১১:৪৪ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

ছয়মাসে ৩৫৪ ধর্ষন, নারী কি এখন নিরাপদ!

ছয় মাসে নথিবদ্ধ ধর্ষণ: সংখ্যায়ই আতঙ্ক

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সংবাদপত্র-ভিত্তিক পর্যবেক্ষণ বলছে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুন—এই ছয় মাসে অন্তত ৩৫৪জন নারী ও কিশোরী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ২৬৯ জনই শিশু ও কিশোরী; দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ১০৬টি, যার ৬২টিতে ভুক্তভোগী নাবালিকা। একই সময়ে ধর্ষণের পর হত্যা ১৭টি ও আত্মহত্যা ৪টি। সংস্থাটি সতর্ক করে বলেছে, গণমাধ্যম-নির্ভর এই সংখ্যা প্রকৃত চিত্রের চেয়ে অনেক কম।

শিশুদের উপর ঝড়: ১০ জনের ৯ জনই নাবালিকা

আইনে সালিশ কেন্দ্রের (আসক) সর্বশেষ রিপোর্ট জানাচ্ছে, জানুয়ারি-এপ্রিল ২০২৫-এ নথিবদ্ধ ৩৪২টি ধর্ষণ মামলার বয়স–তথ্য পাওয়া গেছে ২০১ জন ভুক্তভোগীর; এর মধ্যে ১৭৬ জন—অর্থাৎ ৮৭.৫৬ ভাগ—শিশু। শূন্য-ছয় বছর বয়সী অন্তত ৪০ জন, সাত-বারো বছরের ৬৫ জন।

কেন বাড়ছে ধর্ষণের ঘটনা?

বিচারহীনতার সংস্কৃতি
ঢাকায় করা ধর্ষণ মামলার ৯৭ শতাংশেই সাজা হয় না—২০১৮ সালের একটি বিশেষ অনুসন্ধান এখনও দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। অপরাধীরা নিশ্চিত জানে, সাজা ‘হতে না-ও পারে’।

দীর্ঘসূত্রতা ও দুর্বল তদন্ত
● ডিএনএ পরীক্ষার সামর্থ্য সীমিত, সাক্ষী-সুরক্ষা আইন চালু না হওয়ায় ভুক্তভোগী ও পরিবার বারবার হয়রানির মুখে পড়ে।
● ‘টু-ফিঙ্গার টেস্ট’ নিষিদ্ধ হলেও বিকল্প ট্রমা-সেন্সিটিভ পদ্ধতি মাঠপর্যায়ে পৌঁছেনি।
● পুলিশের ওপর প্রশাসনিক-রাজনৈতিক চাপ, মামলার তদন্তে পেশাদার জনবল স্বল্পতা।

সামাজিক-পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা
● নারীর পোশাক, চলাফেরাকে দোষারোপ—‘ভিকটিম ব্লেমিং’—এখনও মূলধারা।
● পর্নোগ্রাফি ও ডিজিটাল ব্ল্যাকমেইল বেড়েছে; আইসিটি আইনে দ্রুত বিচার না হওয়ায় অপরাধ বাড়ে।
● বাল্যবিবাহ ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা মেয়েদের ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে ঠেলে দেয়।

আইন-শৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক অস্থিরতা
সরকার পরিবর্তন-পরবর্তী সময়ে মুগিং, ছিনতাইয়ের সঙ্গে ধর্ষণও বাড়ছে—একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে রাজধানীর পরিস্থিতিকে ‘Gotham but no Batman’ বলা হয়েছে।

কীভাবে থামানো যাবে?

  • দ্রুত ও বৈজ্ঞানিক তদন্ত: প্রতিটি জেলায় অত্যাধুনিক ফরেনসিক ল্যাব, থানায় শিশু-বান্ধব জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষ স্থাপন।
  • সরাসরি সাক্ষী-সুরক্ষা আইন কার্যকর: হাইকোর্টে পড়ে থাকা খসড়াটি সংসদে উত্থাপন ও বাজেট বরাদ্দ।
  • ট্রমা-সেফ কেন্দ্র: মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ‘One-Stop ক্রাইসিস সেন্টার’ মডেল সম্প্রসারণ।
  • শৈশবেই মূল্যবোধ শিক্ষা: পাঠ্যবইয়ে সম্মতি (consent) ও লিঙ্গ-সমতা অন্তর্ভুক্ত; ছেলেশিশুদের আচরণগত প্রশিক্ষণ।
  • ডিজিটাল পর্যবেক্ষণ ও দ্রুত মামলা: সাইবার অপরাধ দমন দপ্তরে বিশেষ সেল, ৬ মাসের মধ্যে ট্রাইব্যুনাল-নিষ্পত্তি।

মাত্র ছয় মাসেই নথিবদ্ধ ৩৫৪টি ধর্ষণ মামলার ভয়াবহতা আমাদের স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে—চোখ বন্ধ করে থাকলে বিপদ শুধু ঘনীভূত হয়। আইনী সংস্কার, দ্রুত বিচার ও সমাজের মানসিক পরিবর্তন—এই ত্রিমাত্রিক পথরেখাতেই নিহিত আছে নারীর ও শিশুর নিরাপত্তা, আর সে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না গেলে উন্নয়ন-উন্নতি সবই হিসাবের খাতা মাত্র।

ছয়মাসে ৩৫৪ ধর্ষন, নারী কি এখন নিরাপদ!

০৬:১০:০৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩ জুলাই ২০২৫

ছয় মাসে নথিবদ্ধ ধর্ষণ: সংখ্যায়ই আতঙ্ক

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সংবাদপত্র-ভিত্তিক পর্যবেক্ষণ বলছে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুন—এই ছয় মাসে অন্তত ৩৫৪জন নারী ও কিশোরী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ২৬৯ জনই শিশু ও কিশোরী; দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ১০৬টি, যার ৬২টিতে ভুক্তভোগী নাবালিকা। একই সময়ে ধর্ষণের পর হত্যা ১৭টি ও আত্মহত্যা ৪টি। সংস্থাটি সতর্ক করে বলেছে, গণমাধ্যম-নির্ভর এই সংখ্যা প্রকৃত চিত্রের চেয়ে অনেক কম।

শিশুদের উপর ঝড়: ১০ জনের ৯ জনই নাবালিকা

আইনে সালিশ কেন্দ্রের (আসক) সর্বশেষ রিপোর্ট জানাচ্ছে, জানুয়ারি-এপ্রিল ২০২৫-এ নথিবদ্ধ ৩৪২টি ধর্ষণ মামলার বয়স–তথ্য পাওয়া গেছে ২০১ জন ভুক্তভোগীর; এর মধ্যে ১৭৬ জন—অর্থাৎ ৮৭.৫৬ ভাগ—শিশু। শূন্য-ছয় বছর বয়সী অন্তত ৪০ জন, সাত-বারো বছরের ৬৫ জন।

কেন বাড়ছে ধর্ষণের ঘটনা?

বিচারহীনতার সংস্কৃতি
ঢাকায় করা ধর্ষণ মামলার ৯৭ শতাংশেই সাজা হয় না—২০১৮ সালের একটি বিশেষ অনুসন্ধান এখনও দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। অপরাধীরা নিশ্চিত জানে, সাজা ‘হতে না-ও পারে’।

দীর্ঘসূত্রতা ও দুর্বল তদন্ত
● ডিএনএ পরীক্ষার সামর্থ্য সীমিত, সাক্ষী-সুরক্ষা আইন চালু না হওয়ায় ভুক্তভোগী ও পরিবার বারবার হয়রানির মুখে পড়ে।
● ‘টু-ফিঙ্গার টেস্ট’ নিষিদ্ধ হলেও বিকল্প ট্রমা-সেন্সিটিভ পদ্ধতি মাঠপর্যায়ে পৌঁছেনি।
● পুলিশের ওপর প্রশাসনিক-রাজনৈতিক চাপ, মামলার তদন্তে পেশাদার জনবল স্বল্পতা।

সামাজিক-পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা
● নারীর পোশাক, চলাফেরাকে দোষারোপ—‘ভিকটিম ব্লেমিং’—এখনও মূলধারা।
● পর্নোগ্রাফি ও ডিজিটাল ব্ল্যাকমেইল বেড়েছে; আইসিটি আইনে দ্রুত বিচার না হওয়ায় অপরাধ বাড়ে।
● বাল্যবিবাহ ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা মেয়েদের ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে ঠেলে দেয়।

আইন-শৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক অস্থিরতা
সরকার পরিবর্তন-পরবর্তী সময়ে মুগিং, ছিনতাইয়ের সঙ্গে ধর্ষণও বাড়ছে—একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে রাজধানীর পরিস্থিতিকে ‘Gotham but no Batman’ বলা হয়েছে।

কীভাবে থামানো যাবে?

  • দ্রুত ও বৈজ্ঞানিক তদন্ত: প্রতিটি জেলায় অত্যাধুনিক ফরেনসিক ল্যাব, থানায় শিশু-বান্ধব জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষ স্থাপন।
  • সরাসরি সাক্ষী-সুরক্ষা আইন কার্যকর: হাইকোর্টে পড়ে থাকা খসড়াটি সংসদে উত্থাপন ও বাজেট বরাদ্দ।
  • ট্রমা-সেফ কেন্দ্র: মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ‘One-Stop ক্রাইসিস সেন্টার’ মডেল সম্প্রসারণ।
  • শৈশবেই মূল্যবোধ শিক্ষা: পাঠ্যবইয়ে সম্মতি (consent) ও লিঙ্গ-সমতা অন্তর্ভুক্ত; ছেলেশিশুদের আচরণগত প্রশিক্ষণ।
  • ডিজিটাল পর্যবেক্ষণ ও দ্রুত মামলা: সাইবার অপরাধ দমন দপ্তরে বিশেষ সেল, ৬ মাসের মধ্যে ট্রাইব্যুনাল-নিষ্পত্তি।

মাত্র ছয় মাসেই নথিবদ্ধ ৩৫৪টি ধর্ষণ মামলার ভয়াবহতা আমাদের স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে—চোখ বন্ধ করে থাকলে বিপদ শুধু ঘনীভূত হয়। আইনী সংস্কার, দ্রুত বিচার ও সমাজের মানসিক পরিবর্তন—এই ত্রিমাত্রিক পথরেখাতেই নিহিত আছে নারীর ও শিশুর নিরাপত্তা, আর সে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না গেলে উন্নয়ন-উন্নতি সবই হিসাবের খাতা মাত্র।