০৬:০৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৯ জুন ২০২৫

জুলাই যাদুঘরে কি “ মুরাদনগরের দ্রৌপদী” স্থান পাবে?

শনিবার বিকেলে এক ছোট ভাইয়ের বাসায় গিয়েছিলাম। সে অনেক জ্ঞানী ও দেশপ্রেমিক। তার কথা শুনতে শুনতে কখন যে রাত এগারটা বেজে গিয়েছিল বুঝতে পারিনি। আমাদের কথার ফাঁকে উচ্চশিক্ষিতা শুধু নয়একজন মমতাময়ী মা ও বোনের প্রতিকৃতিতাঁর স্ত্রীএকটা আম এনে হাতে দিয়ে বললেনদাদাএটা বৌদিকে দেবেনতখন মনে হলো রবীন্দ্রনাথের কথাযার সারমর্ম এমনইনারী মাধ্যাকর্ষণ শক্তির মতোই সংসার ও সমাজকে ধরে রেখেছেতা না হলে পুরুষ এই সমাজ ও সংসার গড়তে পারত নামেঘের মতো বাতাসে ভেসে যেত। ছোট ওই ভাইয়ের কথা শোনার মাঝে মনের ভেতর ভেসে উঠতে থাকেপৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া মায়ের মুখবোনের মুখ।

ফেরার সময় একটি আম নয়একজন বোনের ভালোবাসাকে সঙ্গে নিয়ে সিটে বসে ফোনটার দিকে তাকাতেই দেখিঅনেকগুলো ফোন ও মেসেজ (ফোন সাইলেন্ট ছিল)। ফোনগুলো সবই সাংবাদিক ছোট ভাইদের। আর মেসেজও তাদের। সবগুলো ভিডিও মেসেজ। প্রতিটি ভিডিও মেসেজের ওপর লেখা মুরাদনগরের হিন্দু নারী। একটা ভিডিও ওপেন করেই মুহূর্তে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হই। বাসায় ফিরে জামা-কাপড়ও ছাড়ার কথাও মনে ছিলো না। ছেলে বারবার তাড়া দিচ্ছেবাবাএকটা বেজে যাচ্ছেতুমি খেয়ে নাওএসিডিটি বাড়বে। ছেলে সাবালকসে বন্ধুর মতো। তার সঙ্গে পৃথিবীর তাবৎ বিষয় নিয়ে আলাপ করি। কিন্তু তাকেও বলতে পারছি নাআবার বিশ্বাসও করতে পারছি নাএ ভিডিও সত্য কিনা? কয়েকজন ছোট ভাইকে ওটা পাঠিয়ে জানতে চাইলামসত্যি কি এটাতাদের অনেকে ততক্ষণে বিডিনিউজের একটি ছোট্ট সংবাদ পাঠিয়ে দিল। এরপর দেখি অনেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিকটিমের পরিবারের বক্তব্যভিকটিমকে উদ্ধারকারীদের বক্তব্য পাঠাচ্ছে। শরীরটা অবশ হয়ে যেতে থাকে। কোনো রকম চিন্তার শক্তি হারিয়ে ফেলি। এমনকি ৭৪ বছর বয়সী একজনকে রাত একটার পরে ফোন করে বসি।

সারা রাত ঘুম আসেনি। তখনও সূর্য ওঠেনি। তবুও বিছানায় থাকতে পারছি না। ধীরে ধীরে উঠে এসে পড়ার ঘরে বসি। নাধাতস্থ যে হতে পেরেছি তা বলতে পারব না। তবুও মনে হতে থাকেতাহলে কি সত্যিই পৃথিবীতে দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণ ঘটেছিলসত্যি কি বৃদ্ধঅন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্রের ক্ষমতার লোভে দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণ করানো হয়তাহলেই কি সত্যযখনই রাজা ক্ষমতার লোভে অন্ধ হয় তখনই দুঃশাসন নামেআর দুঃশাসন মানেই দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণের অবাধ অধিকার! তখন নারীর আর কোনো মা-বোন থাকে নাআসলে চতুর পাশা খেলায় যখন ক্ষমতা দখল হয়অর্থাৎ আধুনিক যুগে যাকে বলা হয় মেটিকুলাস ডিজাইন”—ওই পথে যখন রাষ্ট্রক্ষমতা দখল হয়তখন নারীরা এমনই অনিরাপদ হয়ে পড়ে।

দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণের পরে এক যুগ কেটে গেলেও এটাও সত্যভীমসেন দুঃশাসনের রক্ত পান করবেই। এটাই পৃথিবীর ইতিহাস বারবার বলে।

কিন্তু এই লেখা লিখতে লিখতে মনে হচ্ছেশুধু কি দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণ হচ্ছেযাদের বলা হয় গত সরকারবিরোধী পিপলস আপরাইজিং-এর নেতা বা চিন্তকতাদের নিজেদের ভেতরেতাদের নারী সহকর্মী বা সহযাত্রীদের ভেতরের যে অডিওগুলো শোনা যাচ্ছেতা কি শোনার মতোওই নারী কি তাদের মা-বোনের সমস্থানীয় নয়?

বরং এ যেন অর্জুনের গাণ্ডীব” চলে যাওয়ার পরের অবস্থাঅর্থাৎ বীরহীন একটি দেশযেখানে নারীরা সম্পূর্ণ অনিরাপদ। কৃষ্ণের বংশের কূলনারীদের রক্ষা করতে অর্জুন যখন তাঁদের হস্তিনাপুরে আনতে যায়তখন নিচুজাতরা ওই কূলনারীদের কেড়ে নিয়ে যায়।

মুরাদনগরের ঘটনাপিপল আপরাইজের নেতাদের নারী-সহযাত্রীর সঙ্গে আলাপপথ চলতে নারীর পোশাক নিয়ে কটাক্ষতার শরীরের ওপর কালি ছোড়াসব মিলিয়ে মনে হচ্ছেসংখ্যালঘু হিন্দু নারী তো নিরাপদ নয়ইকোনো নারীই কি ভবিষ্যতে নিরাপদ থাকবেএ অবস্থা চলতে থাকলে?

বাস্তবে মুরাদনগরের হিন্দু নারীর বস্ত্রহীন শরীরে শুধু শাদা শাখা-পরা হাত দিয়ে নিজের ইজ্জত বাঁচানোর ওই দৃশ্যযাদের বিবেক আছেতাদের স্তব্ধ করে দিয়েছে। ঘুমাতে পারিনি সারারাতআমার মতো মানুষও। তবে এমনটি যে দেখতে হবেএকেবারেই অজানা ছিল এমন নয়। সপ্তাহ দুয়েক আগে একজন বড় শিল্পপতিযার বিভিন্ন শহরে কারখানাসেগুলো তাঁকে নিয়মিত ভিজিটে যেতে হয়বললেন, “দাদাআপনারা জানেন নামফস্বলে চাঁদাবাজির থেকেও এখন ভয়ংকর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ধর্ষণসংখ্যালঘু হলে তো কথাই নেই।” তিনি ঢাকারও কয়েকটি এলাকার নাম বললেনযেগুলোয় এখন নারীদের পক্ষে বাস করা নিরাপদ নয়।

মুরাদনগরের ঘটনা ঘটেছে বৃহস্পতিবার রাতে। আর ওই বৃহস্পতিবার বিকেলেই এক হিন্দু ভদ্রমহিলা আমাকে মেসেজ করেন, “দাদাআর নিতে পারছি না। অবস্থার যখন কোনো পরিবর্তন হবে নাতখন আত্মহত্যাই সঠিক পথ।” মেসেজটি পড়ে ভেবেছিলামএমন দুঃসময়ে সংখ্যালঘুদের ওপর তো একটা চাপ থাকেইহয়তো সেটাইহয়তো চাঁদাবাজি পর্যন্ত। কিন্তু ওই শিল্পপতির কথা যে সত্যতা প্রমাণ পেলাম মুরাদনগরের ঘটনায়।

বাস্তবে তো সংখ্যালঘু আর সংখ্যাগুরুই শেষ কথা নয়। শেষ সত্য হলো বাংলাদেশ। এই দেশের সংস্কৃতি কি এমনই নিম্নবর্গীয়দের হাতে চলে যাবেযেখানে নারীর শরীর আর পাশবিকতা ছাড়া তাদের কোনো সংস্কৃতি নেই?

শ্রীলংকায়ও পিপল আপরাইজ হয়কিন্তু সেখানে যারা রাষ্ট্রপতি ভবনে ঢোকেতারা কেউ কিছু চুরি করেনিনারীর অন্তর্বাস নিয়ে কেউ নাচানাচি করেনি। কিন্তু বাংলাদেশের আপরাইজের ছবি বলতে সারা পৃথিবীতে দেখানো হয় হাঁসমাছ থেকে শুরু করে ছেঁড়া কার্পেট পর্যন্ত চুরির ছবিআর নারীর অন্তর্বাস নিয়ে নাচানাচির ছবি।

শ্রীলংকা এক মাসের মধ্যে সামাজিকভাবে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। আর আমাদের যত দিন যাচ্ছেততই মব-সন্ত্রাস বাড়ছেতার সঙ্গেই “ মুরাদনগরে দ্রৌপদীর”  বস্ত্র হরণআবার আপরাইজিং-এর নেতাদের অডিও থেকে শুরু করে নারীর অন্তর্বাস নিয়ে নাচানাচির ছবি।

বাঙালি ইরানিদের মতো এত সভ্য জাতি কখনো নয়। ইরানের অন্যদের কথা বাদই থাকস্ত্রী বা স্বামী যদি একে অপরের জন্য অন্তর্বাস কিনে আনে বা স্ত্রী নিজে হাতে তৈরি করেও থাকেনতা-ও একে অপরকে একটি মোড়কের ভেতরেই দেনখোলা অবস্থায় দেন না। আর বাংলাদেশ কী দেখেছেতা তো এখন সারা পৃথিবী জানে।

ইকোনমিস্টের এই সংখ্যায় লেখা হয়েছেবাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন চার বছরের মধ্যে শেষ হয়ে যায়। আর জুলাই আপরাইজিংযার শিরোনাম তারা দিয়েছে “Bangladesh’s Blunder”, সেখানে বলা হয়েছেএটা এক বছরেই শেষ হয়ে গেছে।

জীবনের এ প্রান্তে এসে মুদ্রার দুপিঠ যতটুকু দেখিতাতে যা বুঝিমুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন সাড়ে তিন বছরের একটু বেশি সময়ে শেষ হয়ে যাওয়ার মূল কারণ শুধু স্বাধীনতা-বিরোধীরা নয়মুক্তিযুদ্ধোত্তর মুক্তিযোদ্ধাদের একাংশের আচরণতাদের উন্মত্ততাও। তাই যারা বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর গড়ছেনতাদের উচিত হবে মুদ্রার দুই পিঠই সেখানে সংগ্রহ করাতা না হলে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর পূর্ণাঙ্গ হবে নাইতিহাস বাস্তবের মাটিতে দাঁড়াবে না।

তেমনি শুনতে পাচ্ছিগণভবনকে নাকি জুলাই যাদুঘর করা হবে। ভবিষ্যতের নির্বাচিত সরকারের জন্য সেটা কতটা যুক্তিযুক্ততা এখানে লিখতে চাই না। তবে যেখানেই জুলাই যাদুঘর হোক না কেনসেখানে বিগত সরকারের অত্যাচারের বা যে স্মৃতি এই সরকার রাখতে চায়সেটাও যেমন থাকবেতার পাশাপাশি যে নারীর অন্তর্বাস নিয়ে নাচানাচি করেছে তার মূর্তিযারা হাঁসমাছশাকব্যাগকাপড় চুরি করেছে তাদের মূর্তিএবং বর্তমানে তাদের চিন্তকদের যে অডিও শোনা যাচ্ছে সহযাত্রী নারীর সঙ্গেসেগুলো থেকে শুরু করে “ মুরাদনগরের দ্রৌপদীর”  বস্ত্র হরণের ভিডিওনা রাখলে সে যাদুঘর পূর্ণাঙ্গ হবে কি?

লেখক: রাষ্ট্রীয় পুরস্কার-প্রাপ্ত সাংবাদিকসম্পাদকসারাক্ষণ ও The Present World.

আরব আমিরাত, মরুভূমি শহরে ৪৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা

জুলাই যাদুঘরে কি “ মুরাদনগরের দ্রৌপদী” স্থান পাবে?

০১:৫৩:৩৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৯ জুন ২০২৫

শনিবার বিকেলে এক ছোট ভাইয়ের বাসায় গিয়েছিলাম। সে অনেক জ্ঞানী ও দেশপ্রেমিক। তার কথা শুনতে শুনতে কখন যে রাত এগারটা বেজে গিয়েছিল বুঝতে পারিনি। আমাদের কথার ফাঁকে উচ্চশিক্ষিতা শুধু নয়একজন মমতাময়ী মা ও বোনের প্রতিকৃতিতাঁর স্ত্রীএকটা আম এনে হাতে দিয়ে বললেনদাদাএটা বৌদিকে দেবেনতখন মনে হলো রবীন্দ্রনাথের কথাযার সারমর্ম এমনইনারী মাধ্যাকর্ষণ শক্তির মতোই সংসার ও সমাজকে ধরে রেখেছেতা না হলে পুরুষ এই সমাজ ও সংসার গড়তে পারত নামেঘের মতো বাতাসে ভেসে যেত। ছোট ওই ভাইয়ের কথা শোনার মাঝে মনের ভেতর ভেসে উঠতে থাকেপৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া মায়ের মুখবোনের মুখ।

ফেরার সময় একটি আম নয়একজন বোনের ভালোবাসাকে সঙ্গে নিয়ে সিটে বসে ফোনটার দিকে তাকাতেই দেখিঅনেকগুলো ফোন ও মেসেজ (ফোন সাইলেন্ট ছিল)। ফোনগুলো সবই সাংবাদিক ছোট ভাইদের। আর মেসেজও তাদের। সবগুলো ভিডিও মেসেজ। প্রতিটি ভিডিও মেসেজের ওপর লেখা মুরাদনগরের হিন্দু নারী। একটা ভিডিও ওপেন করেই মুহূর্তে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হই। বাসায় ফিরে জামা-কাপড়ও ছাড়ার কথাও মনে ছিলো না। ছেলে বারবার তাড়া দিচ্ছেবাবাএকটা বেজে যাচ্ছেতুমি খেয়ে নাওএসিডিটি বাড়বে। ছেলে সাবালকসে বন্ধুর মতো। তার সঙ্গে পৃথিবীর তাবৎ বিষয় নিয়ে আলাপ করি। কিন্তু তাকেও বলতে পারছি নাআবার বিশ্বাসও করতে পারছি নাএ ভিডিও সত্য কিনা? কয়েকজন ছোট ভাইকে ওটা পাঠিয়ে জানতে চাইলামসত্যি কি এটাতাদের অনেকে ততক্ষণে বিডিনিউজের একটি ছোট্ট সংবাদ পাঠিয়ে দিল। এরপর দেখি অনেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিকটিমের পরিবারের বক্তব্যভিকটিমকে উদ্ধারকারীদের বক্তব্য পাঠাচ্ছে। শরীরটা অবশ হয়ে যেতে থাকে। কোনো রকম চিন্তার শক্তি হারিয়ে ফেলি। এমনকি ৭৪ বছর বয়সী একজনকে রাত একটার পরে ফোন করে বসি।

সারা রাত ঘুম আসেনি। তখনও সূর্য ওঠেনি। তবুও বিছানায় থাকতে পারছি না। ধীরে ধীরে উঠে এসে পড়ার ঘরে বসি। নাধাতস্থ যে হতে পেরেছি তা বলতে পারব না। তবুও মনে হতে থাকেতাহলে কি সত্যিই পৃথিবীতে দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণ ঘটেছিলসত্যি কি বৃদ্ধঅন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্রের ক্ষমতার লোভে দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণ করানো হয়তাহলেই কি সত্যযখনই রাজা ক্ষমতার লোভে অন্ধ হয় তখনই দুঃশাসন নামেআর দুঃশাসন মানেই দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণের অবাধ অধিকার! তখন নারীর আর কোনো মা-বোন থাকে নাআসলে চতুর পাশা খেলায় যখন ক্ষমতা দখল হয়অর্থাৎ আধুনিক যুগে যাকে বলা হয় মেটিকুলাস ডিজাইন”—ওই পথে যখন রাষ্ট্রক্ষমতা দখল হয়তখন নারীরা এমনই অনিরাপদ হয়ে পড়ে।

দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণের পরে এক যুগ কেটে গেলেও এটাও সত্যভীমসেন দুঃশাসনের রক্ত পান করবেই। এটাই পৃথিবীর ইতিহাস বারবার বলে।

কিন্তু এই লেখা লিখতে লিখতে মনে হচ্ছেশুধু কি দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণ হচ্ছেযাদের বলা হয় গত সরকারবিরোধী পিপলস আপরাইজিং-এর নেতা বা চিন্তকতাদের নিজেদের ভেতরেতাদের নারী সহকর্মী বা সহযাত্রীদের ভেতরের যে অডিওগুলো শোনা যাচ্ছেতা কি শোনার মতোওই নারী কি তাদের মা-বোনের সমস্থানীয় নয়?

বরং এ যেন অর্জুনের গাণ্ডীব” চলে যাওয়ার পরের অবস্থাঅর্থাৎ বীরহীন একটি দেশযেখানে নারীরা সম্পূর্ণ অনিরাপদ। কৃষ্ণের বংশের কূলনারীদের রক্ষা করতে অর্জুন যখন তাঁদের হস্তিনাপুরে আনতে যায়তখন নিচুজাতরা ওই কূলনারীদের কেড়ে নিয়ে যায়।

মুরাদনগরের ঘটনাপিপল আপরাইজের নেতাদের নারী-সহযাত্রীর সঙ্গে আলাপপথ চলতে নারীর পোশাক নিয়ে কটাক্ষতার শরীরের ওপর কালি ছোড়াসব মিলিয়ে মনে হচ্ছেসংখ্যালঘু হিন্দু নারী তো নিরাপদ নয়ইকোনো নারীই কি ভবিষ্যতে নিরাপদ থাকবেএ অবস্থা চলতে থাকলে?

বাস্তবে মুরাদনগরের হিন্দু নারীর বস্ত্রহীন শরীরে শুধু শাদা শাখা-পরা হাত দিয়ে নিজের ইজ্জত বাঁচানোর ওই দৃশ্যযাদের বিবেক আছেতাদের স্তব্ধ করে দিয়েছে। ঘুমাতে পারিনি সারারাতআমার মতো মানুষও। তবে এমনটি যে দেখতে হবেএকেবারেই অজানা ছিল এমন নয়। সপ্তাহ দুয়েক আগে একজন বড় শিল্পপতিযার বিভিন্ন শহরে কারখানাসেগুলো তাঁকে নিয়মিত ভিজিটে যেতে হয়বললেন, “দাদাআপনারা জানেন নামফস্বলে চাঁদাবাজির থেকেও এখন ভয়ংকর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ধর্ষণসংখ্যালঘু হলে তো কথাই নেই।” তিনি ঢাকারও কয়েকটি এলাকার নাম বললেনযেগুলোয় এখন নারীদের পক্ষে বাস করা নিরাপদ নয়।

মুরাদনগরের ঘটনা ঘটেছে বৃহস্পতিবার রাতে। আর ওই বৃহস্পতিবার বিকেলেই এক হিন্দু ভদ্রমহিলা আমাকে মেসেজ করেন, “দাদাআর নিতে পারছি না। অবস্থার যখন কোনো পরিবর্তন হবে নাতখন আত্মহত্যাই সঠিক পথ।” মেসেজটি পড়ে ভেবেছিলামএমন দুঃসময়ে সংখ্যালঘুদের ওপর তো একটা চাপ থাকেইহয়তো সেটাইহয়তো চাঁদাবাজি পর্যন্ত। কিন্তু ওই শিল্পপতির কথা যে সত্যতা প্রমাণ পেলাম মুরাদনগরের ঘটনায়।

বাস্তবে তো সংখ্যালঘু আর সংখ্যাগুরুই শেষ কথা নয়। শেষ সত্য হলো বাংলাদেশ। এই দেশের সংস্কৃতি কি এমনই নিম্নবর্গীয়দের হাতে চলে যাবেযেখানে নারীর শরীর আর পাশবিকতা ছাড়া তাদের কোনো সংস্কৃতি নেই?

শ্রীলংকায়ও পিপল আপরাইজ হয়কিন্তু সেখানে যারা রাষ্ট্রপতি ভবনে ঢোকেতারা কেউ কিছু চুরি করেনিনারীর অন্তর্বাস নিয়ে কেউ নাচানাচি করেনি। কিন্তু বাংলাদেশের আপরাইজের ছবি বলতে সারা পৃথিবীতে দেখানো হয় হাঁসমাছ থেকে শুরু করে ছেঁড়া কার্পেট পর্যন্ত চুরির ছবিআর নারীর অন্তর্বাস নিয়ে নাচানাচির ছবি।

শ্রীলংকা এক মাসের মধ্যে সামাজিকভাবে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। আর আমাদের যত দিন যাচ্ছেততই মব-সন্ত্রাস বাড়ছেতার সঙ্গেই “ মুরাদনগরে দ্রৌপদীর”  বস্ত্র হরণআবার আপরাইজিং-এর নেতাদের অডিও থেকে শুরু করে নারীর অন্তর্বাস নিয়ে নাচানাচির ছবি।

বাঙালি ইরানিদের মতো এত সভ্য জাতি কখনো নয়। ইরানের অন্যদের কথা বাদই থাকস্ত্রী বা স্বামী যদি একে অপরের জন্য অন্তর্বাস কিনে আনে বা স্ত্রী নিজে হাতে তৈরি করেও থাকেনতা-ও একে অপরকে একটি মোড়কের ভেতরেই দেনখোলা অবস্থায় দেন না। আর বাংলাদেশ কী দেখেছেতা তো এখন সারা পৃথিবী জানে।

ইকোনমিস্টের এই সংখ্যায় লেখা হয়েছেবাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন চার বছরের মধ্যে শেষ হয়ে যায়। আর জুলাই আপরাইজিংযার শিরোনাম তারা দিয়েছে “Bangladesh’s Blunder”, সেখানে বলা হয়েছেএটা এক বছরেই শেষ হয়ে গেছে।

জীবনের এ প্রান্তে এসে মুদ্রার দুপিঠ যতটুকু দেখিতাতে যা বুঝিমুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন সাড়ে তিন বছরের একটু বেশি সময়ে শেষ হয়ে যাওয়ার মূল কারণ শুধু স্বাধীনতা-বিরোধীরা নয়মুক্তিযুদ্ধোত্তর মুক্তিযোদ্ধাদের একাংশের আচরণতাদের উন্মত্ততাও। তাই যারা বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর গড়ছেনতাদের উচিত হবে মুদ্রার দুই পিঠই সেখানে সংগ্রহ করাতা না হলে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর পূর্ণাঙ্গ হবে নাইতিহাস বাস্তবের মাটিতে দাঁড়াবে না।

তেমনি শুনতে পাচ্ছিগণভবনকে নাকি জুলাই যাদুঘর করা হবে। ভবিষ্যতের নির্বাচিত সরকারের জন্য সেটা কতটা যুক্তিযুক্ততা এখানে লিখতে চাই না। তবে যেখানেই জুলাই যাদুঘর হোক না কেনসেখানে বিগত সরকারের অত্যাচারের বা যে স্মৃতি এই সরকার রাখতে চায়সেটাও যেমন থাকবেতার পাশাপাশি যে নারীর অন্তর্বাস নিয়ে নাচানাচি করেছে তার মূর্তিযারা হাঁসমাছশাকব্যাগকাপড় চুরি করেছে তাদের মূর্তিএবং বর্তমানে তাদের চিন্তকদের যে অডিও শোনা যাচ্ছে সহযাত্রী নারীর সঙ্গেসেগুলো থেকে শুরু করে “ মুরাদনগরের দ্রৌপদীর”  বস্ত্র হরণের ভিডিওনা রাখলে সে যাদুঘর পূর্ণাঙ্গ হবে কি?

লেখক: রাষ্ট্রীয় পুরস্কার-প্রাপ্ত সাংবাদিকসম্পাদকসারাক্ষণ ও The Present World.