শনিবার বিকেলে এক ছোট ভাইয়ের বাসায় গিয়েছিলাম। সে অনেক জ্ঞানী ও দেশপ্রেমিক। তার কথা শুনতে শুনতে কখন যে রাত এগারটা বেজে গিয়েছিল বুঝতে পারিনি। আমাদের কথার ফাঁকে উচ্চশিক্ষিতা শুধু নয়, একজন মমতাময়ী মা ও বোনের প্রতিকৃতি—তাঁর স্ত্রী—একটা আম এনে হাতে দিয়ে বললেন, দাদা, এটা বৌদিকে দেবেন—তখন মনে হলো রবীন্দ্রনাথের কথা, যার সারমর্ম এমনই, নারী মাধ্যাকর্ষণ শক্তির মতোই সংসার ও সমাজকে ধরে রেখেছে; তা না হলে পুরুষ এই সমাজ ও সংসার গড়তে পারত না—মেঘের মতো বাতাসে ভেসে যেত। ছোট ওই ভাইয়ের কথা শোনার মাঝে মনের ভেতর ভেসে উঠতে থাকে, পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া মায়ের মুখ, বোনের মুখ।
ফেরার সময় একটি আম নয়, একজন বোনের ভালোবাসাকে সঙ্গে নিয়ে সিটে বসে ফোনটার দিকে তাকাতেই দেখি, অনেকগুলো ফোন ও মেসেজ (ফোন সাইলেন্ট ছিল)। ফোনগুলো সবই সাংবাদিক ছোট ভাইদের। আর মেসেজও তাদের। সবগুলো ভিডিও মেসেজ। প্রতিটি ভিডিও মেসেজের ওপর লেখা মুরাদনগরের হিন্দু নারী…। একটা ভিডিও ওপেন করেই মুহূর্তে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হই। বাসায় ফিরে জামা-কাপড়ও ছাড়ার কথাও মনে ছিলো না। ছেলে বারবার তাড়া দিচ্ছে, বাবা, একটা বেজে যাচ্ছে, তুমি খেয়ে নাও, এসিডিটি বাড়বে। ছেলে সাবালক; সে বন্ধুর মতো। তার সঙ্গে পৃথিবীর তাবৎ বিষয় নিয়ে আলাপ করি। কিন্তু তাকেও বলতে পারছি না, আবার বিশ্বাসও করতে পারছি না—এ ভিডিও সত্য কিনা? কয়েকজন ছোট ভাইকে ওটা পাঠিয়ে জানতে চাইলাম, সত্যি কি এটা? তাদের অনেকে ততক্ষণে বিডিনিউজের একটি ছোট্ট সংবাদ পাঠিয়ে দিল। এরপর দেখি অনেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিকটিমের পরিবারের বক্তব্য, ভিকটিমকে উদ্ধারকারীদের বক্তব্য পাঠাচ্ছে। শরীরটা অবশ হয়ে যেতে থাকে। কোনো রকম চিন্তার শক্তি হারিয়ে ফেলি। এমনকি ৭৪ বছর বয়সী একজনকে রাত একটার পরে ফোন করে বসি।
সারা রাত ঘুম আসেনি। তখনও সূর্য ওঠেনি। তবুও বিছানায় থাকতে পারছি না। ধীরে ধীরে উঠে এসে পড়ার ঘরে বসি। না, ধাতস্থ যে হতে পেরেছি তা বলতে পারব না। তবুও মনে হতে থাকে—তাহলে কি সত্যিই পৃথিবীতে দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণ ঘটেছিল? সত্যি কি বৃদ্ধ, অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্রের ক্ষমতার লোভে দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণ করানো হয়? তাহলেই কি সত্য, যখনই রাজা ক্ষমতার লোভে অন্ধ হয় তখনই দুঃশাসন নামে; আর দুঃশাসন মানেই দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণের অবাধ অধিকার! তখন নারীরা আর কোনো মা-বোন থাকে না? আসলে চতুর পাশা খেলায় যখন ক্ষমতা দখল হয়—অর্থাৎ আধুনিক যুগে যাকে বলা হয় “মেটিকুলাস ডিজাইন”—ওই পথে যখন রাষ্ট্রক্ষমতা দখল হয়, তখন নারীরা এমনই অনিরাপদ হয়ে পড়ে।
দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণের পরে এক যুগ কেটে গেলেও এটাও সত্য, ভীমসেন দুঃশাসনের রক্ত পান করবেই। এটাই পৃথিবীর ইতিহাস বারবার বলে।
কিন্তু এই লেখা লিখতে লিখতে মনে হচ্ছে, শুধু কি দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণ হচ্ছে? যাদের বলা হয় গত সরকারবিরোধী পিপলস আপরাইজিং-এর নেতা বা চিন্তক, তাদের নিজেদের ভেতরে—তাদের নারী সহকর্মী বা সহযাত্রীদের ভেতরের যে অডিওগুলো শোনা যাচ্ছে, তা কি শোনার মতো? ওই নারী কি তাদের মা-বোনের সমস্থানীয় নয়?
বরং এ যেন অর্জুনের “গাণ্ডীব” চলে যাওয়ার পরের অবস্থা—অর্থাৎ বীরহীন একটি দেশ, যেখানে নারীরা সম্পূর্ণ অনিরাপদ। কৃষ্ণের বংশের কূলনারীদের রক্ষা করতে অর্জুন যখন তাঁদের হস্তিনাপুরে আনতে যায়, তখন নিচুজাতরা ওই কূলনারীদের কেড়ে নিয়ে যায়।
মুরাদনগরের ঘটনা, পিপল আপরাইজের নেতাদের নারী-সহযাত্রীর সঙ্গে আলাপ, পথ চলতে নারীর পোশাক নিয়ে কটাক্ষ, তার শরীরের ওপর কালি ছোড়া—সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে, সংখ্যালঘু হিন্দু নারী তো নিরাপদ নয়ই, কোনো নারীই কি ভবিষ্যতে নিরাপদ থাকবে, এ অবস্থা চলতে থাকলে?
বাস্তবে মুরাদনগরের হিন্দু নারীর বস্ত্রহীন শরীরে শুধু শাদা শাখা-পরা হাত দিয়ে নিজের ইজ্জত বাঁচানোর ওই দৃশ্য—যাদের বিবেক আছে, তাদের স্তব্ধ করে দিয়েছে। ঘুমাতে পারিনি সারারাত, আমার মতো মানুষও। তবে এমনটি যে দেখতে হবে, একেবারেই অজানা ছিল এমন নয়। সপ্তাহ দুয়েক আগে একজন বড় শিল্পপতি—যার বিভিন্ন শহরে কারখানা, সেগুলো তাঁকে নিয়মিত ভিজিটে যেতে হয়—বললেন, “দাদা, আপনারা জানেন না, মফস্বলে চাঁদাবাজির থেকেও এখন ভয়ংকর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ধর্ষণ—সংখ্যালঘু হলে তো কথাই নেই।” তিনি ঢাকারও কয়েকটি এলাকার নাম বললেন, যেগুলোয় এখন নারীদের পক্ষে বাস করা নিরাপদ নয়।
মুরাদনগরের ঘটনা ঘটেছে বৃহস্পতিবার রাতে। আর ওই বৃহস্পতিবার বিকেলেই এক হিন্দু ভদ্রমহিলা আমাকে মেসেজ করেন, “দাদা, আর নিতে পারছি না। অবস্থার যখন কোনো পরিবর্তন হবে না, তখন আত্মহত্যাই সঠিক পথ।” মেসেজটি পড়ে ভেবেছিলাম—এমন দুঃসময়ে সংখ্যালঘুদের ওপর তো একটা চাপ থাকেই—হয়তো সেটাই, হয়তো চাঁদাবাজি পর্যন্ত। কিন্তু ওই শিল্পপতির কথা যে সত্য, তা প্রমাণ পেলাম মুরাদনগরের ঘটনায়।
বাস্তবে তো সংখ্যালঘু আর সংখ্যাগুরুই শেষ কথা নয়। শেষ সত্য হলো বাংলাদেশ। এই দেশের সংস্কৃতি কি এমনই নিম্নবর্গীয়দের হাতে চলে যাবে, যেখানে নারীর শরীর আর পাশবিকতা ছাড়া তাদের কোনো সংস্কৃতি নেই?
শ্রীলংকায়ও পিপল আপরাইজ হয়, কিন্তু সেখানে যারা রাষ্ট্রপতি ভবনে ঢোকে, তারা কেউ কিছু চুরি করেনি; নারীর অন্তর্বাস নিয়ে কেউ নাচানাচি করেনি। কিন্তু বাংলাদেশের আপরাইজের ছবি বলতে সারা পৃথিবীতে দেখানো হয় হাঁস, মাছ থেকে শুরু করে ছেঁড়া কার্পেট পর্যন্ত চুরির ছবি, আর নারীর অন্তর্বাস নিয়ে নাচানাচির ছবি।
শ্রীলংকা এক মাসের মধ্যে সামাজিকভাবে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। আর আমাদের যত দিন যাচ্ছে, ততই মব-সন্ত্রাস বাড়ছে; তার সঙ্গেই “ মুরাদনগরের দ্রৌপদীর” বস্ত্র হরণ—আবার আপরাইজিং-এর নেতাদের অডিও থেকে শুরু করে নারীর অন্তর্বাস নিয়ে নাচানাচির ছবি।
বাঙালি ইরানিদের মতো এত সভ্য জাতি কখনো নয়। ইরানের অন্যদের কথা বাদই থাক; স্ত্রী বা স্বামী যদি একে অপরের জন্য অন্তর্বাস কিনে আনে বা স্ত্রী নিজে হাতে তৈরি করেও থাকেন, তা-ও একে অপরকে একটি মোড়কের ভেতরেই দেন—খোলা অবস্থায় দেন না। আর বাংলাদেশ কী দেখেছে, তা তো এখন সারা পৃথিবী জানে।
ইকোনমিস্টের এই সংখ্যায় লেখা হয়েছে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন চার বছরের মধ্যে শেষ হয়ে যায়। আর জুলাই আপরাইজিং, যার শিরোনাম তারা দিয়েছে “Bangladesh’s Blunder”, সেখানে বলা হয়েছে—এটা এক বছরেই শেষ হয়ে গেছে।
জীবনের এ প্রান্তে এসে মুদ্রার দুপিঠ যতটুকু দেখি, তাতে যা বুঝি—মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন সাড়ে তিন বছরের একটু বেশি সময়ে শেষ হয়ে যাওয়ার মূল কারণ শুধু স্বাধীনতা-বিরোধীরা নয়, মুক্তিযুদ্ধোত্তর মুক্তিযোদ্ধাদের একাংশের আচরণ, তাদের উন্মত্ততাও। তাই যারা বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর গড়ছেন, তাদের উচিত হবে মুদ্রার দুই পিঠই সেখানে সংগ্রহ করা; তা না হলে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর পূর্ণাঙ্গ হবে না, ইতিহাস বাস্তবের মাটিতে দাঁড়াবে না।
তেমনি শুনতে পাচ্ছি—গণভবনকে নাকি জুলাই যাদুঘর করা হবে। ভবিষ্যতের নির্বাচিত সরকারের জন্য সেটা কতটা যুক্তিযুক্ত, তা এখানে লিখতে চাই না। তবে যেখানেই জুলাই যাদুঘর হোক না কেন, সেখানে বিগত সরকারের অত্যাচারের বা যে স্মৃতি এই সরকার রাখতে চায়, সেটাও যেমন থাকবে; তার পাশাপাশি যে নারীর অন্তর্বাস নিয়ে নাচানাচি করেছে তার মূর্তি, যারা হাঁস, মাছ, শাক, ব্যাগ, কাপড় চুরি করেছে তাদের মূর্তি, এবং বর্তমানে তাদের চিন্তকদের যে অডিও শোনা যাচ্ছে সহযাত্রী নারীর সঙ্গে—সেগুলো থেকে শুরু করে “ মুরাদনগরের দ্রৌপদীর” বস্ত্র হরণের ভিডিও—না রাখলে সে যাদুঘর পূর্ণাঙ্গ হবে কি?
লেখক: রাষ্ট্রীয় পুরস্কার-প্রাপ্ত সাংবাদিক; সম্পাদক, সারাক্ষণ ও The Present World.