস্টিক ও ফাইবার
পটুয়াখালী, গোপালগঞ্জ ও নরসিংদীতে আধুনিক ফাইবারগ্লাস ও এইচডিপিই (পি-ই) নৌকা তৈরির ক্ষুদ্র কারখানা বেড়েছে। এগুলো হালকা, মেরামত সহজ—কিন্তু কাঠের সংস্কৃতিচিহ্ন বস্তুগত সৌন্দর্য হারাচ্ছে। পরিবেশবিদরা প্লাস্টিক-বর্জ্য নিয়ে উদ্বেগ জানালেও জেলে-চালকদের মতে, ‘চালান খরচ কমাইছে’।
চ্যালেঞ্জ: নদীশাসন ও জলবায়ু পরিবর্তন
খরস্রোতা নদী শাসনের ড্রেজিং
যমুনা-পদ্মার তীব্র চর গঠনে অনেক পুরোনো নৌপথ বন্ধ হয়ে গেছে। রাজবাড়ি-গোয়ালন্দ রুট, কুষ্টিয়া-শিলাইদহ-ছাতিয়ান কুঠির ঐতিহাসিক কবি-নৌপথ এখন স্মৃতি। দ্বৈত নদীশাসন প্রকল্পে ড্রেজিং-এর ঘূর্ণি স্রোত ছোট নৌকাকে ঝুঁকিতে ফেলছে।
জলবায়ু পরিবর্তন
সমুদ্রপৃষ্ঠ উন্নয়নের ফলে উপকূলে লবণাক্ততা বাড়ছে, কাঠ ও জাটকা (চাঁদাবড়া) নৌকার মাটিতে ক্ষয় ত্বরান্বিত করছে। পাশাপাশি, ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা বৃদ্ধিতে বড় সাম্পান প্রয়োজন হলেও উচ্চমূল্য জোগাড় করা গ্রামের মৎস্যজীবীর পক্ষে কষ্টসাধ্য।
ভবিষ্যৎ: ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও সামুদ্রিক অর্থনীতির শামিল পথ
ঐতিহ্যিক জাদুঘর
রাজশাহীর চারঘাটে খেয়া-নৌকা নিয়ে ক্ষুদ্র যাদুঘর, চাঁদপুর-হাজীগঞ্জে ‘নৌকা জাদুঘর’ প্রকল্প ঘোষণা হয়েছে। সরকার ও এনজিও-সমন্বয়ে নৌকা-নির্মাণশিল্পের জীবন্ত প্রদর্শনী করলে নতুন প্রজন্ম শিখবে কাঠের কাজ ও লোকগানের স্বাদ।
ইকো-ট্যুরিজম
সুন্দরবন, টাঙ্গুয়ার হাওর ও কুশিয়ারা-ভাটির অঞ্চলে কাঠের পালতোলা নৌকা-সহ ইকো-ট্যুর তুলে ধরা যেতে পারে। এতে কারিগর-মাঝি-সংস্কৃতি বাঁচবে, পর্যটন-অর্থনীতিও বাড়বে।
স্থায়ী উপার্জন
কৃষি-মৎস্য-পর্যটনের সমন্বিত প্রকল্পে সরকারি ঋণসুবিধা দিলে নৌকা-প্রধান জেলাগুলোয় কর্মসংস্থান পোক্ত হবে। কারিগরেরা ফাইবার-কাঠ হাইব্রিড নৌকা বানিয়ে গ্রিন টেকনোলজির সঙ্গে তাল মেলাতে পারবেন।
বাংলাদেশের নৌকা কেবলই কাঠের পাতাতে গাড়া কিল-পাল নয়; এটি বাঙালির প্রাণের সঙ্গে ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত ইতিহাস, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি। বরিশালের ডিঙ্গি থেকে সুনামগঞ্জের কোড়া, রংপুরের বাইচ-রকেবি থেকে খুলনার সাম্পান—প্রতিটি নৌকার বুকে বহমান একেকটি নদীর স্রোত, জেলার গল্প ও মানুষের স্বপ্ন। প্রজন্ম বদলাচ্ছে, প্রযুক্তি বদলাচ্ছে, তবু নৌকা বাংলার মাটি ও জলের আবেগকে বয়ে চলেছে—যেমন সে বহে চলেছে সহস্র বছর ধরে, ভবিষ্যতেও তেমনি বইবে ইতিহাসের ঢেউ হয়ে।